বেনোয়ার মুখে হাসি ফোটে, আমি জানি, তুমি মন থেকে ও সব বলছ না। তুমি বলতে পারো না। তুমি আমাকে ভালবাসো, তুমি আমাকে হারাতে চাও না।
নীলার কণ্ঠের কাছে এক থোকা কষ্ট এসে বসে। দাঁতে ঠোঁট চেপে ঢোক গিলে সে কষ্টের গতিকে নিম্নমুখী করে।
বেনোয়া নীলাকে বুকে জড়িয়ে দুলতে থাকে ডানে বামে। বলতে যাকে জ তেম জ তেম জ তেম।
নীলা জানে একা থাকা কাকে বলে। বেনোয়া চলে গেলে এই বাড়িটিতে নিজের ছায়া দেখে নিজে চমকে উঠবে। কেউ তাকে এভাবে আলিঙ্গন করবে না, কেউ বলবে না, জ তেম। প্রেমিক তাকে সঁপে দিচ্ছে জীবন, আর সে হেলা করে দূরে সরাবে, এত স্পর্ধা সে কোথায় পাবে। এত শক্তি!
বেনোয়া বলে, যেদিন তোমার বই ছুড়ে চলে গেলাম, ভেবেছিলাম, তোমার আমার সম্পর্ক এই শেষ। পাসকালের কাছে ক্ষমাও চেয়েছিলাম, কিন্তু যখনই কল্পনা করেছি, তুমিহীন আমার জীবন, আমার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল, তুমি আমার প্রাণবায়ু নীলা। আমি তখনই বুঝেছি। তখনই বুঝেছি ঈশ্বর আমাদের তৈরি করেছেন পরস্পরের জন্য। আমার আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে করছিল, ছুরি নিয়েওছিলাম হাতে। পাসকাল আমাকে তখন ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল।
কীসের ডাক্তার?
সাইকিয়াট্রিস্ট।
নীলা চমকায়। ওই সাধারণ বাগবিতণ্ডার কারণে মানসিক রোগের ডাক্তারের কাছে যেতে হয়েছে বেনোয়াকে! বেনোয়ার আলিঙ্গন থেকে নিজেকে আলগোছে সরিয়ে বেনোয়ার আবেগে নিমীলিত চোখে তাকিয়ে সে প্রশ্ন করে, তারপর তোমাকে ওই ডাক্তার বলল বোদেলেয়ারের বই আর একটি গোলাপ নিয়ে এখানে আসতে?
বেনোয়ার ঠোঁটে তেঁতো হাসি, তুমি কি ভেবেছ আমার ইচ্ছে করেনি তোমার কাছে আসতে? ডাক্তার বলেছে বলে এসেছি?
নীলার ভয় হয়, সুস্থ হোক কি অসুস্থ হোক, মানসিক রোগের ডাক্তারের কাছে যাওয়া ফরাসিদের যেহেতু নাপিতের কাছে চুল কাটতে যাওয়ার মতো নৈমিত্তিক, হয়তো ডাক্তার একদিন বলে বসবে, যাও পাসকালের সঙ্গে মন দিয়ে সংসার করো গিয়ে। বেনোয়া তাই করবে।
কী ব্যাপার, তুমি মনে করছ আমার মাথার অসুখ আছে? বেনোয়া জিজ্ঞেস করে।
নীলা হেসে উত্তর দেয়, না। মোটেই না। আমার মনে হয় আমার মাথার অসুখ আছে। আমার শিগরি ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে।
কেন, তোমার আবার কী হয়েছে।
আমারও মাঝে মাঝে কেমন শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। বলে নীলা।
.
ঘুমের নীলাকে একটু একটু করে জাগায় বেনোয়া, কানের কাছে ফিসফিস করে, আমার সঙ্গে যাবে এক জায়গায়?
কোথায়?
যাবে কি না আগে বলোই না।
এই রাত্তিরে?
হ্যাঁ। তুমি বললে আমি এক্ষুনি তোমাকে নিয়ে যাব।
যাব। বলল এবার, কোথায়।
সাত আকাশে।
বেনোয়া নীলাকে সাত আকাশে নেয়। পালকের মতো ওড়ে সে সাত আকাশে। বেনোয়া তাকে যত সুখ দেয়, পৃথিবীর আর কেউ কোনওদিন দেবে বা দিতে পারবে বলে নীলার মনে হয় না।
বেনোয়ার হারেমেই নিজের অদুষ্ট কল্পনা করে নেয় নীলা।
.
