তুমি ফিরছ কখন? নীলা জিজ্ঞেস করে।
ঠিক নেই। ঠিক নেই কারণ কিষান নটা পাঁচটা চাকরি করে না যে বলবে পাঁচটায় আপিস থেকে বেরিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দেব, রাস্তায় ট্রাফিকে নেবে পঁয়ত্রিশ মিনিট, আর ছ মিনিট যাবে নীচে রাস্তায় গাড়ি রাখার জায়গা খুঁজতে, আর দু মিনিট ওপরে উঠতে, ফিরব পাঁচটা তেতাল্লিশে। দুটো রেস্তোরাঁ চালায় কিষানলাল। মঁপারনাসে তাজমহল নামে একটি, দ্বিতীয়টি লাল কিল্লা, পনেরো এরনদিসমোয়। লাল কিল্লাটি ভাল চলছে না, নাম পালটালে ভাল চলবে, কিষানের বিশ্বাস।
একটা নাম ভাবো তো! কিষান বলে।
সারাদিন আমি কী করব? নীলা কিষানের মুখোমুখি বসে গালে হাত, মাথা ঝুঁকে থাকে ডানে, চোখ কিষানে, জিজ্ঞেস করে।
বসে বসে আমার কথা ভাববে।
আর?
আর কী? এ ভেবেই কি সময় ফুরোবে না?
যদি না ফুরোয়? নীলার উদাসীন প্রশ্ন।
এও কথা বটে।
খুব শিগরি নীলাকে নিয়ে তার বাইরে যেতে হবে, গরম জামা জুতো কিনতে, শিগরিটি ঠিক কবে, তা অবশ্য সঠিক করে কিষান বলে না।
নীলার চোখ কিষান থেকে সরে গিয়ে জানালায় আটকে থাকে। বাইরের স্বর্গে।
আচ্ছা ওটা, ওটা কি রাজার বাড়ি? আঙুল তুলে জানালার ওপারে গায়ে গায়ে মূর্তি বসানো একটি বাড়ি দেখায় সে।
রেল ইশটিশন। গার দ্য নর্দ।
বলো কী? ইশটিশন এত সুন্দর হয়?
নীলা দৌড়ে যায় জানালার দিকে।
শহরটা কখন ঘুরে দেখাবে? গলায় তার শিশুর আহ্লাদ। পতিব্রতার সাধ আহ্লাদ অত থাকতে নেই, তবুও।
কাল তো শহর খানিকটা ঘুরে দেখালাম, এত অস্থির হচ্ছ কেন, সবে তো এলে, দেখার জন্য তো সারা জীবন পড়ে আছে তোমার। বলে বেরিয়ে যায় কিষান।
দেখার জন্য সারাজীবন পড়ে আছে, নীলা তা জানে। তবু প্রতি লোমকূপে অস্থিরতার উদ্বাহু নৃত্য দেখে সে। ইস্পাতের ঘরটিতে বসে ঠিক যেরকম দেখেছিল। ওই ঘরে বসেও সে অপেক্ষা করছিল ছুটি পেতে, এ ঘরেও একই রকম অপেক্ষার অনুভব নীলার। ছুটি পাবার অপেক্ষা, কোত্থেকে ছুটি, কোথায় যেতে, স্পষ্ট করে কিছু সে জানে না যদিও। এ ঘরেও একই রকম ডানা ঝাপটায় প্রাণপাখি। ইস্পাতের দেয়ালের চেয়ে কিছু কম নির্জীব নয় এ বাড়ির দেয়াল।
জানালায় উদাসীন বসে থেকে নীলা দেখে নীচের রাস্তায় মানুষ হাঁটছে, গাড়ি ছুটছে, সুনসান নিস্তব্ধতার মধ্যে সভ্য সুন্দর সুচারু ব্যস্ত জীবন মানুষের। কলকাতা বিষম চিৎকারে ফেটে পড়ে এই মাঝ দুপুরে–ভোঁ বাজার, ট্রাকের চাকা ফাটার, ঠেলাগাড়ির, ফিরিঅলার, ভিখিরির, কুকুরের ঝগড়ার, জলকলে মেয়েমানুষের চুলোচুলির তীব্র শব্দ, হল্লা হুল্লোড়ে কলকাতা এত তেতে ওঠে যে, তিষ্ঠোনো দায়। নীলার মনে হতে থাকে পৃথিবীর বাইরে কোথাও চলে এসেছে সে, যেখানে জঞ্জাল নেই, ঝঞ্জাট নেই, বিসদৃশ কিছু নেই, অসংবৃত, অশোভন, অকুলীন কিছু নেই।
