কপাল থেকে হাতটি সরিয়ে বেনোয়া বলে, তুমি কি অসুস্থ বোধ করছ?
নীলা বলে, সে ঠিক আছে।
ইচ্ছেগুলো চেপে রেখে জিজ্ঞেস করে জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে আমার গা তাই না?
ও তা তো জানি না। তুমি কি দেখতে চাচ্ছ তোমার জ্বর কত? ঠিক আছে আমি তোমাকে জ্বর মাপার যন্ত্র এনে দিচ্ছি।
জ্বর মাপার যন্ত্রটি স্নানঘরে রাখা ওষুধের বাক্স থেকে এনে নীলার দিকে বাড়াতেই নীলা হাঁ করে মুখ, সেই হাঁয়ের দিকে হাঁ হয়ে তাকিয়ে যন্ত্রটি বেনোয়া হাতে দেয় নীলার। হাতে দিয়ে তোমার সেবায় জীবন সঁপিনু ভঙ্গির একটি হাসি হাসে। ওই হাসি দেখে যন্ত্রটি মুখের ভেতর ঢুকিয়ে মুখ থেকে প্রায় বেরিয়ে আসা ইচ্ছের লাগাম টেনে রাখে।
সে রাতেই বেরিয়ে দুটো ভরা সুটকেস নিয়ে বাড়ি ফেরে বেনোয়া। নীলাকে ছাড়া তার জীবন অর্থহীন, এ সে বুঝে গেছে, তাই এ সিদ্ধান্ত।
আর ওদিকের সম্পর্কটা?
সে ধীরে ধীরে চুকিয়ে ফেলব।
কত ধীরে, তা জানার তার ইচ্ছে করে না। বেনোয়ার এই সব ছেড়ে ছুড়ে তার কাছে চলে আসায় গভীর জ্বরের চেয়ে আরও বেশি কেঁপেছে নীলা, কেঁপেছে সুখে। সে এখন স্পষ্ট জানে বেনোয়া তাকে ভালবাসে। বেনোয়ার কাছে নীলার আর চাওয়ার কিছু নেই। তার বুকের সুগন্ধ নিতে নিতে নীলা পরম নিশ্চিন্তে চোখ বোজে। বাড়িটির পেছনে অঢেল টাকা খরচা করা তার সার্থক হয়েছে, মনে তার স্বপ্ন ছিলই এ বাড়িতে বেনোয়াকে নিয়ে একটি সংসার পাতার। স্বপ্ন এখন নীলার হাতের মুঠোয় রক্ত মাংসসহ জীবন্ত। অনিশ্চিত জীবনের বোঝা কাঁধে বয়ে বেড়াবার দিন ফুরিয়েছে তার, আজ থেকে জীবন আমূল বদলে গেল। বেনোয়ার হাত ধরে রাজনন্দিনীর মতো সে এখন পথ চলবে, কোনওদিন আর কোনও বর্ণবাদী টুঁ শব্দ করার সাহস পাবে না। সরকারের বিদেশি তাড়ানো মন্ত্রণালয় নীলার জন্য ফরাসি যুবকের আত্মত্যাগ দেখে ধারালো দাঁত নখ গুটিয়ে নেবে। কিষানের কুচুটেপনা নীলাকে স্পর্শ করতে পারবে না, সুনীলের করুণাকে আঁস্তাকুড়ে ছুঁড়ে দেবে সে। তার বেনোয়া আছে। বেনোয়া তার একার, আর কারও নয়, সে কোনও রক্ষিতা নয় কারও। বেনোয়া তার জ্বর কপালে হাত না রাখুক, না দিক জলপট্টি, না দিক মাথায় জল, না কিনে আনুক আঙুর, তবু বেনোয়া তাকে ভালবাসে, পাশ্চাত্যের ভালবাসা এমনই, হাতে জ্বর মাপের যন্ত্র দেওয়াই কি কম দেওয়া নাকি!
