তূর্যের চেহারা সুন্দর হবে এটা আমি ধরেই নিয়েছিলাম। এতটা সুন্দর হবে কল্পনাও করি নি। একজন দেবদূত হাজতের শিক ধরে বসে আছে। বড় বড় স্বচ্ছ অভিমানী চোখ। চোখের দিকে তাকালেই মনে হয়, কিছুক্ষণ আগে এই চোখ অশ্রুবর্ষণ করেছে। প্রাচীন গ্রীক ভাস্কররা এই ছেলেকে দেখলে মডেল হিসেবে অবশ্যই ব্যবহার করতেন। এই ছেলের গায়ে কেউ হাত তুলতে পারে ভাবাই যায় না। রেবুর পাশে এই ছেলেকে দাঁড় করিয়ে ভোটাভুটি করলে তূর্যের ভোট বেশি পাবার সম্ভাবনা আছে।
হ্যালো তূর্য।
তূর্য চমকে তাকাল। কিছু বলল না।
আমি তোমার জন্যে দুই পুরিয়া জিনিস নিয়ে এসেছি। পচা বাবার কাছ থেকে এনেছি। পচা বাবার নাম শুনেছ?
তূর্যের দৃষ্টি তীক্ষ্ম হলো। তার পাতলা ঠোঁট কাঁপছে। সে ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলছে। তূর্য বলল, আপনি কে?
আমার নাম হিমু।
আমাকে চেনেন কীভাবে?
রেনুর মাধ্যমে চিনি। রেনুর কথা মনে আছে তো?
তূর্য বলল, পুরিয়া দিন।
এখনই খাবে?
তূর্য জবাব দিল না। আমি দেখলাম তার হাতের আঙুল কাঁপছে। ঠোঁট কাঁপছে, চোখের পাতাও কাঁপছে। আসন্ন নেশার উত্তেজনাতেই এমন হচ্ছে।
রেনুর বিয়ে হচ্ছে, এই খবর পেয়েছ?
না। কার সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে?
আমার সঙ্গে। আজ রাত ন’টা সাড়ে ন’টার দিকে বিয়ে হবে। তুমি কি বরযাত্রী হিসেবে যেতে চাও?
তূর্য জবাব না দিয়ে বলল, আমাকে পুরিয়া দিন।
এত তাড়াহুড়া কেন? আগে কথা বলি।
কথা বলতে ভালো লাগছে না।
রেনুর সঙ্গে কথা বলবে?
না।
না কেন? রেবুর সঙ্গে তোমার ভাব আছে না?
জানি না।
জানবে না কেন?
আমি বুঝতে পারি না।
যাই হোক, তোমাকে আমি ছোট্ট একটা কাজ দেব। জটিল কোনো কাজ না। সহজ কাজ। কাজটা করা মাত্রই পুরিয়া হাতে পাবে। ওয়ার্ড অব অনার।
কাজটা কী?
রেনুকে বলবে সে যেন তার হাতের রগ না কাটে। টেলিফোনে বলবে। আমি লাইন করে দেব, তুমি বলবে।
হাতের রগ কাটা মানে কী?
রেনু বলেছে, আমার সঙ্গে যদি তার বিয়ে হয় তাহলে সে তার হাতের রগ এটে মারা যাবে। সে সেভেন ও ক্লক ব্লেড নিয়ে তৈরি।
তূর্যের ঠোঁটে সামান্য হাসির আভাস দেখা গেল। সে সঙ্গে সঙ্গে সেই হাসি মুছে ফেলে বলল, আমি টেলিফোন করব।
থ্যাংক য়্যু। আমি লাইন করে দিচ্ছি। টেলিফোনে কথা শেষ হওয়া মাত্র পুরিয়া।
রেনু কি ভালো আছে?
