গাড়ি এয়ারপোর্টের দিকে যাচ্ছে। রেনুর বাবাকে রিসিভ করে নিয়ে আসতে যাচ্ছি। আমার কোলে রেনুর খাতা। খাতার পাতা উল্টাচ্ছি, রেনু তার বাবা সম্পর্কে কিছু লিখেছে কি-না দেখছি। হোমওয়ার্ক করে যাওয়া। কয়েকপাতা উল্টাতেই পাওয়া গেল—
আমার বাবা
চেহারা : অপূর্ব।
স্বভাব : অপূর্বেরও দুই ডিগ্রি উপরে।
বুদ্ধি : অসাধারণ। তিনি Mensa group-এর সদস্য। যাদের IQ অনেক বেশি তারাই Mensa’র সদস্য হতে পারে। IQ রেটিং-এ বাবার IQ বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর লেখক Asimov-এর চেয়েও বেশি। Asimovও একজন Mensan.
আমি বাবার মতো Mensa’র সদস্য হতে চাই। তবে আমার IQ ভালো না।
আরেক জায়গায় লেখা—
অতি উঁচু IQ লেভেলের মানুষের বিষয়ে বাবার বক্তব্য
I found that high IQ people can be just as stupid as low IQ people much more stupid.
রেনুর বাবার এই মন্তব্য পড়ে আমি নিশ্চিত হলাম মানুষটা বুদ্ধিমান। বিরাট বুদ্ধিমান এবং বিরাট বোকা এই দু’ধরনের মানুষের সঙ্গ আনন্দময়।
দেখা যাক সময়টা কেমন কাটে।
আজ হিমুর বিয়ে – পর্ব ৬
সাম্প্রতিক গবেষনায় চোখের জলের নানান গুণাগুণ পাওয়া গেছে। চোখের জল কঠিন জীবানু বিধ্বংসী। ভিটামিন ই, অ্যাণ্টিঅক্সিডেণ্ট এবং পটাশিয়াম সমৃদ্ধ। ভাইরাসকে কোনো কিছুই কাবু করতে পারে না। কিছু কিছু ভাইরাসের ক্ষেত্রে চোখের জল না-কি কার্যকর।
আমি এই মূল্যবান চোখের জলের অপচয় বর্তমানে লক্ষ করছি। ঘটনাটা ঘটছে জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। আমি হাতে একটা প্লাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। সেখানে লেখা—
Dr. T. FERGUSEN Jr.
ফার্গুসেন জুনিয়র রেনুর বাবা। আমি তাকে এয়ারপোর্ট থেকে নিতে এসেছি। খবর পাওয়া গেছে বিমান নেমেছে। যাত্রীরা ইমিগ্রেশনে আছে। আমার অপেক্ষা কুরতে ভালো লাগছে। চারিপাশে চোখের জল দেখছি। মালয়েশিয়ায় একদল শ্রমিক যাচ্ছে। তাদের বিদায় দিতে আত্মীয়স্বজনরা এসেছেন। একেকজনের সঙ্গে ছয়জন-সাতজন করে। কে কার চেয়ে বেশি কাঁদবে সেই প্রতিযোগিতা চলছে। এয়ারপোর্ট যদি চোখের পানি জমা করতে পারত। সেই অশ্রু নানান গবেষণায় ব্যবহার করা যেত।
আমি যথেষ্ট আগ্রহ নিয়ে কান্না দেখছি। গ্রুপে গ্রুপে অশ্রু বিসর্জন। প্রতিটি গ্রুপের আবার একজন করে গ্রুপ লিডার। এই লিডার ডিসিসান দিচ্ছেন—‘অনেক হয়েছে। এখন ছাড়। বিমানে উঠা লাগবে।’
একটা গ্রুপ পেলাম যেখানে কোনো কান্নাকাটি হচ্ছে না। পুরো গ্রুপে ভয়াবহ টেনশন। কারণ এই গ্রুপে পাসপোর্ট হারানো গেছে। পাসপোর্ট খোঁজা হচ্ছে গ্রুপ লিডার সবাইকেই ধমকাচ্ছেন। কিছুক্ষণ পর পর বলছেন—‘এত বড় ঘটনা ক্যামনে ঘটল? বেবাকতে গরু গাধা। বেবাকতে গরু গাধা।’
আশেপাশের লোকজনদের চোখ-মুখে সমবেদনার লেশ মাত্র দেখা যাচ্ছে না। সবার মুখের ভাব এমন যে বেকুবির শাস্তি হওয়া প্রয়োজন। পাসপোর্ট হারিয়েছে ভালো হয়েছে।
যার পাসপোর্ট হারিয়েছে তার বয়স অল্প। বোকা বোকা চেহারা। সে পুরোপুরি ভ্যাবদা মেরে গেছে। বেচারা মনে হয় সম্প্রতি বিয়ে করেছে। বউটি ছোটখাট। বয়সও মনে হয় অল্প। কিশোরী কিশোরী মুখ। গায়ে বিয়ের গয়না পরেছে, তবে সেই গয়না দেখা যাচ্ছে না, টকটকে লাল শাড়িতে শরীর ঢেকে রেখেছে। মাথায় চাঁদ তারা আঁকা
টিকলি পরেছে। সে স্বামীকে সান্তনা দিতে গিয়ে শাশুড়ির ধমক খেল। শাশুড়ি চোখমুখ শক্ত করে বললেন, ঢং করবা না। ঢংয়ের সময় নাই।
মালয়েশিয়ার যাত্রীরা একে একে ভিতরে ঢুকতে শুরু করেছে। পাসপোর্ট হারানো গ্রুপের গ্রুপ লিডার মেঝেতে বসে এখন মাথা চাপড়াচ্ছেন। বিড়বিড় করে বলছেন, হারামজাদারে জুতা মারা দরকার।
আমার এখন উচিত এগিয়ে যাওয়া। কারণ ওদের হারানো পাসপোর্ট খুব সম্ভবত আমার কাছে। সবুজ রঙের একটা পাসপোর্ট আমি খুঁজে পেয়েছি। পাসপোর্টে টাই পরা এক যুবকের ছবি। নাম সুরুজ মিয়া। পাসপোর্টের ছবি সঙ্গে কিশোরী বধূর স্বামীর চেহারার তেমন মিল নেই। তারপরেও আমি এগিয়ে গেলাম। যুবকের কাছ গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি সুরুজ মিয়া?
