পার্কিং লটে খালু সাহেবের ড্রাইভার মকবুল পালকের ঝাড়ন দিয়ে গাড়ি ঝাড়পোছ করছে। প্রোডো নামের এই জিপ গাড়ি খালু সাহেব নতুন কিনেছেন। ড্রাইভার মকবুলের দায়িত্ব দিনের মধ্যে বেশ কয়েকবার পালকের ঝাড়ন দিয়ে গাড়ি ঝাড়পোছ করা। কাজটা সে আনন্দের সঙ্গেই করে। আমি আড়াল থেকে শুনেছি, ঝাড়পোছ করতে করতে সে গাড়ির সঙ্গে কথাও বলে। যেমন—কিরে আজ তোর শরীরের অবস্থা কী? আজ সাভার যেতে হবে। শরীরের উপর ধকল যাবে। আগেভাগে বলে দিলাম।
আমি মকবুলের দিকে তাকিয়ে বললাম, গাড়ি বের করো তো।
ভাইজান! স্যার কি বের হবেন?
আমি বললাম, স্যার বের হবেন না, আমি বের হবো। তেল আছে তো?
তেল পুরা টেঙ্কি আছে।
ভালো হয়েছে, খালু সাহেব সারাদিনের জন্যে এই গাড়ি আমাকে ধার দিয়েছেন। আজ রাতে আমার বিয়ে, খবর পেয়েছ না?
মকবুক দাঁত বের করে বলল, খবর জানি।
বিয়ের বাজার-টাজার করব, গাড়ি দরকার।
অবশ্যই।
খালু সাহেব যে এককথায় গাড়ি আমার হাতে সারাদিনের জন্যে ছেড়ে দেবেন ভাবাই যায় না।
মকবুল বলল, স্যারের মিজাজ বেশি, তয় লোক খারাপ না।
তুমি যাও খালু সাহেবের কাছে জেনে আস—গাড়ি নিয়ে যেতে পারবে কি-না।
মকবুল বিস্মিত হয়ে বলল, আপনে বলার পর আবার জিজ্ঞেস করা লাগব! কী কন আপনে!
সে গাড়িতে উঠে স্টার্ট দিল। আমরা ঝড়ের বেগে বের হয়ে গেলাম। বিশাল জিপে চলার আনন্দই আলাদা। নিজেকে রাজপথের রাজা মনে হয়। সিএনজি যার পেছনে লেখা—‘আমি ছোট আমাকে মেরো না’। আরে ব্যাটা, ছোট বলেই তো মার খাবি। বড় ছোটকে মারবে—এটা জগতের প্রাকৃতিক নিয়ম। Survival for the fittest. বড় fit, ছোট না। পশ্চাৎদেশে সাইনবোর্ড লাগিয়ে লাভ হবে না, ছোটকে মার খেতেই হবে।
মকবুল!
জি হিমু ভাই।
দুই একটা গাড়িকে পেছন থেকে ধাক্কা দিলে কেমন হয়?
আপনে বললে দিব। আমাদের গাড়ির বাম্পার খুবই স্ট্রং, ধাক্কা দিলে আমাদের কিছু হবে না।
সুবিধামত গাড়ি দেখতে পেলে তোমাকে বলব। পেছন থেকে হেভি ধাক্কা দিবে।
যখন বলবেন তখনই ধাক্কা।
গাড়ি ধাক্কা দেয়ার অনুমতি পাওয়ায় মকবুলকে খুবই আনন্দিত মনে হলো। আমি বললাম, মানুষ যেন না মারা যায়।
মানুষ মরবে না, তবে গাড়ি ভচকায়া দিব ইনশাল্লাহ। আপনে যাবেন কই?
দুই পুরিয়া হিরোইন কিনব। কোথায় পাওয়া যায় বলো তো।
সত্যি কিনবেন?
অবশ্যই।
টাইট হইয়া বইসা থাকেন, আপনেরে আসল জায়গায় নিয়া যাব। পচা বাবার কাছে যাব। খাঁটি জিনিস পাইকারি দরে পাবেন। আগে যে স্যারের আণ্ডারে ছিলাম তাঁর জন্যে প্রায়ই আনতে হইত।
গাড়ি পচা বাবার সন্ধানে চলছে, আমি অতি নরম গদিতে গা এলিয়ে দিয়েছি। আরামে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। পকেটের মোবাইল মিঁউ মিঁউ করেই যাচ্ছে। ধরতে ইচ্ছা করছে না। শেষ পর্যন্ত ধরলাম। মাজেদা খালার টেলিফোন। হ্যালো হিমু, খবর শুনেছিস?
কোন খবর?
তোর খালুর প্রাডো গাড়ি চুরি হয়ে গেছে।
বলো কী?