তাকে তালাবন্ধ করে রাখা হয়েছে, তবে সে ভালো আছে। তুমি একটু অপেক্ষা কর, আমি লাইন করে দিচ্ছি, তুমি রেনুকে বুঝিয়ে বলো।
নানান ঝামেলা করে খালার মাধ্যমে রেনুকে ধরা গেল। আমি মোবাইল টেলিফোন তূর্যের হাতে দিয়ে দিলাম। তূর্য কথা বলছে। ওপাশ থেকে রেনু কী বলছে শোনা যাচ্ছে না। তূর্যও কথা বলছে অতি নিচু গলায়। কী বলছে আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। হয়তো এরকম নিচু গলাতেই সে কথা বলায় অভ্যস্ত।
তূর্য টেলিফোন শেষ করল। আমি বললাম, তুমি কি আমার কথাটা বলেছ?
না।
বলো নি কেন?
তূর্য চুপ করে রইল। আমি বললাম, মোবাইল টেলিফোনটা তোমার কাছে দিয়ে যাচ্ছি। একটা পুরিয়াও দিয়ে যাচ্ছে। আমার বিষয়ে রেনুর কাছে সুপারিশের পরপরই পুরিয়া ব্যবহার করতে পারবে। তবে সুপারিশ না করে জিনিস খাবে না।
তূর্য তাকিয়ে আছে একদৃষ্টিতে। কিছু একটা বলতে গিয়েও বলল না। আমি বললাম, তোমাকে যা বলেছি মনে আছে তো? আমার বিষয়ে সুপারিশ করার পরে পুরিয়া খাবে, তার আগে না।
তূর্য ঘাড় কাত করল।
আমি বললাম, রেনুকে বিয়ে করার ব্যাপারে আমার আগ্রহের কারণ জানো? আমি মেয়েটার প্রেমে পড়ে গেছি। ঐ বিখ্যাত লাইন মনে আছে?—
‘রমণীর মন সহস্র বৎসরের সখা সাধনার ধন।’
রেনুর মন আমি এখনো পাই নি। সাধনা সেইভাবে শুরু করি নি বলে পাই নি। কয়েকঘণ্টা মাত্র সাধনা করেছি।
আপনার নাম কী?
একবার কিন্তু তোমাকে নাম বলেছি। তারপরেও আরেকবার বলছি—আমার নাম হিমু।
পুরিয়া দিন।
আমি পুরিয়া দিলাম। মোবাইল টেলিফোন দিয়ে বললাম, টেলিফোন এবং পুরিয়া দু’টাই লুকিয়ে রাখবে। থানাওয়ালাদের চোখে পড়লে তারা নিয়ে নিতে পারে।
চলে আসার আগে ওসি সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। তিনি খুবই বিরক্ত ভঙ্গিতে বললেন, এখনো যাও নি?
আমি বিনয়ে গলে গিয়ে বললাম, স্যার, এখনি যাচ্ছি। একটা ছোট্ট জিজ্ঞাসা ছিল। অতি ছোট জিজ্ঞাসা। ধূলিকণার মতো ছোট।
ওসি সাহেব ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। আমি বললাম, আপনার আসামি তূর্য বিষয়ে একটা কথা।
ভনিতা রাখ। কী বলবে বলো।
আমি বললাম, তূর্যের সঙ্গে মিল দিয়ে হয় সূর্য। স্যার, আর কিছু কি হয়?
ওসি সাহেবের মুখে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই হতাশার ছায়া পড়ল। বোঝা যাচ্ছে তাঁর মস্তিষ্ক মিল খুঁজতে শুরু করেছে। অন্তমিলযুক্ত আরেকটা শব্দ মনে না আসা পর্যন্ত অনুসন্ধান চলতেই থাকবে। এই বিষয়টা সবার ক্ষেত্রে ঘটে না। কাজেকর্মে এবং চিন্তাভাবনায় জর্জরিত মানুষের ক্ষেত্রে ঘটে। প্রবল চাপে পর্যুদস্ত মানুষের ক্ষেত্রে ঘটে। মস্তিষ্ক চাপ থেকে মুক্তি পাআব্র জন্যে সহজ পথ খোঁজে। অন্তমিলের অনুসন্ধান মস্তিষ্কের জন্যে সহজ মুক্তির পথ।
স্যার, আপনার অফিসের টেলিফোনটা একটু ব্যবহার করতে পারি?
