বেনোয়ার তাজা কণ্ঠ, নানারকম বিল এসে রয়েছে বাড়িতে, সব মেটাতে হল।
নীলা ঘুমের স্বরে বলে, থেকে গেলেই পারতে।
বেনোয়া জুতো খুলতে খুলতে বলে, ভেবেছিলাম থেকে যেতে। কিন্তু পাসকালই বলল, যাও নীলা অপেক্ষা করছে।
এ মুহূর্তে নীলার সম্ভবত পাসকালের কাছে কৃতজ্ঞ হতে হয়।
ও তোমাকে অন্য এক মেয়ের কাছে যেচে পাঠায়, এ কেমন? নীলার ঘুম কেটে যাওয়া স্বর। ও কি তোমাকে ভালবাসে না কি বাসে না?
নিশ্চয় বাসে।
তবে এই যে আমার সঙ্গে থাকছ, ও রাগ করে না? আমি তো পারতাম না বলতে যাও তোমার অন্য প্রেমিকার কাছে যাও। ও কী করে পারে?
ও খুব ভাল মেয়ে নীলা। বেনোয়া জোর দিয়ে আরও বলে, ওর মতো ভাল মেয়ে আমি পৃথিবীতে দুটি দেখিনি।
তা হলে এত ভাল মেয়েকে ছেড়ে এলে কেন?
তুমি তো জানো কেন? তোমার জন্য। জানো না?
তোমার নিজের জন্য কী ইচ্ছে করে, শুনি, কার সঙ্গে থাকতে, কোন বাড়িতে?
আমার নিজের জন্য যা ইচ্ছে করে, তা আমি করছি।
বিছানায় নয়, চেয়ারে বসে বলে বেনোয়া। নীলার চোখের দিকে চোখ ফেলে। আবছা অন্ধকারে বসা সে, আর নীলার ওপর আলো, বিছানার পাশের ছোট টেবিলের ছোট আলো!
আমার মনে হচ্ছে তুমি এখনও নিশ্চিত হওনি, তুমি কী চাও। নীলা বলে।
আমি তোমাকে আগেই জানিয়েছি আমি কী চাই। বলেছি, তোমাকে ছাড়া আমার জীবন চলবে না। বেনোয়া নরম স্বরে বলে।
আমাকে ছাড়া তোমার জীবন কী হবে, শুনি? তুমি কি খাবে না, দাবে না, ঘুমোবে না, চাকরি করবে না? জীবনের কী চলবে না তোমার?
আমি হয়তো সব করব কিন্তু সে আমি এই আমি হব না। জীবিত থেকেও মৃত। নীলা তুমি কি আমাকে বিশ্বাস করো না? তুমি জানো না তোমাকে কতটুকু ভালবাসি। তুমি জানো না, কতটুকু ভালবাসা থাকলে একটি সুখের সংসার ছেড়ে আসা যায়। আমার আর পাসকালের মধ্যে কোনওদিন এতটুকু কথা কাটাকাটি হয়নি। তোমার ঘটনা আমি সব ওকে খুলে বলেছি। ও মেনে নিয়েছে। আমি কোনও কিছু লুকোই না ওর কাছে। ও আমার সবচেয়ে বড় বন্ধু নীলা। ও আমাকে ভীষণ ভালবাসে, ভালবাসে বলেই আমি যা করতে পছন্দ করছি, তাতে ও বাধা দেয় না। ভালবাসার মানুষের জন্য ত্যাগ আর দেখেছ কোথাও এমন? পাসকালই পারে। ওকে আমি ভাল যেমন বাসি, শ্রদ্ধাও করি। তোমার জন্য আমি আমার সবচেয়ে ভালবাসার মানুষদের, আমার পাসকালকে, আমার জ্যাকলিনকে ছেড়ে দিয়েছি, এতেও তুমি খুশি হও না?
