পচা বাবার সঙ্গে দেখা হলো। বয়স নব্বুইয়ের কাছাকাছি। ত্রিমাথার বুড়ো। দুই হাঁটুর মাঝখানে মাথা গুঁজে বসে আছে। দুশ’ টাকায় দুই পুরিয়া দিল। ফোকলা দাঁএ হাসতে হাসতে বলল, আসল জিনিস। খাইয়া মজা পাইবেন। খাইতেই থাকবেন খাইতেই থাকবেন—মজার উপরে মজা।
আমি বললাম, এত মজার জিনিস! আপনি কখনো খেয়েছেন?
বুড়ো কাশতে কাশতে বলল, না গো বাবা। আমি খাই নাই। আমি আসল মজার জন্যে অপেক্ষায় আছি।
আসল মজাটা কী?
আসল মজা হইল মরণ। মরণের উপরে কোনো মজা নাই।
মরণ খুবই মজা?
অবশ্যই।
মরতে ইচ্ছা করে?
বৃদ্ধ দীর্ঘসময় চুপ করে থেকে বলল, না।
না কেন?
আসল মজা যত পরে আসে তত ভালো। আপনের পরিচয় কী?
যে আপনার কাছে পুরিয়া কিনতে আসে তার পরিচয় জানতে ইচ্ছা করে?
না।
তাহলে আমার পরিচয় জানতে চান কেন?
তুমি মেলা বাকোয়াজ করতেছ এই জন্যে। তোমার নাম কী?
হিমু।
এটা তো মেয়েছেলের নাম।
হতে পারে। মেয়েছেরাও কি আপনার কাছে পুরিয়া নিতে আসে?
আসে। কম আসে। মেয়েছেলেরা এই জিনিস কম খায়। তারা স্বামী-পুত্রের জন্য পুরিয়া কিনে। তুমি কি সংবাদের লোক?
সংবাদের লোক ভয় পান?
না। বৃদ্ধ বয়সে মানুষের আক্কেল কমে, জ্ঞান কমে, চউখের দৃষ্টি কমে, তার সাথে ভয়ও কমে। আমি কাউর ভয় পাই না।
একটু আগে বললেন, মেয়েছেলেরা স্বামী-পুত্রের জন্যে পুরিয়া কিনে। কেন এই কাজটা করে?
না কইরা উপায় আছে? নিশা যখন উঠে তখন স্বামী-পুত্র ছটফট করে, শরীর যায় ফুইল্যা, মুখ দিয়া ফেনা ভাঙে। এই কষ্ট দেখনের চেয়ে পুরিয়া কিন্যা দেওন ভালো।
আপনার ছেলেমেয়ে কী?
মেয়ে নাই, তিন ছেলে। তিনটাই হিরুচি।
হিরুচি কী?
যারা হিরুইন খায় তারারে বলে হিরুচি।
আপনার তিনপুত্রই হিরুচি?
জি। তারার মৃত্যুও ঘনায়া আসছে। তিনটাই ঘরে শুইয়া আছে। ছবি তুলবেন? আপনে যদি পত্রিকার লোক হন, ছবি তুলেন। ছাপায়া দেন।
ছবি ছাপিয়ে লাভ কী?
লাভ লোকসান আপনেরা বুঝবেন। আমার তিন হিরুচি পুলা আছে। সারাদিন তিন ভাই পুটলা পাকায়া শুইয়া থাকে। ছবি তুলনের এমন জিনিস পাইবেন না। সক্কালে তিনটা তিন পুরিয়া খাইছে। সইন্ধ্যা কালে আবার খাইব। যান ছবি তুইল্যা আনেন। আমি ছবি তুলতে গেলাম। মাজেদা খালার দেয়া মোবাইল টেলিফোনে ছবিও উঠে। নোংরা দুর্গন্ধ ঘর। প্রস্রাবের বিকট গন্ধ। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভাত পচার মিষ্টি গন্ধ। টিনের ছাপড়া। একটা জানালা আছে। জানালা বন্ধ। মেঝেতে চাটাই বিছানা। চাটাইয়ের দু’জন ঘুমাচ্ছে। প্রস্রাবের গন্ধ এদের গা থেকেই আসছে। দু’জনের মুখই হা হয়ে আছে। হা করা মুখের সামনে মাছি ভনভন করতে অনেক দেখেছি। এখানে বিচিত্র দৃশ্য দেখলাম—মাছি মুখের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে এবং বের হচ্ছে। জীবন্ত মানুষের হা করা মুখে মশা-মাছি কখনো ঢুকে না। মৃত মানুষদের মুখে ঢুকে। হিরোইনের ঘুমে ঘুমন্ত মানুষকে মশা-মাছি মৃত মনে করছে এটা বিস্ময়কর ঘটনা। হিরোইনসেবীরা কি এই তথ্য জানে?