ওসি সাহেব থমথমে মুখে টেলিফোন এগিয়ে দিলেন। আমি খালু সাহেবকে টেলিফোন করলাম।
আমি বললাম, হ্যালো, ধানমণ্ডি থানা থেকে বলছি।
খালু সাহেব হড়বড় করে বললেন, গাড়ি কি পাওয়া গেছে?
খালু সাহেব, আমি হিমু।
তুমি! তুমি থানায় কী করছ?
ওসি সাহেবকে দাওয়াত দিতে এসেছি। বিয়ের দাওয়াত। খালু সাহেব, গাড়ির কোনো খোঁজ পাওয়া যায় নি?
ইয়ারকি বন্ধ করো। ইডিয়ট।
খালু সাহেব টেলিফোন রেখে দিলেন। ওসি সাহেব শূন্যদৃষ্টিতে তাঁর সামনে দেয়ালে ঝুলানো ক্যালেণ্ডারের দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি বললাম, স্যার যাই?
ওসি সাহেব বললেন, তূর্য এবং সূর্য ছাড়া আর কিছু তো পাচ্ছি না।
চেষ্টা করতে থাকুন। পেয়ে যাবেন।
‘কর্জ’ কি চলবে?
কর্জ চলবে না। উকার লাগবে। কুর্জ চলত। কুর্জ বলে শব্দ নেই।
হিমু শোন, আর কোনোদিন যেন তোমাকে থানায় না দেখি।
পারুল আপা কেমন আছে স্যার?
সে ভালো আছে।
উনার রান্না করা হাঁসের মাংস এবং খিচুড়ির স্বাদ এখনো মুখে লেগে আছে।
ওসি সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, তোমার মতলব আমার কাছে পরিষ্কার। পারুলের কথা বলে আমার মন ভুলাবার চেষ্টা করছ। কাজ হবে না।
পারুল আপাকে বিয়ের দাওয়াত দেয়ার শখ ছিল।
সে ঢাকায় নেই। সে মুন্সিগঞ্জে তার মায়ের বাড়িতে গেছে।
আমার কাছে গাড়ি আছে। আপনি ঠিকানাটা দিন। একটানে চলে যাব।
তুমি বিদেয় হও। বিদায়।
বিয়ের শাড়ি কিনতে যাব। পারুল আপার মতামতটা পেলে ভালো হতো। এইসব বিষয় মেয়েরা ভালো বোঝে। শুনেছি এখনকার ফ্যাশন বিয়েতে লালশাড়ি না পরা। বিধবা হলে কিংবা স্বামী তালাক দিলেই শুধু লাল শাড়ি।
তুমি যাবে, না বকবক করতেই থাকবে?
বিয়ের শাড়ি হিসেবে সবুজ রঙটা কি আপনার পছন্দ?
আমার ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙেছে, এখন কিন্তু থাপ্পর খাবে।
থাপ্পর খাবার আগেই গাড়িতে উঠলাম। গাড়ি চলছে মিরপুরের দিকে। বিয়ের শাড়ি কেনা হবে। মকবুলের ভাইকে পাওয়া গেলে হয়। আমার হাতে আছে একশ’ পঁচিশ টাকা। এই টাকায় কাদের সিদ্দিকীর গামছা হবে, শাড়ি হবে না।
গাড়ির সিটে মাথা দিয়ে চোখ বন্ধ করতেই গুরুদেবের দেখা পেলাম। তিনি বললেন, বিয়ের শাড়ি সবুজ না হওয়া বাঞ্ছনীয়।
আমি বললাম, সবুজ না কেন?