বেনোয়া নিজে রান্না করে, রান্না বলতে কাসুলের একটি টিন উপুড় করে ঢেলে দেওয়া কড়াইয়ে, গরম হলে ঢেলে দেওয়া থালায়, কাঁটা ছুরি আর মুখ মোছার রুমাল থালার পাশে রাখা, ওয়াইন ঢেলে দেওয়া গেলাসে, আর লম্বা বাগেত ফালি ফালি করে কেটে রাখা। টেবিলে সাজিয়ে নীলাকে ডাকে বেনোয়া, মোমের শিখার ওপারে নীলা দেখে বেনোয়ার হাসি মুখ। সিমের বিচির সঙ্গে ভেড়ার মাংস সেদ্ধ, ভেড়ার গায়ের গন্ধ মাংসে, নীলার খেতে রুচি হয় না। বেনোয়া পা নাচিয়ে বেশ স্বাদ হয়েছে তাই না বলে চিবোয়। নীলা একটি দুটি সিমের বিচি কাঁটায় তুলে মুখে দিয়ে হ্যাঁ বেশ স্বাদ বলে। বলে, কারণ সংসারী বেনোয়াকে হতাশ করতে নীলার আশঙ্কা হয়।
বেনোয়া জিজ্ঞেস করে, আমার ছোটবেলা কী করে কেটেছে, শুনবে?
ছোটবেলার গল্প করে সে। মন দিয়ে শোনে নীলা, ছ বছর বয়সে রেলে করে ইতালি গিয়েছিল বাবা মার সঙ্গে, রোমের রাস্তায় দেখেছিল জনতার ঢেউ, কীসের উৎসব ছিল, মনে করতে পারে না, উৎসবের একটি ছেলে থামে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বেনোয়ার হাত ধরে টেনেছিল, এসো, বাজিফোটানো হবে। বেনোয়া যায়নি, পরে তার বারবার মনে হয়েছে গেলেও পারত। সেই বাজির উৎসব দুর থেকে দেখেছে সে, আর বুক ফেটে গেছে আফসোসে।
পরের রাতেও ছোটবেলার গল্প বলতে গিয়ে ওই একই গল্প বলে বেনোয়া।
বেনোয়ার সঙ্গে নীলার সত্যিকার সংসার শুরু গেছে। সংসারে এক গল্প বারবার শুনলে এমন কিছু ক্ষতি নেই, নীলার একরকম আনন্দই হয় বেনোয়ার শৈশব কৈশোরের খুঁটিনাটি জানতে, কবে কোন ইস্কুলের মাস্টার তাকে বাহবা দিয়েছে, কবে কোন বন্ধুর নাকে ঘুষি লাগিয়ে অরলেওঁর গির্জায় পুরোহিতের কাছে গোপনে নিজের দোষ স্বীকার করে এসেছে সে। তার ছোটবোন ভালেরি লেখাপড়ায় বেনোয়ার মতো ভাল ছিল না, তাই বরাবরই সে হিংসে করে এসেছে তাকে, ছোটবেলায় বেনোয়ার ইস্কুলের বইখাতা প্রায়ই কুটি কুটি করে ছিঁড়ে মাটির তলে পুঁতে রাখত। ভালেরি এখনও তাকে হিংসে করে, নিজে সে শখের ওকালতি করে, ও করেই নাকি বেনোয়ার চেয়ে বেশি কামায়। বিয়ে করেছে, বাচ্চা হয়েছে, দাবি করে বাচ্চাটির স্বভাব চরিত্র নাকি জ্যাকলিনের চেয়ে ভাল।
রাতে বিছানায় শুতে আসে বেনোয়া উলঙ্গ হয়ে।
তোমার এভাবে জামা কাপড় গায়ে ঘুম আসে! বেনোয়া নীলার জামা কাপড় পরে শোয়ার দিকে ভ্রু কুঞ্চিত করে।
ঘুম আসে। বরং উলঙ্গ হয়ে ঘুমোনোর অভ্যেস আমার কোনওকালেই নেই।
নীলার সহসা মনে হয় নীলার উলঙ্গ শরীরে বুঁদ হতে চাইছে বেনোয়া, তাই এই ইঙ্গিত, কিন্তু পাশে ঘন হয়ে শুয়ে নীলাকে সেন্তেক্সোপেরির ছোট্ট রাজকুমারের গল্প শোনায় বেনোয়া অর্ধেক রাত অব্দি, বেনোয়ার শীতল শরীরে শীতল শিশ্ন ঝুলে থাকে। পরের রাতেও শুতে এসে শেয়াল আর বাঘের গল্প বলে। গল্প শেষ হলে বিছানা ছেড়ে জানালায় দাঁড়িয়ে থাকে।