তিন ভাইয়ের একভাই দেয়ালে হেলান দিয়ে বসা। সে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি ছবি তুলছি, সে দেখছে কিন্তু কোনো প্রশ্ন করছে না। আমি বললাম, ভালো আছেন? সে হ্যাঁ-সূচক মাহা নাড়ল।
আপনার নাম কী?
সে ঠোঁট নাড়ল। কী বলল বোঝা গেল না।
আপনি বিবাহ করেছেন?
সে আবারো হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।
ছেলেমেয়ে আছে?
সে দুই আঙুল তুলে দেখাল। দু’জন আছে এটা বুঝতে পারছি। ছেলে না মেয়ে বোঝা যাচ্ছে না।
ছেলেমেয়েরা কোথায়?
একই প্রশ্নের উত্তরে সে স্পষ্ট করে বলল, চইল্যা গেছে। বলেই শুয়ে পড়ল। পারকিনসন্স ডিজিজের রোগীর যেভাবে হাত কাঁপে সেইবাহবে তার হাত কাঁপছে। এই কাঁপুনি ছড়িয়ে পড়ছে তার শরীরে। একসময় অবাক হয়ে দেখলাম, তার পুরো শরীরই কাঁপছে। বিশেষ ছন্দে কাঁপছে। সে এখনো তাকিয়ে আছে আমার দিকে। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। কিন্তু কিছু দেখছে বলে মনে হচ্ছে না। তার দৃষ্টি মৃত মানুষের দৃষ্টি।
মকবুল বলল, স্যার অবস্থা তো কেরোসিন।
আমি বললাম, কেরোসিনের চেয়েও খারাপ অবস্থা, ‘ডিজেল’।
মকবুল বলল, এইসব জিনিস ঘরবাড়িতে খাওয়া ঠিক না। ভাল জায়গায় খাইতে হয়।
ভালো জায়গা কোনটা?
সাভারের স্মৃতিসৌধ, তারপর ধরেন রায়েরবাজারের বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ। দুইটার মধ্যে রায়েরবাজারেরটা ভালো। পিছনে নদী আছে। নদীর দিকে তাকায়া হিরুচিরা মজা পায়।
কেউ কিছু বলে না?
কে বলব? কেউ কিছু বলে না। রায়েরবাজারে একজন আছে মিনা রানী। উনার জিনিসও ভালো। ফেন্সির এক নম্বরটা উনার কাছে পাওয়া যাবে।
এই বিষয়ে তোমার জ্ঞান তো ভালো।
প্রশংসায় মকবুল লজ্জা পেয়ে গেল। গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে বলল, এখন যাব কোন দিকে?
রায়েরবাজারের বধ্যভূমির দিকে গেলে কেমন হয়? কোনোদিন দেখা হয় নাই। হাতে যখন একটা গাড়ি আছে।
বিয়ার বাজার সদাই করবে না?
গরিবের বিয়ের আবার বাজার! সুযোগ যখন পাওয়া গেছে বধ্যভূমিটা দেখে যাই।স্মৃতিসৌধ দেখে মুগ্ধ হওয়া ঠিক না। মুগ্ধ হবার মানে যাদের স্মৃতিতে সৌধ তারা গৌণ, সৌধটা মুখ্য। তারপরেও মুগ্ধ হতে হলো। বড় একটা দেয়াল। দেয়ালের এক অংশে জানালার মতো কাটা। সেই জানালায় আকাশ দেখা যাচ্ছে।
সৌধ ধূলামলিন, চারদিকে আবর্জনা, কিন্তু জানালার বাইরের আকাশ ঝকঝক করছে। এই আকাশ স্মৃতিসৌধেরই অংশ।
সৌধের ভেতরই হিরুচির দেখা পাওয়া গেল। তাদের নোংরা, কাপড়-চোপড় নোংরা, কিন্তু তাদের চোখ স্মৃতিসৌধের জানালার মতো ঝকঝক করছে।
আপনারা ভালো আছে?—বলে তাদের দিকে এগিয়ে গেলাম। দু’জনই নড়েচড়ে বসল, প্রশ্নের জবাব দিল না। মকবুল আমার সঙ্গে সঙ্গে আসছে। সে বলল, স্যার এরার সাথে কথা বইল্যা কোনো ফায়দা নাই। চলেন মিরপুরের দিকে যাই।
মিরপুরে কী?