এ শহর তেতে ওঠে না, চেঁচায় না, তা ঠিক, কিন্তু এ শহরে সবারই ব্যস্ততা আছে কেবল তারই নেই, তারই নটা পাঁচটা নেই, এক তারই অপেক্ষা কেউ করছে না কোথাও। নীলা আনমনে তার অলস অবসর জুড়ে গাইতে থাকে ভেঙে মোর ঘরের চাবি, নিয়ে যাবি কে আমারে। গাইতে গাইতে নিজের স্বরে নিজেই চমকায় সে। গার দ্য নর্দ-কে মনে হতে থাকে ফরাসি রাজার বাড়ি, আর রাজার ছেলে সে বাড়ির জানালা খুলে দেখছে দূরে এক দৈত্যের ঘরে বন্দি এক রাজকন্যা, খোঁপা ভেঙে ঘন কালো দীঘল চুল গড়িয়ে পড়েছে তার। বুকে পিঠে। রাজপুত্র ঘোড়ায় চড়ে বন্দিনীকে উদ্ধার করতে ছুটে আসছে, হাতে তার জাদুর কাঠি, সে কাঠি ছোঁয়ালেই দৈত্যের ঘরের দরজা আপনাতে সিসিম ফাঁকের মতো খুলে যাবে, রাজকন্যাকে ঘোড়ার পিঠে চড়িয়ে রাজপুত্র সেই প্রাসাদের সিংহদরজায় নামবে, তারপর দুজন হাত ধরে হেঁটে যাবে অন্তঃপুরের দিকে। নিজের হাতটির দিকে তাকায় নীলা, কিষান কখনও এই হাতটি হাতে নিয়েছে বলে তার মনে পড়ে না। হাতে হাত ছুঁয়ে গেছে নিশ্চয়ই, শখ করে এই সরু সরু আঙুলের দিকে, রাঙানো নখগুলোর দিকে বাহ বেশ তো ধরনের দৃষ্টিও, নীলার মনে পড়ে না, কিষান ছুড়েছে। নীলার শরীর নিয়ে অন্ধকারে প্রমোদবিহারে যখন সে নামে, তখন তার প্রতি অঙ্গ লাগি কাঁদে প্রতি অঙ্গ কিষানের এ তার একেবারেই মনে হয় না, বড়জোর নীলার একটি অঙ্গ লাগি ফোঁসে কিষানের একটি অঙ্গই। নীলার লাবণ্যলতা আঙুল, সুবিন্যস্ত রক্তিম নখ, ভ্রমর কালো চোখ, দীঘল ঘন চুল অন্ধকারে নমশুদ্র অস্পৃশ্যের মতো পড়ে থাকে।
.
জানালা থেকে সরে সারা বাড়িতে বই খোঁজে নীলা। থানইটের মতো গোটা পাঁচেক টেলিফোনের বই, একটি ইংরেজি ফরাসি অভিধান, তিনটে রান্নার বই হিন্দি ভাষায়, দু বছর আগের সাতটি ল মন্দ পত্রিকা, চারটে হেরাল্ড ট্রিবিউন, আত তিনটে পর্নো ম্যাগাজিন, এ ছাড়া পাতি পাতি করে খুঁজেও নীলা আর ছাপার অক্ষরের কিছু পায় না। হাল ছেড়ে গানের জগতে হামলে পড়ে, হিন্দি সিনেমার গান, চারটে ইংরেজি, কিছু ভাংড়া, আর একখানা এডিথ পিয়াফ, এই। রবীন্দ্রসংগীতের রও নেই, এমনকী ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সংগীতের ছিটেফোঁটাও ভাণ্ডারে নেই। এডিথ পিয়াফ চাপিয়ে নীলা দেখে একই সুরে কিচিরমিচির করে যাচ্ছে এ দেশের ছোট্ট চড়ুই। অচেনা জায়গায় অচেনা কিচিরমিচির শুনলে আরও একা লাগে। এডিথ পিয়া বন্ধ করে ঘর থেকে ঘরে হাঁটে নীলা। সঙ্গে হাঁটে তার পায়ের শব্দ শুধু। অতঃপর এক বর্ণ ফরাসি না বোঝা নীলা টেলিভিশন খুলে সাদা মানুষের হাসি ঠাট্টা দৌড় ঝাঁপ দেখতে থাকে মন দিয়ে। মগ্নতা ভাঙে ফোনের শব্দে, তখন বিকেল, ওপাশে কিষানের স্বর, কী রেঁধেছ গো গিন্নি?