যুবক হ্যাঁ-সুচক মাথা নাড়ল।
তোমার পাসপোর্ট পাওয়া গেছে। কিছুক্ষণের মধ্যে আমার হাতে চলে আসবে। চিন্তা করবে না। এত বেখেয়াল কেন?
পুরো দলটায় প্রাণ ফিরে এলো। গ্রুপ লিডার মেঝে থেকে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন—স্যার, আপনে এই হারামজাদা পুলার গাল বরাবর একটা থাপ্পর দেন। বিয়ার পরে খালি বউ নিয়া আছে, দুনিয়ার দিকে খিয়াল নাই। চউখের পাতি না ফেইল্যা বউয়ের দিকে চায়া থাকলে পাসপোর্ট তো মিসিং হইবই। দেন থাপ্পর।
আমি দিলাম থাপ্পর। এই প্রথম থাপ্পর খেয়ে কেউ একজন আনন্দে হেসে ফেলল। আমি বললাম, সুরুজ মিয়া, সবার কাছ থেকে বিদায় নাও। ইমিগ্রেশনে ঢোকার টাইম।
সুরুজ মিয়া বলল, স্যার পাসপোর্টটা?
আমি বললাম, পাসপোর্ট যথাসময়ে পাবে। আগেভাগে দিব আবার হারাবে।
গ্রুপ লিডার বলল, অতি ‘সার্থকতা’ কথা। পুলার গাল বরাবর আরেকটা থাপ্পর দেন।
আমি পাসপোর্টটা বের করে সুরুজ মিয়ার স্ত্রীর হাতে দিয়ে বললাম, শক্ত করে ধরে রাখ। শেষ মুহূর্তে স্বামীর হাতে দিবে।
ধুম কান্না শুরু হয়ে গেল। গ্রুপ লিডার চিৎকার করে কাঁদছেন। তাঁর হাহাকারে এয়ারপোর্টের বাতাস ভারী হয়ে গেল—ও আমার সোনা মানিকরে! আইজ আমি গরিব, অক্ষম বইল্যা তোমারে বিদেশে পাঠাইতাছি। যে দুনিয়ার কিছু বুঝে না সে ঘরে নয়া বউ ফালায়া যাইতেছে বৈদেশ। কেন এত গরিব হইলাম, আমার আদরের ধন চইল্যা যাইতেছে, আমি বাঁচব ক্যামনে?
সবাই কাঁদছে। কাঁদছে না শুধু কিশোরী বউটি। স্বামীর পাসপোর্ট হাতে সে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
আমার পেছনে কেউ একজন দাঁড়িয়েছেন। ঘাড় ফিরিয়ে দেখি এক আমেরিকান পৌঢ়। তিনি হাত বাড়িয়ে বললেন, I am Fergusen. Hello.
আমিও বললাম, Hello.
সাহেব বললেন, এরা সবাই কাঁদছে কেন?
এদের একজন বিদেশে চলে যাচ্ছে। সেই জন্যেই কাঁদছে। সুরুজ মিয়া স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে এখন এসেছে আমার কাছ থেকে বিদায় নিতে। আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে বুক ভাসাচ্ছে। স্বামীর ব্যাকুল কান্না দেকেহ কিশোরী বধূও কাঁদতে শুরু করেছে।
সাহেব বললেন, তুমি কি ওদের কোনো আত্মীয়?
আমি বললাম, না।
আমি তাকালাম সুরুজ মিয়ার স্ত্রীর দিকে। কাঁদতে কাঁদতে সে চোখ লাল করে ফেলেছে। মেয়েটির সামনে দীর্ঘ দিবস দীর্ঘ রজনীর বিচ্ছেদ। হে পরম করুণাময়! তুমি এই মেয়েটির বিচ্ছেদ যাতনা অসহনীয় করে দিও। মিলনে প্রেমিককে কখনো পাওয়া যায় না, তাকে পাওয়া যায় শুধুমাত্র বিরহে।