সপ্তম আকাশ জুড়ে ভ্রমণও শেষ হয়, রাতও ফুরোয়। নীলার ক্লান্ত শরীর যেই না ঘুমের অতলে ডুবেছে, বেনোয়ার রেডিয়োর খবর তাকে পারে ওঠায়। রেডিয়ো এলার্ম বেনোয়ার। ওয়ান্ডা ছুটে এসে নীলার গায়ের ওপর বসলে লাফিয়ে নেমে যায় সে। কুকুরটির গায়ের বোটকা গন্ধ আর কানের কাছের রেডিয়োর চিৎকার, নীলার ঘুম সপ্তম নয়, চৌদ্দতম আকাশে উড়িয়ে নেয়। উঠে সে বেনোয়ার জন্য কফি বানিয়ে রুটি জেলি মাখন যা আছে বের করে টেবিলে রাখে। কফিতে দু চুমুক শুধু। খাওয়ার সময় নেই।
এত তাড়া কীসের?
মেট্রো ধরতে হবে।
মেট্রো কেন? গাড়ি কোথায়?
ও তোমাকে বলিনি। গাড়ি তো কাল পাসকালকে দিয়ে এসেছি। ও ব্যবহার করবে এ গাড়ি। বেনোয়ার সহজ স্বাভাবিক কণ্ঠ।
তা হলে তুমি কী ব্যবহার করবে? নিজের জন্য চায়ের জল চাপিয়ে নীলা বলে।
আপাতত মেট্রো আর বাসেই চলাফেরা করতে হবে।
আপাতত। তারপর?
আসলে কী জানো নীলা, মেট্রো আর বাসে চলাফেরা করতেই আমার ভাল লাগে। গাড়ি নিয়ে প্যারিসে কী রকম অসুবিধে দেখেছ তো। পার্কিং পাওয়ার জন্য সারা শহর ঘুরতে হয়। একটু এদিক ওদিক হল তো জরিমানা।
নীলা মাথা নাড়ে। সে বুঝেছে গাড়ির অসুবিধের কথা। চুক চুক কোরে দুঃখ করে বলে, তা হলে পাসকালেরও বিষম ভুগতে হবে গাড়ি নিয়ে।
ওর দরকার বেশি আমার চেয়ে। জ্যাকলিনকে ইস্কুলে দিয়ে আসা নিয়ে আসা।
ও।
শুনে খুশি হলে না মনে হয়? বেনোয়া তির্যক দৃষ্টিতে তাকায়।
তুমি খবর জানালে আমি শুনলাম। এটুকুই। খুশি হওয়ার না খুশি হওয়ার কোনও ব্যপার ঘটেনি।
নীল জিনসের ওপর একটি টিশার্ট পরে নেয় বেনোয়া। পায়ে ছালওঠা মোটা জুতো। টাই সে পরে না আদৌ, শার্ট কদাচিৎ। নীলার কেনা শার্টগুলো বলেছে বাইরে কোথাও ভাল জায়গায় বেড়াতে গেলে পরবে, টাইগুলো আলমারিতে অব্যবহৃত পড়ে আছে। অডি কোলনও। নীলার পছন্দ করা সুগন্ধী সে ছোঁয়নি, নিজের এরামিস মাখে গায়ে। এরামিস তার পছন্দ, কারণ এ নাম তিন মাসকেটিয়েরের একজনের।
গায়ে সুগন্ধ ছড়িয়ে নীলার সামনে দাঁড়ায় বেনোয়া, বলে, শোনো, মন দিয়ে শোনো, আগেই বলেছি আমি, পাসকালকে ছেড়ে এসেছি সত্য, কিন্তু ওর খরচপত্র সব আমাকে বহন করতে হবে। জ্যাকলিনকে ও সময় দিতে পারছিল না চাকরির কারণে, আমিই ওকে বলেছি স্টারবুর্গের চাকরিটি ছেড়ে দিতে। দিয়েছে। ও বাড়ির খরচ সবই আমাকে দিতে হবে। পাসকাল এবং জ্যাকলিনের দায়িত্ব সম্পূর্ণ আমার। বুঝলে?