গিন্নি তো কিছু রাঁধেনি।
কিষান বলে, তা হলে খাব কী গো? স্বামীকে না খাইয়ে মারবে?
নীলা ঠিক কী উত্তর দেবে বুঝে পায় না। আপাতত বিধবা হওয়ার ইচ্ছে তার নেই।
কিষানের গম্ভীর গলা, একেবারে ভুলে গেছি, বুঝলে। তোমাকে দরজার চাবি দিয়ে আসা উচিত ছিল। বাড়িতে আগুন ধরলে…
আগুন ধরবে কেন? নীলা জিজ্ঞেস করে।
আরে, দুর্ঘটনা ঘটে না? চুলো টুলো থেকে। সাবধানের মার নেই।
তা ঠিক, সাবধানের মার নেই। আগুন ধরলে সে আগুন কী করে নেভাবে সে নিয়ে ভাবছিল, এবং বুঝে পাচ্ছিল না আগুনের সঙ্গে চাবির সম্পর্ক কী হতে পারে। জিজ্ঞেস করল, কী হবে আগুন ধরলে?
তখন চাবি থাকলে বেরোতে পারবে। তেষ্টা পেলে জল পান করার মতো সোজা উত্তরটি দেয় কিষান।
ও। নীলা বোঝে উত্তরটি, ঘরে আগুন লাগলে প্রাণ বাঁচাতে ঘরের বাইরে যাবার স্বাধীনতা তার সম্পূর্ণই আছে। আগুন না লাগলে প্রাণ বাঁচানোর প্রশ্ন নেই, প্রশ্ন ওঠে না।
কিন্তু যদি ওঠে!
রান্নাঘরে এঁটো বাসন ধুতে ধুতে, ভাত ডাল আর সবজি রাঁধতে গিয়ে, বারবারই ভাবল সে, যদি ওঠে!
নীলার ভাত গেল পুড়ে, সবজি রইল অসেদ্ধ, ডাল হয়ে গেল নুনে তেতো।
.
সন্ধের পর বাড়ি ফিরে ভারী শরীরটিকে কিষান ছুড়ে দিল সোফায়।
কাপড় জামা খোলো! হাত মুখ ধোও, বাইরে থেকে এসেছ। নীলা বলে, বলে টের পায়, বোনের স্নেহ উপচে পড়ছে কণ্ঠে তার।
এ কি তোমার নোংরা কলকাতা পেয়েছ যে বাইরে থেকে এলে ধুলোবালি দূর করতে হাত মুখ ধুতে হবে! হা হা! কিষান বলে।
সারাদিন এমন ভারী জুতো পরে আছ, জুতোটা খোলো অন্তত! বলে নীলার মনে হয়, ঠিক এভাবে মলিনা তাঁর পুত্রধন নিখিলকে জুতো খুলতে বলেন।
খুলে দাও না। কিষান দু পা এগিয়ে দেয় নীলার দিকে।
কিষানের পায়ের কাছে বসে সরু আঙুলে জুতোর সরু ফিতে ঢিলে করে জুতো খোলে নীলা, মোজা খোলে।
নিজেকে এবার ঘরের দাসীর মতো মনে হয়, যেন চিত্রা সে, চিত্রা এরকম জুতো খুলে দেয় বাড়িসুদ্ধ লোকের।
স্নানঘরে ময়লা কাপড়ের ঝুড়ি আছে। ওতে রেখে দাও। কাল ধুয়ে দিও সব। কিষানের কণ্ঠ স্বামীর অথবা প্রভুর। বাড়ির বউকে অথবা দাসীকে যে কণ্ঠে কিছুর আদেশ করা হয়, এ ঠিক সে কণ্ঠ।
ময়লা মোজা দুটো স্নানঘরে নিতে নিতে নীলা ভাবে, রাতে বিছানায় তাকে দিব্যি পতিতা সাজতে হবে, পতিতারা যেমন করে দুটো পয়সার জন্য শরীর বিকিয়ে দেয় তেমন করে বিকোতে হবে তার নিজেকে। পতিতার খদ্দেরে এবং স্বামীতে কোনও পার্থক্য আছে কি না। নীলা ভাবে। যে পার্থক্যটি সে দেখে, তা হল পতিতাকে তার পাওনা বুঝিয়ে তবে খদ্দেরকে পার পেতে হবে, কিন্তু স্ত্রীর পাওনা না মিটিয়েও স্বামী পার পেয়ে যায় বা যেতে পারে। পতিতার স্বাধীনতা স্ত্রীর চেয়ে অনেক ক্ষেত্রে বেশি বলে তার মনে হয়।
নীলা ভাবে, মা বোন আর পতিতা এই তিন চরিত্রে দক্ষ অভিনয় করতে হয় স্ত্রীকে না কি এ অভিনয় নয়, এই তিন চরিত্র নিয়েই জন্ম হয় যে কোনও মেয়ের।
.