বেনারসী শাড়ির কারখানা। বউ-এর জন্যে একটা শাড়ি কিনবেন না? আমার এক ভাই আছে কারিগর। সস্তায় কিনায়া দেব।
দুই হিরুচির সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করে তারপর যাই। শাড়ি কী ধরনের হবে এই বিষয়ে এদের সঙ্গে কথা বলি।
বাদ দেন তো স্যা। এরার সাথে ছুরি চাক্কু থাকে। কখন কী করে নাই ঠিক।
হিরুচি দু’জনকে তেমন ভয়ঙ্কর মনে হলো না। একজন তার পরিচয় দিল—সামছু। ঠেলাগাড়ি চালায়। অন্যজন পরিচয় দিল না। সারাক্ষণই মাথা নিচু করে রাখল।
সামছু ভাই, এই জায়গাটা কি জান্নে?
জানব না কেন? শহীদ বুদ্ধিজীবীর মাজার শরীফ।
বুদ্ধিজীবী কি জানেন?
সামছু উদাস গলায় বলল, জানি। আপনাদের মতো ভদ্দরলোক। ভালো কাপড় পরে। চোখে চশমা দেয়, গাড়িতে কইরা ঘুরে। সুন্দর সুন্দর কথা বলে।
আমি বললাম, আজ আমার বিয়ে। শাড়ি কিনতে যাচ্ছি। কী রঙের সাড়ি কিনব বলুন তো?
মেয়ের গায়ের রঙ কী?
শঙ্খের মত শাদা।
হিরুচি সামছু অনেক ভেবে চিন্তে বলল, হইলদা শাড়ি কিনেন। শাদার সাথে হইলদা। অপর হিরুচিও সঙ্গে সঙ্গে মাথা নাড়ল। নেশাখোররা কোনো ইস্যুতে সহজে দ্বিমত পোষণ করে না।
আজ হিমুর বিয়ে – পর্ব ৪
ড্রাইভার মকবুল বলল, অনেক ঘুরা ফিরা করছেন, চলেন শাড়িটা কিনি। মিরপুরে যাই।
শাড়ি কেনার টাকা তো নাই। পাঁচশ’ টাকা পেয়েছিলাম। দেড়শ’ খরচ হয়ে গেছে। তিনশ’ আছে। এতে কি চলবে?
বললাম না আমার ভাই আছে। বাকিতে কিনায়া দেব।
আমি বললাম, আগে থানায় চল।
থানা! থানায় যাবেন কেন?
জরুরি কাজ আছে।
কোন থানা?
মকবুলের কথায় চিন্তায় পড়ে গেলাম। রেনুর প্রেমিক কোন থানায় আছে তা জানা নেই। মাজেদা খালার বাড়ি যে থানায় সেখানকার হাজতেই তার থাকার কথা। অনেক সময় উলটপালটও হয়। পুলিশের উপরের লেভেলের নির্দেশে যখন কাউকে ধরা হয় তখন আর এলাকার ভাগ থাকে না।
চল ধানমণ্ডি থানায়। তারপর অন্য থানাগুলিতে যাব। আজ ধারাবাহিক ধানা পরিক্রমা।
থানায় আপনের ঘটনা কী?
ওসি সাহেবকে বিয়ের দাওয়াত দেব।
সত্যই দাওয়াত দিবেন?
