কী হল কী! নীলা জিজ্ঞেস করে।
বেনোয়া বলে, না কিছু না।
কিছু তো নিশ্চয়ই।
জানালা থেকে চোখ না ফিরিয়ে বেনোয়া বলে, জ্যাকলিন নিশ্চয়ই আমাকে খুব মনে করছে।
কাল তুমি ও বাড়িতে গিয়ে জ্যাকলিনকে দেখে আসতে তো পারো!
জানালা থেকে ফিরে এসে নীলাকে চুমু খেয়ে, চোখে চিকচিক আনন্দ, বলে, সত্যি বলছ?
নিশ্চয়ই, তোমার ইচ্ছে করলে তুমি যাবে না কেন?
তাই তো, বেনোয়াও বলে, যাবে না কেন? জ্যাকলিনের শরীরে তারই রক্ত বইছে, জীবনে তার যা কিছু ঘটুক না কেন, সন্তানের প্রতি পিতার যে কর্তব্য তা সে নিশ্চয়ই করে যাবে।
জ্বর রাতের বেলা ভীষণ বেড়ে ওঠে নীলার, সারারাত কঁকায়। সকালের দিকে ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়লে বেনোয়াকে কাছের ফার্মেসি থেকে কিছু এমক্সিসিলিন কিনে আনতে বলে। না হবে না, ডাক্তার না লিখে দিলে ফার্মেসি থেকে এ ওষুধ কেনা যাবে না। বেনোয়া আপিসে চলে গেলে, নীলা রান্নাঘরে ঢুকে দেখে ধুয়ে মুছে সব ঝা তকতকে করে রেখেছে বেনোয়া। পুরো দিন তার যায় ঘড়ির দিকে তাকিয়ে, বেনোয়ার ফিরতে আর ক’ঘণ্টা ক’মিনিট ক’সেকেন্ড বাকি আছে, তা হিসেব করতে করতে।
ওই অপেক্ষার সময়েই দানিয়েলের ফোন আসে।
জ্বর শরীরেও নীলা উচ্ছ্বাস আটকে রাখতে পারে না। বেনোয়ার সঙ্গে তার সংসারের নতুন খবর দেয়। সে যে রক্ষিতা নয়, এ কথাটি বার বার বলে।
চলে এসো দানিয়েল, দেখে যাও কীরকম সুখে আছি আমি।
দানিয়েল আগ্রহ দেখায় না নীলার সুখের সংসার দেখার।
অন্তত জ্বর দেখতে আসো। মনে হচ্ছে টাইফয়েড।
টাইফয়েড এদেশে হয় না। অন্য কোনও জ্বর সম্ভবত। জ্বরের মধ্যে এসে কী করব, জ্বর সারুক তোমার। তারপর আড্ডা দিতে যাব।
নীলার চেতন ফেরে, এদেশ ভারত নয়, কারও অসুখ দেখতে কেউ কারও বাড়ি যায় না। সুস্থ হও, উচ্ছল হও, প্রচুর জীবনশক্তিতে টইটম্বুর হবে যখন, তখন কিছু পান করে আসব। আর যদি অসুখ বিসুখ হয়ে মরো, কালো জামা পরে তোমার সৎকার উৎসবে গিয়ে তোমার উদ্দেশে পান করব আর নাচব। ব্যাস।
দুচার কথার পর আগামী সপ্তাহে মিউচুয়ালিতে নারীবাদীদের একটি অনুষ্ঠানে নীলা যদি যেতে চায়, যেতে পারে ধরনের একটি আমন্ত্রণ জানায় দানিয়েল।
ফোনে কথা শেষ করে সুনীলের রেখে যাওয়া খামটি খোলে নীলা। খুলে প্রথম সে অনির্বাণের চিঠিটি পড়ে, কিষানের মুখে যাহা শুনিলাম, তাহাতে আমার মানসিক অবস্থা কী প্রকার হইতে পারে, তাহা নিশ্চয়ই অনুমান করিতে পারো। বিদেশের মাটিতে যাহা ইচ্ছা তাহা করিবার সুযোগ হয়তো তুমি পাইতেছ, কিন্তু একদিন নিশ্চয় তোমার বোধোদয় হইবে, তখন সময় থাকিবে না আর শুধরাইবার। এ যাবৎ অনেক ভারতীয় আক্ষেপ করিয়াছেন কেন তাহারা বিদেশের কুকুর ধরিয়াছিল স্বদেশের ঠাকুর ফেলিয়া। সুতরাং সময় থাকিতে সঠিক পথ বাছিয়া নাও। কিষানের সহিত যদি মীমাংসা না করো, তবে অতি শীঘ্রই দেশে ফিরিয়া আসো। এখনও সময় আছে নিজের ভুল ত্রুটি সংশোধন করিয়া, সমাজের দশটা লোকে যেন আর অধিক মন্দ না বলিতে পারে, দেশে আসিয়া সেই মতো জীবন যাপন করো।
নিখিলের চিঠির বক্তব্যও প্রায় একই। একটিই পার্থক্য, চিঠিটি চলিত ভাষায় লেখা।
.
