নীলা বুঝল। নীলা আগেই বুঝেছিল।
তার ইচ্ছে করে বলতে, আমিও তো চাকরি করি না, আমার দায়িত্ব কে নেবে?
কিন্তু আবারও মুখের লাগাম টেনে রাখে।
.
বেনোয়া চলে গেলে লাইব্রেরিঘরে জে এম কোয়াতেজির ডিসগ্রেস বইটি নীলা হাতে নেয়। বইয়ের নামটি তাকে আকর্ষণ করে, আগে এই লেখকের কোনও বই সে পড়েনি। পড়তে গিয়ে চোখ বারবার চলে যায় পাসকালের ছবিতে। দৃষ্টি দমন করে বইয়ের প্রতিটি শব্দে চোখ ফেলে সে অর্ধেক বই শেষ করে, হঠাৎ খেয়াল হয়, বইয়ে তার মোটেও মন নেই, মন পাসকালে। ঘর থেকে দ্রুত বেরিয়ে গিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে বড় বড় শ্বাস নেয় নীলা। কেবল বেনোয়ার সঙ্গে সংসার করছে না সে, করছে বেনোয়ার পুরো পরিবারের সঙ্গে। বড্ড ভিড়ের সংসার।
নীলার ওই শ্বাস বন্ধ হওয়া সময়ে বেনোয়া ফোন করে, ওয়ান্ডাকে খাবার দিয়েছ?
না।
কেন?
মনে ছিল না।
মন যে কোথায় আজকাল থাকে তোমার…যেভাবে বলে দিয়েছি, ঠিক সেভাবে সেভাবে দাও। ছোট্ট একটা কুকুর আর….
আর কী, নীলা বলে, তাকেও হিংসে করছি?
না সে কথা বলছি না, ভাবছি ওর কষ্ট হচ্ছে নিশ্চয়ই।
নীলা ফোন রেখে ওয়ান্ডার তিন বাটিতে তিন রকম খাবার দিল, জলের বাটিতে জল বদলে দিল।
দিয়ে বারান্দায় এসে বড় বড় শ্বাস নিল আবার।
খানিক পর বেনোয়া আবার জিজ্ঞেস করে, দিয়েছ ওয়ান্ডাকে খেতে?
না দিইনি। নীলা ঠাণ্ডা গলায় বলে।
কেন? ওদিকে উত্তেজিত
দিইনি কারণ ওয়ান্ডার খাবারগুলো আমি খেয়ে ফেলেছি। নীলার শান্ত স্বাভাবিক গলা।
এ সব কী বলছ তুমি?
ঠিক বলছি। আমি গরিব দেশের মেয়ে, কুকুর বেড়ালকে এত ভাল ভাল খাবার খাওয়ানোর অভ্যেস নেই। এত ভাল খাবার মানুষের জোটে না। তাই লোভে খেয়ে ফেলেছি।
খটাস।
টেলিফোনের খটাসের সঙ্গে একটি কাচভাঙা শব্দ এসে মেশে। কাচ ভাঙাটি কোন ঘর থেকে, সেটি খুঁজতে গিয়ে দেখে টেবিলের ওপর দাঁড়িয়ে লেজ নাড়ছে ওয়ান্ডা, আর মেঝেয় পড়ে টুকরো হয়ে আছে পাসকালের ছবির ফ্রেম। ছবিটি মেঝে থেকে তোলে না, ঠিক যেভাবে ছিল সেভাবে রেখেই বেরিয়ে যায় সে। বেরোতে গিয়েই দেখে পাশের এপার্টমেন্ট থেকে পুলিশ একটি মৃতদেহ বের করছে। মাদাম সুজান দুগের মৃতদেহ। বয়স পঞ্চাশ হবে সুজান দুগের। নীলার সঙ্গে দেখা হত প্রায়ই সিঁড়িতে, করিডোরে। প্রথামত বজুঁ নীলাও বলেছে, সুজানও। সম্পৰ্কটুকু বজুঁতেই ছিল, একদিন সুজান কেবল যেচে কথা বলেছিলেন। জিজ্ঞেস করেছিলেন, অনেক রাত অব্দি তিনি গান শোনেন, গানের শব্দ নীলার কোনওরকম অসুবিধে ঘটায় কি না। নীলা না বলেছে, গানের কোনও শব্দই সে পায়নি কখনও বলেছে। সুজান দুগে বলেছিলেন, আসলে একা থাকলে গান শুনে সময় পার করা ছাড়া আর উপায় থাকে না। পুলিশের কাছে জিজ্ঞেস করে নীলা জানে, সুজান দুগে এ ঘরে মরে পড়ে আছেন বেশ কদিন হল, কনসিয়েজ করিডোর পরিষ্কার করতে এসে বিশ্রী গন্ধ পায়, সুজানের ঘর থেকে বেরোচ্ছে, দরজা ধাক্কিয়ে কারও কোনও সাড়া শব্দ না পেয়ে পুলিশে জানিয়েছে, পুলিশ এসে দরজা ভেঙে আবিষ্কার করেছে সুজানের ফুলে ওঠা মরা দেহ।