হুঁ। অনেকবার থানা হাজতে কাটিয়েছি। বেশিরভাগ ওসি সাহেবের সাথে পরিচয় আছে। তারা আমার দুঃখ দিনের সাথী।
মকবুল নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আপনার কাজ কাম বড়ই জটিল। আত্মীয়স্বজনের খোঁজ নাই—ওসি সাবেহরা দাওয়াতি।
গাড়ি ট্রাফিক জ্যামে আটকা পড়েছে। জ্যামের বাজার শুরু হয়েছে। ফেরিওয়ালারা এক গাড়ির জানালা থেকে আরেক গাড়ির জানালায় যাচ্ছে। তাদের কারণে ভিক্ষুকরা সুযোগ পাচ্ছে না। কনুইয়ে গুঁতো দিয়ে তারা ভিক্ষুক সরাচ্ছে। কেউ হাতে দু’টা পাকা পেঁপে নিয়ে ঘুরছে, কেউ কানকোয় দড়ি বাঁধা কাতল মাছ নিয়ে ঘুরছে। পপকর্নের প্যাকেট নিয়ে বেশ কয়েকজন আছে, এই আইটেমটা মনে হয় চালু। এতকিছু থাকতে হঠাৎ পপকর্ন চালু আইটেম হয়ে গেল কেন কে বলবে! ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরিও আছে। দশ-বারোটা পেপারব্যাক বই নিয়ে কয়েকজন ঘরছে। হ্যারি পটার, জেনারেল মোশারফের আত্মজীবনী। বিক্রিও হচ্ছে।
গাড়ির ভেতর আরামদায়ক শীতলতা। বাইরে তেজি রোদ। সেই রোদ আমাকে স্পর্শ করছে না। রোদের দিকে তাকিয়ে ঘুমিয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে। সারা শরীরে আরাম আরাম ভাব। আরাম ব্যাপারটা কী—ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন। বটগাছের নিচে শান্তিনিকেতনি কায়দায় ক্লাস হচ্ছে। ক্লাসে নিচ্ছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। একজন তাঁর মাথায় ছাতা ধরে আছে। ছত্রধর খুব পরিচিত, কিন্তু কে ধরতে পারছি না। রবীন্দ্রনাথের হাতে এক ঠোঙা পপকর্ন। তিনি পপকর্ন চিবুতে চিবুতে ‘আরাম কী?’ ত্র ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। তিনি বলছেন—
আরাম দুই প্রকার—শারীরিক এবং মানসিক। এই যে আমি পপকর্ন খেয়ে মজা পাচ্ছি এটা শারীরিক আরাম। আবার পপকর্নগুলি দেখতে বোঁটাহীন শিউলীফুলের মতো। এক ঠোঙা ফুল দেকেহ যে আরামটা পাচ্ছি এটা মানসিক।
শরীরের প্রয়োজন মেটার ফলে যে আরাম হয় সেটা শারীতরিক আরাম, আবার মনের প্রয়োজন মেটার ফলে যে আরাম হয় তা মানসিক আরাম।
আরামের যে অন্য অর্থ আছে তা কি তোমরা জানো? আরামের অর্থ বাগান। আবার উপবনও হতে পারে। আমার কথা বিশ্বাস না করলে তোমরা ডিকশনারি দেখতে পার।
এখন তোমরা বলো, সংঘারাম মানে কী? সংঘারাম একটি সমাসবদ্ধ পদ। ব্যাস বাক্য কী?
ছত্রধারী বললেন, গুরুদেব, আপনি তো ব্যাকরণের ক্লাস নিচ্ছেন না। আপনার কাছ থেকে ছাত্ররা অন্যকিছু জানতে চায়।
রবীন্দ্রনাথ সঙ্গে সঙ্গে বললেন, তাই তো! তাই তো! আচ্ছা আরামের সঙ্গে মিল দিয়ে শব্দ লিখতে থাক। এতে অন্তমিলের বিষয়টা সড়গড় হবে।
আরাম
হারামআমি এই দুটা বললাম, বাকিগুলি তোমরা বের কর। তাড়াতাড়ি।
এই সময় ঘুম ভাঙল। গাড়ি থানা কম্পাউণ্ডে ঢুকেছে। থানার সেণ্ট্রি সরু চোখে তাকাচ্ছে। এত বড় গাড়িতে কে এসেছে আঁচ করার চেষ্টা। সেই অনুযায়ী ঠিক করবে স্যালুট দেবে কি দেবে না।
সিভিলিয়ানদের নিয়ে এই সমস্যা। কে বিশিষ্টজন কে বিশিষ্টজন না এইসব গায়ে লেখা থাকে না। তাদের কোনো আলাদা পোশাকও নেই। ভবিষ্যতের মানুষদের এরকম ব্যবস্থা থাকবে বলে মনে হয়। সবাইকে শরীরে ব্যাজ পরতে হবে। সেই ব্যাজ বলে দেবে লোকটির পেশা কী, ব্যাংকে তার কত টাকা আছে, বিবাহিত কি-না, রক্তের গ্রুপ, বয়স ইত্যাদি।
ওসি সাহেব আআর পরিচিত। নাম সুলেমান। তাঁর সময়ে আমি একবার দু’রাত হাজতে ছিলাম। শেষটায় ভালো খাতির হয়ে গিয়েছিল। তাঁর স্ত্রীর রান্না হাঁসের মাংস এবং ভুনাখিচুড়ি টিফিন কেরিয়ারে রান্না করে খাইয়েছিলেন। ভদ্রমহিলার নাম পারুল। তিনি আমাকে দেখেই ভ্রু কুঁচকে গম্ভীর হয়ে গেলেন। আমি অতি বিনয়ের সঙ্গে বললাম, স্যার, কেমন আছেন?