সবুজ রঙটার বিষয়ে আমার আপত্তি আছে।
সবুজ নিয়ে আপনার এত মাতামাতি, আবার সবুজ রঙ নিয়েই আপত্তি। কারণটা কি বলবেন?
রবীন্দ্রনাথ বিরক্ত গলায় বললেন, আমি যে কালার ব্লাইন্ড এই তথ্য তো জানো। এই নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে, না জানার কথা না। সবুজ রঙ আমি চোখেই কোনোদিন দেখি নি।
খাইছে আমারে।
আমার সামনে এ ধরনের অশালীন ভাষা প্রয়োগ করবে না।
‘খাইছে আমারে’র বললে ‘আমাকে ভক্ষণ করেছে’ কি বলা যাবে?
তুমি কথ্য ভাষায় কথা বলছ, এর মধ্যে হঠাৎ ‘ভক্ষণের’ মতো একটা তৎসম শব্দ ব্যবহার কেন করবে? ভাষার জগাখিচুড়ি আমার পছন্দ না।
জগাখিচুড়ি জিনিসটা কি স্যা? খিচুড়ি জানি। কিন্তু জগাখিচুড়ি?
রবীন্দ্রনাথ চশমা ঠিক করতে করতে বললেন, জগন্নাথের মন্দিরে রোজ নানান পদ মিলিয়ে খিচুড়ি রান্না হতো। সেখান থেকে এসেছে জগাখিচুড়ি।
স্যার, আপনাকে কিন্তু আমার বিয়েতে বরযাত্রী হিসেবে যেতে হবে। এবং উপহার হিসেবে চার লাইনের কবিতা। মেয়ের নাম রেনু। রেনুর সঙ্গে মিলিয়ে চারটা লাইন।
রবীন্দ্রনাথ বিড়বিড় করে বললেন—
ওরে রেনু, ওরে আমার রেনু
একা বসে বাজাস কেন বেবু?
ওরে আমার রেনুতে কিছু আপত্তি আছে। শুনলে মনে হয়, সে আপনার রেনু। আপনি যদি বলতেন—
ওরে রেনু, ওরে হিমুর রেনু
একা একা কেন চরাস ধেনু?
তাহলে কেমন হয়?
রবীন্দ্রনাথ ভুরু কুঁচকে বললেন, মেয়েমানুষ ধেনু চরাবে কেন?
আপনার সময়ের মেয়েমানুষ আর এখনকার মেয়েমানুষে রাজ্যের ফারাক। আজকালকার মেয়েরা অনেক কিছুই চড়াচ্ছে। ধেনু সেই তুলনায় কিছুই না।
রবীন্দ্রনাথ গম্ভীর গলায় বললেন, সময় বদলাচ্ছে এটা ঠিক। তারপরেও মেয়েরা ধেনু চরাচ্ছে দৃশ্যকল্পনা নিতে পারছি না।
আমি বললাম, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আপনার গানও বদলেছে। এখন আপনার গানে ঢুকেছে র্যাপ।
সেটা কী?