কী কেমন লাগছে প্যারিসে? কিষান বলে।
নীলা জানালায় উদাস তাকিয়ে উত্তর দেয়, এই প্রথম ভারতের বাইরে আসা। মাঝে কোনও সমুদ্দুর নেই, তবু মনে হয় যেন সাত সমুদ্দুর পেরিয়ে এসেছি। অন্য এক জগতে, বড় অচেনা।
কিষান ধীরে মাথা নাড়ে, ধীরে বলে, যাক না কটা বছর, দেখবে ভারতকেই অচেনা লাগছে। জীবন এরকম নীলা, অভ্যেস, আর কিছু নয়। এখানকার জীবনে অভ্যস্ত হলে ভারতের জীবনে তুমি খাপ খাওয়াতে পারবে না, যদিও ভারতেই তোমার জন্ম, বড় হওয়া।
তা কী কী করলে সারাদিন? কিষান প্রশ্ন করে।
সারাদিন একা লেগেছে। ওদের ফোন নম্বর থাকলে কথা বলতে পারতাম..
ওদের কাদের?
ওই কাল রাতে যারা এসেছিল..
ওদের সঙ্গে খামোকা কথা বলতে যাবে কেন? কাল রাতের ব্যাপার কাল রাতেই শেষ। কাজের কাজ হল দেশে ফোন করা।
কিষান কলকাতায় ফোন করে। মধ্যরাত ওখানে, ঘুমোবার আয়োজন চলছে। নীলা পৌঁছেছে, ভাল আছে, কাল অনেকটা বিয়ের অনুষ্ঠান মতো হল এ বাড়িতে, কিষান জানাল। অনির্বাণের সঙ্গে কথা হওয়ার পর নিখিলের সঙ্গে হয়, শেষে মলিনার মলিন কণ্ঠের সঙ্গে।
কী যে ফাঁকা লাগছে বাড়ি। তুই তো কখনও দূরে যাসনি আগে। মলিনার কণ্ঠ ওপাশে কাঁদে।
ধমকে ওঠে নীলা, থামো তো! বোকার মতো কাঁদছ। ওই বাড়িতে, ওই বালিগঞ্জে আমি পচে মরলে তোমার বুঝি ভাল লাগত!
কেমন আছিস, বল আমাকে। মলিনা জিজ্ঞেস করেন।
নীলা উচ্ছ্বসিত, ভাল আছি, খুব ভাল আছি। এখানে সব কিছু খুব সুন্দর। কাল রাতে খুব মজা হল। অনেক লোক এসেছিল। চমৎকার লোক সব।
ওপাশে তবু বিনিয়ে বিনিয়ে কাঁদেন মলিনা।
নীলার রাগ হয় কান্না শুনলে। মা ব্যাপারটি বড় বিচ্ছিরি, মেয়ের বিয়ে না হলে কেঁদে বালিশ ভেজান, আর হলেও বুক ভাসান।
.
কিষান মদ নিয়ে আয়েশ করে বসে। খেতে খেতে তার রেস্তোরাঁ লাল কিল্লায় লাল বাতি জ্বলছে জানায়। শিগরি নাম পালটাতে হবে। নীলা ঠিক বুঝে পায় না, নাম পালটালে লাল থেকে বাতি সবুজে যাবার কী কারণ। প্রশ্ন করলে কিষান হাসে, বলে এ সব বুঝবে না। বুঝিয়ে দাও, বুঝব। নীলা আবদার করে। বোঝালেও নীলা বুঝবে বলে কিষানের মনে হয় না। মেয়েদের ব্যবসাবুদ্ধি সাধারণত থাকে না বলেই সে জানে।
সুরুচি, খাবার দাবার, তৃপ্তি এই নামগুলো নীলা প্রস্তাব করে রেস্তোরাঁর নামের জন্য। কিষান উড়িয়ে দেয় নামগুলো মদগন্ধ হাওয়ায়। চলবে না। কী চলবে তা হলে? চলবে গান্ধী। গান্ধীর সঙ্গে ভারতীয় খাবারের সম্পর্ক কী? সম্পর্ক না থাকলেও গান্ধীর সঙ্গে ফরাসিদের সম্পর্ক আছে, ফরাসিরা গান্ধী নামটি যত জানে, লাল কিল্লা তত জানে না। রেস্তোরাঁয় খাবারের মান কতটুকু পালটাবে? সে একই থাকবে, আগের বাবুর্চিই রাঁধবে, আগের লোকরাই পরিবেশন করবে।