নীলা একটি বই মুখের সামনে তুলে ধরে। বেনোয়া কঠিন স্বরে বলে, বইটি সরাও, আমি তোমার চোখ দেখতে পাচ্ছি না।
চোখ দেখার দরকার কী তোমার।
আমি তোমার সঙ্গে কথা বলছি। আমার কথার উত্তর দাও, তুমি কি খুশি হওনি যে আমি তোমার কাছে আমার স্ত্রী কন্যা ছেড়ে চলে এসেছি? বলো।
নীলা বইটি মুখের সামনে ধরে রেখেই বলে, কেন বলো যে ছেড়ে এসেছি। তুমি তো ছেড়ে আসোনি। সে এখনও তোমার স্ত্রী। তোমাদের প্রতিদিন ফোনে কথা হচ্ছে। প্রায়ই ওর কাছে যাচ্ছ। ছেড়ে আসা বলো কেন? এর নাম ছেড়ে আসা নয়। তোমাদের ভালবাসার আংটি এখনও তোমার আঙুলে, তোমার টেবিলে ওর ছবি, লোকে যেখানে আদরের বউয়ের ছবি রাখে।
বেনোয়া চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। নীলার সামনে বসে, বইটি বাঁ হাতে সরিয়ে বলে, তুমি কী চাও বলো তো! তুমি চাও আমি ও বাড়িতে চলে যাই?
তোমার যদি ইচ্ছে হয়, নিশ্চয়ই যাবে। আমি বাধা দেব কেন? আমি তোমাকে এ বাড়িতে আসতে বলিনি। তুমি নিজে এসেছ। ও বাড়িতে যখন ছিলে, তোমার আমার সম্পর্ক কিছু খারাপ ছিল না। পার্থক্যটা কী?
বেনোয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, আজ যদি অন্য কোনও লোক হত আমার জায়গায়, বলত আপিসে কাজের চাপ ছিল, অথবা মিটিং ছিল, অথবা আপিসের কাজে রাতের খাবার ছিল, তাই দেরি হয়েছে। আমি সত্য কথা বলি, কিছু লুকোই না তোমার কাছে। আমার সততার এই মূল্য দিচ্ছ তুমি, নীলা? তোমার মন এত ছোট কেন, আমি বুঝি না।
নীলা ধীরে শান্ত কণ্ঠে বলে, আমার মন ছোট নয় তো। মন বড়। বড় বলেই আমি বলছি তুমি পাসকালের সঙ্গে থাকো গিয়ে। ওর সঙ্গে সুখের সংসার করো, যেমন করছিলে। তুমি ওকে ছেড়ে আসোনি। তুমি ওকে ছাড়তে পারবে না, তার সবচেয়ে বড় কারণ কী জানো, ওকে তুমি ভালবাস।
বেনোয়া তার হাঁটুর ওপর দু কনুইয়ের ভর রেখে দু হাতে মাথা চেপে ধরে।
বেনোয়ার পিঠের ওপর একটি হাত রেখে নীলা বলে, আমি জানি তুমি সত্য কথা বলছ। কিন্তু ওর কথা ভেবেই আমি বলছি। আজ যদি তুমি আমার স্বামী হতে, আর তুমি যদি আমাকে ছেড়ে অন্য মেয়ের সঙ্গে থাকতে, আমার কী রকম কষ্ট হত, সে আমি অনুমান করতে পারি। পাসকালকে আর কষ্ট দিয়ো না। নিজেকেও আর কষ্ট দিয়ো না। তোমাকে হারিয়ে আমার খানিকটা কষ্ট হবে তা ঠিক। এ নিয়ে ভেবো না, কষ্ট পেয়ে আমার অভ্যেস আছে। কষ্ট পেয়ে আমার মারও অভ্যেস ছিল।
বেনোয়া উঠে ঘরের উজ্জ্বল বাতি জ্বেলে দেয়। নীলার বুকে ধক করে শব্দ হয়। এই বুঝি বেনোয়া গুছোতে শুরু করছে তার সুটকেস। এই বুঝি নীলাকে একা করে দিয়ে জন্মের মতো চলে যাবে তার একটি মাত্র আশ্রয়। আলো জ্বেলে বেনোয়া বিছানায় মুখোমুখি বসে নীলার, বলে, সত্য করে একটা কথা বলো। নীলা, তুমি কি মন থেকে বলছ কথাগুলো? তুমি কি সত্যি চাও আমি চলে যাই?
নীলা উত্তর দেয় না।