ওসি সাহেব বললেন, কী চাও?
একটা বিশেষ প্রয়োজনে এসেছিলাম স্যার।
কী প্রয়োজন বলে বিদায় হও। নানান ঝামেলায় আছি। তোমার সঙ্গে কথার খেলা খেলতে পারব না। কী বলতে এসেছ স্ট্রেইট বলো। নো হাংকি পাংকি।
আমি বললাম, আরামের সঙ্গে মিল হয়ে এরকম কয়েকটা শব্দ দরকার। আমি একটা পেয়েছি—হারাম। আর পাচ্ছি না।
ওসি সাহেবের চেহারা থেকে বিরক্ত ভাব দূর হয়ে চিন্তিত ভাব চলে এলো। তাঁর মস্তিষ্ক এখন আরামের সঙ্গে মিল আছে এমন শব্দ খুঁজে বেড়াচ্ছে। ওসি সাহেব চাচ্ছেন না, কিন্তু মস্তিষ্ক তার কাজ করেই যাচ্ছে। নিজের মস্তিষ্কের উপর মানুষের যে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেই তা মানুষ জানে, কিন্তু স্বীকার করে না।
ওসি সাহেব বললেন, হিমু বোস। চা খাবে?
খাব।
ওসি সাহেব চোখের ইশারায় চা দিতে বললেন। চোখের ইশারায় এমন ব্যবহার আগে দেখি নি।
ওসি সাহেব বললেন, আরামের সঙ্গে হারাম ছাড়া তো আর কিছু পাচ্ছি না।
আরো অনেক আছে। বাংলা ভাষা সহজ জিনিস না। বিশাল সমুদ্র।
তুমি থানায় এসেছ কেন সেটা বলো। আরাম হারাম নিয়ে যে আস নি এটা জানি।
আপনারা কি কোনো অল্পবয়সি ছেলেকে আজ ধরে এনেছেন?
অল্পবয়সি ছেলেপুলে তো আমরা সবসময় ধরে আনি।
যে ছেলের কথা বলছি সে তেমন কোনো অপরাধ করে নি। তার অপরাধ সে তার প্রেমিকার বাড়ির সামনে বসে ছিল।
বুঝেছি। তূর্য। তোমার কে হয়?
আমার কেউ হয় না।
কেউ না হওয়াই ভালো। মেরে হাড্ডি গুঁড়া করা হয়েছে।
উপরের নির্দেশ ছিল?
হ্যাঁ ছিল। উপরের নির্দেশে এক দফা মারা হয়েছে, তারপর নিজের দোষে আরেক দফা মার খেয়েছে হাজতে। হাজতে কী করছে?
হিরোইন নেয়ার টাইম হয়ে গেছে। সঙ্গে নাই জিনিস। আধাপাগল হয়ে গেছে। পুরিয়ার জন্যে সবার হাতেপায়ে ধরছে। কী যে অবস্থা! শরীর গেছে ফুলে। পেশাব করে কাপড় নষ্ট করেছে। দুর্গন্ধে কাছে যাওয়া যায় না।
সে কার ছেলে জানেন?
কার ছেলে?
বাবার আইডেনটিটি ডিসক্লোজ করা যাবে না। সমস্যা আছে। শুনলে আপনি খাবি খাবেন।
তুমি ধানাইপানাই গল্প ছাড়। তোমার ধানাইপানাই স্টোরির সঙ্গে আমি পরিচিত। ছেলের বিষয়ে খোঁজ নিয়েছি। স্কুল মাস্টারের ছেলে। বাবা-মা অল্প বয়সে মারা গেছেন, চাচার কাছে মানুষ হয়েছে। মানুষ তো না, অমানুষ হয়েছে। তুমি তার সঙ্গে দেখা করতে চাচ্ছ দেখা করো। হাংকি পাংকি করার দরকার নেই। তোমাকে থানায় ঢুকতে দেয়াই উচিত হয় নি। তুমি আমার মাথার ভেতর আরাম হারাম ঢুকিয়েছ। এখন সব ফেলে মিলের শব্দ চিন্তা করছি। আমার তো ধারণা এই দু’টা ছাড়া নেই।
অবশ্যই আছে।
থাকলে বলো, মাথার ভনভানানি দূর হোক।
আমি বললাম, আরাম
হারাম
গেরাম
ব্যারাম
ক্যারাম
ওসি সাহেব বললেন, আর কি আছে?
অবশ্যই আছে। আপনি চিন্তা করতে থাকুন, আমি এই ফাঁকে তূর্যের সঙ্গে কথা বলে আসি।