সুজানের ফুলে ওঠা পচে ওঠা মুখটি দেখে নীলার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। সে চোখ নাক কান বুজে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে দেয়ালে হেলান দিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে যায়, প্রায় দৌড়ে জর্জ ব্রাসাঁ পার্কে, সরোবরের কিনারে, ঘাসের ওপর শুয়ে আকাশের দিকে মুখ করে, শুয়ে থাকে। তার ভয় হয়, সুজানের মতো সেও একদিন একা ঘরে মরে পড়ে থাকবে।
ঘণ্টাদুয়েক পর জর্জ ব্রাসাঁ থেকে বেরিয়ে শহরে উদ্দেশ্যহীন ঘুরে বেড়ায়। বিকেলে বাড়ি ফেরে, একটি নতুন ফ্রেম হাতে। পাসকালের ছবিটি ওতে লাগিয়ে ভাঙা কাচ সরিয়ে নিয়ে হাঁসের মাংস রান্না করে, বেনোয়া হাঁস খেতে ভালবাসে।
.
বিকেলে আপিস থেকে ফিরে বেনোয়া বলে, আজ তার মায়ের সঙ্গে কথা হয়েছে ফোনে। বেনোয়া বলেছে সে নীলাকে নিয়ে যাবে তাঁকে দেখতে। পারলে আজই।
যেন কনে দেখাতে নিচ্ছে বেনোয়া, নীলার সেরকম বোধ হয়। নীলা সাজলও সেরকম, চুল বাঁধল, মুখ সাজল, উঁচু জুতো পরল, পশ্চিমে যা মানায়, লম্বা কালো জামা পরে, গায়ে সুগন্ধী ছড়িয়ে বেনোয়ার হাত ধরে বেরোল।
গার দ্য অস্তারলিজ থেকে অরলেওঁ। পথে এক ঘণ্টা বেনোয়া একাই কথা বলে, বলে নীলার সঙ্গে সম্পর্কটি যদি দুদিনের সম্পর্ক মনে করত, তা হলে তাকে নিয়ে সে তার বাবা মার কাছে যেত না। তারপর আগেও যা বলেছে, তাই নতুন করে বলে, বেনোয়া তার সংসারে অসুখী ছিল না, বরং অতি সুখের সংসার ছিল তার, অত সুখ দেখে তার বন্ধুরা প্রায়ই বলেছে, এমন আদর্শ জুটি তারা এ সমাজে আর দেখেনি। পাসকাল তার অবাধ্য হয়নি কোনওদিন, লক্ষ্মী বউয়ের মতো সে স্বামীর সেবা করে গেছে। স্বামীকে সুখী করার জন্য সে এমন কিছু নেই যে করেনি। সুতরাং এ ভাবার কোনও কারণ নেই, যে বেনোয়া বউয়ের যন্ত্রণায় তিক্ত বিরক্ত হয়ে অন্য একটি মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক গড়েছে। বেনোয়ার গল্প অন্য লোকদের মতো নয়, ভিন্ন। বেনোয়ার জীবনে হঠাৎ বিদ্যুৎচমকের মতো নীলার উপস্থিতি সব কিছু অন্যরকম করে দিয়েছে। এ ঘটেছে বলে বেনোয়া এত পাষণ্ড নয় যে পাসকালকে সম্পূর্ণ ত্যাগ করবে। পাসকালের যে কোনও প্রয়োজনে সে পাশে দাঁড়াবে। আপিস থেকে বেনোয়ার মাসের বেতন সোজা চলে যাবে পাসকালের অ্যাকাউন্টে, অল্প কিছু সে নিজের হাতখরচের জন্য রাখবে শুধু। এই ত্যাগটি নীলার জন্যই করছে সে। আর সামনের শনি রোববার রু দে রেনের বাড়িতে তার কাটাতে হবে, কারণ পাসকাল বলেছে, জ্যাকলিনও। বুঝলে?