আপনার গান হবে, ফাঁকে অন্য একজন কিছু অর্থহীন কথা কবিয়ার মতো বলে যেতে থাকবে। যেমন ধরুন আপনার বৃষ্টির গান—
আজ ঝরঝর মুখর বাদল দিনে
জানিনে জানিনে মন
কিছুতে কেন যে মন লাগে না।
এই কয়েক লাইন গাওয়া শেষ হওয়া মাত্র একজন বলবে—
আজ বৃষ্টি। লাগবে খিচুড়ি।
সঙ্গে ইলিশ। এক পিস বেগুন
ভাজা। খেতে মজা খেতে মজা।
আজ বৃষ্টি। ঝরঝর বাদল দিন।
চুপ করো।
জি স্যার। চুপ করলাম।
অন্য কোনো প্রসঙ্গে কথা বলো। আমার গান প্রসঙ্গে তোমার কথা শুনে চিত্ত বিকল হয়েছে।
বিয়ের শাড়ি প্রসঙ্গে ফিরে যাই। হলুদ শাড়ি কি কিনব? আমার দুই বন্ধু হলুদের কথা বলছিলেন।
হলুদ বৈরাগ্যের রঙ।
ব্যাচেলর জীবনে প্রবল বৈরাগ্যের কারণেই বিবাহিত জীবনে সেই অর্থে হলুদ চলে না।
চলতে পারে। তবে…
আর তবে টবে না। রঙ নিয়ে আমি বিরাট ঝামেলায় পড়েছি। দু’জন হলুদে ভোট দিয়েছে, আপনি ভোট দিলেই তিন। কণ্ঠ ভোটে সংসদে পাশ। কণ্ঠ ভোট দিতে না চাইলে আপনি হাত তুলেও ভোট দিতে পারেন।
এই পর্যায়ে ঝাঁকুনি খেয়ে গাড়ি থামল। আমি জেগে উঠে দেখি, গাড়ি মিরপুরের বেনারসি পল্লীতে থেমেছে।
আজ হিমুর বিয়ে – পর্ব ৫
সময় দুপুর দু’টা।
খালু সাহেবের সাধের গাড়ি তাঁর নিজের বাড়ির গ্যারেজে। ড্রাইভার মকবুলকে হোটেলে পাঠিয়ে দিয়েছি—দুপুরের খাওয়া খেয়ে আসুক। আবার গাড়ি নিয়ে বের হতে হবে।
খালুসাহেব দুপুরে বাসায় খেতে আসেন। আজ মনে হয় আসবেন না। অফিসে বসে চুরি যাওয়া গাড়ির অনুসন্ধান চালাবেন। যদি চলেও আসেন ক্ষতি কিছু নেই। ঘরে ফিরে দেখবেন ঘরের ছেলে ঘরে ফিরেছে। বিদেশীদের কাছে গাড়ী স্ত্রীসম। বাংলাদেশীদের কাছে গাড়ি পুত্রসম। গাড়িপুত্রের মুখ দেখে আনন্দে উদ্বাহু হবেন। সেই আনন্দ দেখার মধ্যেও মজা আছে।
মাজেদা খালা আমাকে দেখে উৎফুল্ল গলায় বললেন, তোকে দেখেই মনে হচ্ছে বিয়ের ফুল ফুটেছে। চেহারা সুন্দর হয়ে গেছে। রোদেপোড়া ভাব খানিকটা দূর হয়েছে।
আমি বললাম, আজ সারাদিন এসি গাড়িতে ঘুরেছি। রোদে শরীর পোড়াপার সুযোগ হয় নি।
গাড়ি কোথায় পেয়েছিস?
একদিনের জন্যে জোগাড় করেছি।
মাজেদা খালা আনন্দিত গলায় বললেন, তোর খালু সাহেবের গাড়িটাও পাওয়া গেছে। বেচারা কী যে খুশি হয়েছে! আমাকে গাড়ি পাওয়ার খবর দিতে দিয়ে আনন্দে কেঁদে ফেলেছিল।
আমি হতভম্ব গলায় বললাম, গাড়ি কোথায় পাওয়া গেল?
নারায়ণগঞ্জে। নারায়ণগঞ্জের ওসি সাহেব টেলিফোন করে জানালে। তোর খালু নারায়ণগঞ্জ গাড়ি আনতে গেছে। বাংলাদেশের গাড়ি চোররা কত বড় Expert শোন—অল্প কয়েক ঘণ্টা পার হয়েছে, এর মধ্যেই গাড়ির নাম্বার প্লেট টেট সব পাল্টে ফেলেছে।
পুলিশও কম Expert না। অল্প সময়ে গাড়ি উদ্ধার। ওদেরকেও ধন্যবাদ দিতে হয়।
অবশ্যই। তুই বাথরুমে ঢোক। সাবান ডলে হেভি গোসল দিবি। তারপর রেনুকে নিয়ে খেতে বসবি। আমি তখন সামনে থাকব না। ইটিস পিটিস আলাপ করতে চাইলে করবি। বিয়ের আগে হালকা আলাপ থাকা ভালো।
রেনু এখন করছে কী?