রাত সাতটায় বেনোয়া ফোন করে জানায়, আপিস থেকে সোজা সে রু দ্য রেনে গেছে। পাসকাল আর জ্যাকলিনকে নিয়ে রেস্তোরাঁয় খেতে যাবে, খেয়ে ওদের পৌঁছে দিয়ে, জ্যাকলিনকে গল্প বলে ঘুম পাড়িয়ে তবে বাড়ি ফিরবে।
বেনোয়া রাত্তিরে সুখী মুখ নিয়ে বাড়ি ফেরে। সঙ্গে সুখী একটি কুকুরের বাচ্চা, কলকাতার রাস্তায় নেড়িকুকুরের পড়ে থাকা বাচ্চার মতো। ও বাড়িতে দুটো কুকুর, যেটি তার খুব ন্যাওটা, সেটিকে নিয়ে এসেছে। কুকুরটি নীলাকে দেখে ঘেউ ঘেউ করে বিছানায় লাফিয়ে ওঠে। একে বিছানা থেকে নামাও, নোংরা করে ফেলছে বলে তাড়াতে হাত তুলতেই করো কী করো কী বলে বেনোয়া ছুটে এল। ওয়ান্ডাকে বুকে নিয়ে বিছানায় গড়িয়ে ওয়ান্ডার একটি হাত বাড়িয়ে নীলার দিকে বলল, আমার প্রেমিকার সঙ্গে হাত মেলাও ওয়ান্ডা। নীলা সংসারের তিন নম্বর সদস্যকে স্বাগতম জানাল।
ওয়ান্ডা বাচ্চা নয়, রীতিমতো প্রাপ্তবয়স্ক। আকারে ছোট, ছোট জাত বলে, এর চেয়ে বড় এ জাতের কুকুর হয় না। এই ছোট জাত কুকুরের মূল্য বড় জাতের কুকুরের চেয়েও বেশি। ওয়ান্ডা কী খেতে ভালবাসে, ঘুম থেকে কখন ওঠে, উঠে তার কী কী করা চাই, কখন তার হাওয়া খেতে যাওয়া চাই, কখন খাওয়া খেতে ইত্যাদি বিস্তারিত বর্ণনা করে বেনোয়া প্রতি রাতের মতো জামা কাপড় খুলে বিছানায় আসে। নীলাকে চুমু খায় আর বলে, জ্যাকলিন তো আমাকে ছাড়তেই চাচ্ছিল না, ওকে বলেছি তোমার কথা। ও তোমাকে দেখতে চাইছে।
বেনোয়া এরপর নীলাকে আরও একটি চুমু খেয়ে হেসে বলল, আর একটা কী কথা বলেছে জানো?
কী কথা?
বলেছে ও একটা ভাই চায়।
বেনোয়ার চোখে উথলে ওঠা আবেগ, কী দেবে না জ্যাকলিনকে একটা ভাই?
নীলার একটি হাত নিজের উত্থিত শিশ্নের ওপর রেখে বলে, চলো আজই ভালবেসে রোপণ করি স্বপ্ন।
নীলা প্রায় জিজ্ঞেস করতে নেয়, কার স্বপ্ন? তোমার? আমার? নাকি জ্যাকলিনের? কিন্তু করে না, আশঙ্কায়, যদি সে বলে বসে, তোমার মন এত ছোট, ছ বছর বয়সের একটা শিশুর সঙ্গে হিংসে করছ, ছি!