ঘুমাচ্ছে।
অসময়ে ঘুমাচ্ছে?
অনেকের টেনশনে ঘুম বেড়ে যায়। আমার নিজেরই বাড়ে। বিয়ের দিন আমার এত টেনশন ছিল! সারাদিন ঘুমিয়েছি। উকিল বাবা যখন কবুল নিতে এলেন তখনো আমি ঘুমাচ্ছি। আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলতে হলো।
খালা, তোমাকে এত খুশি খুশি লাগছে কেন? রহস্য কী?
যে-কোনো মেয়ের বিয়ের দিন বিবাহিত মেয়েদের মন খুশি খুশি থাকে। নিজের বিয়ের দিনের কথা মনে পড়ে এই জন্যে। আর কথা বলতে পারব না। বাথরুম ঢুকে যা। তোর জন্যে আলাদা করে কাঁচা হলুদ বেটে রেখেছি। সারা শরীরে ডলে মাখবি।
আচ্ছা।
না-কি আমি মেখে দেব?
তুমি মেখে দেবে কেন?
মা-খালারাই তো ছেলের গায়ে হলুদ মাখায়। তোর তো ত্রিভুবনে কেউ নেই। একটা এতিমেরও তো অমুক আত্মীয় তমুক আত্মীয় থাকে। তোর তো তাও নেই।
তুমি তো আছ?
আমি তো আপন কেউ? আমি অনেক দূরের। কথায় আছে না?—
‘আমার ক্ষেতে বিয়াইছে গাই
সেই সূত্রে মামাতো ভাই।’
আমি বাথরুমে ঢুকলাম, খালাও হলুদের বাটি নিয়ে ঢুকলেন। আমি নিজেকে আবেগশূন্য মানুষ হিসেবেই জানতাম। মহাপুরুষ ওয়ার্কশপে যারা অংশগ্রহণ করে তাদের আবেগশূন্য হতে হয়। ওয়ার্কশপের একমাত্র ইনস্ট্রাকটার আমার বাবা বলতেন—
আবেগ হচ্ছে বিষ্ঠা। এই বিষ্ঠা শরীরে রাখতে নেই। শরীর থেকে বের করে দিতে হয়। মহান স্রষ্টা আবেগশূন্য। এত বড় সৃষ্টি আবেগ দিয়ে করা সম্ভব না। সৃষ্টি হয়েছে লজিকে। সৃষ্টিতে আবেগের স্থান নেই। অন্যের আগেব বুঝতে হলে নিজেকে আবেগশূন্য হতে হবে।
খালা বললেন, কি রে কাঁদছিল কেন? চোখে পানি কেন?
আমি বললাম, মহাপুরুষ ট্রেইনিং-এ ফেল করেছি বলে চোখে অশ্রু।
হেঁয়ালি করে কথা বলবি না। কী সমস্যা বল।
তোমার আদরটাই সমস্যা। এত আদর এত মমতা দিয়ে কেউ আমার গায়ে হাত দেয় নি।
খালা বললেন, আয় তোর কপালে একটা চুমু দিয়ে দেই।
আমি মাথা এগিয়ে দিলাম। ভাগ্যিস এই দৃশ্য আমার বাবা দেখছেন না। দেখতে পেলে তিনি শিউরে উঠতেন। তাঁর মতে আবগ কদর্য। আবেগের প্রকাশ আরো কদর্য। তাঁর মতে বিষ্ঠা যখন শরীরের ভেতরে থাকে, দেখা যায় না, তখন তাকে অগ্রাহ্য করা যায়। কিন্তু বিষ্ঠা প্রকাশিত হলে সহ্য করা যায় না। প্রকাশিত বিষ্ঠা তার দূষিত গন্ধে জগৎ নষ্ট করে।