মকবুল ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে ভেগে গেছে। এতদিনের বিশ্বাসী ড্রাইভার।
পাঁচ বছর ধরে তোর খালুর সঙ্গে আছে।
আমি বললাম, বিশ বছর সংসার করার পর স্বামী স্ত্রীকে ফেলে ভেগে যায়, স্ত্রী স্বামীকে ফেলে ভেগে যায়। ড্রাইভারের দোষ কী!
স্বামী-স্ত্রী সেপারেশন এককথা, ড্রাইভারের সঙ্গে সেপারেশন ভিন্ন কথা।
তাও ঠিক। গাড়ি চুরির খবর পুলিশকে জানিয়েছ?
তোর খালু নিশ্চয়ই জানিয়েছে। বেচারা মুষড়ে পড়েছে।
মুষড়ে পড়ারই কথা। এত শখের গাড়ি।
তোকে আসতে বললাম, আসছিস না কেন?
ছোটখাট দু’একটা কাজ সেরেই চলে আসছি। রেনু কি তালাবন্ধ অবস্থায় আছে?
হুঁ। ওর ভাবভঙ্গি ভালো মনে হচ্ছিল না। এই জন্যেই তালা।
সে বাবাকে রিসিভ করতে এয়ারপোর্টে যাবে না?
পাগল! তাকে ঘর থেকেই বের হতে দেয়া হবে না।
খালা, রেনুর বাবার নাম কী?
তার বাবার নাম দিয়ে তুই কী করবি?
কী আশ্চর্যের কথা, শ্বশুড়ের নাম জানব না? সন্ধ্যা ছটার সময় আমি একটা সাইনবোর্ডে উনার নাম লিখে এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে থাকব। অতি সম্মানে শ্বশুর আব্বাকে গাড়ি করে ঢাকা শহরে নিয়ে আসব।
সত্যি যাবি?
অবশ্যই। জামাই যখন হতে যাচ্ছি তখন জামাইয়ের শেষ দেখে ছাড়ব। উনাকে এয়ারপোর্টেই কদমবুসি করব। কদমবুসির পর মোসহাবা করব, তারপর কোলাকুলি।
তোএ কথাবার্তার ভঙ্গি ভালো লাগছে না। বাসায় চলে আয় তো।
খালা, সামান্য দেরি হবে। বিশেষ একটা কাজে যাচ্ছি। পচা বাবার দোয়া নেব, তারপর অন্য কথা।
পচা বাবাটা কে?
আছেন একজন। তরুণ যুব সম্প্রদায়কে শান্তির পুরিয়া বিলি করেন। বিশিষ্ট সমাজসেবক। ভেজালমুক্ত শান্তি পুরিয়া একমাত্র তাঁর কাছেই পাওয়া যায়। অন্য কোনো বাবার কাছে গেলে দুই নম্বরি জিনিস দিয়ে দিবে।
খালা বিরক্ত হয়ে বললেন, আমি তোর অর্ধেক কথার কোনো মানেই বুঝি না। বিড়বিড় করে কী বলিস হাবিজাবি। টেলিফোন রাখলাম।
খালু সাহেব্দের সঙ্গে কথা বলা দরকার। বেচারা নিশ্চয় গাড়ির শোকে কাতর হয়ে আছে। নতুন গাড়ি স্ত্রীর অধিক। গাড়িতে রিকশার আঁচড় লাগলে সেই আঁচড় কলিজাতেও লাগে। স্ত্রীর গায়ে রিকশার আঁচড় লাগলে স্বামীর তেমন কিছু হয় না।
খালু সাহেব, আপনার না-কি গাড়ি চুরি গেছে?
হুঁ।
আপনার হাতের কাছে কি নিয়ামুল কোরান বইটা আছে?
কেন?
ওই বই-এ হারানো বস্তু ফিরিয়া পাইবার আমল দেয়া আছে। অজু করে ওই আমলটা করে দেখতে পারেন। মানুষের মৃত্যুসংবাদ পেলে যে দোয়াটা পড়তে হয়—ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেউন। এই দোয়া হারানো বস্তুর বেলায় খুব কাজ করে। হারানো মানুষ ফিরে আসে না, কিন্তু বস্তু ফিরে আসে।
হিমু Listen, আমি কী করব তার পরামর্শ তোমাকে দিতে হবে না।
গাড়ি হারানোতে আমি আপনার চেয়েও মর্মাহত। আশা ছিল আপনার গাড়িতে চড়ে বরযাত্রী যাব। বর রিকশায় চড়ে বিয়ে করতে যাচ্ছে—দৃশ্যটা ভালো না। রিকশাওয়ালাও বিয়ে করার সময় সিএনজি টেক্সি ভাড়া করে।
খালু সাহেব ‘Get lost’ বলে টেলিফোনের লাইন কেটে দিলেন। ড্রাইভার মকবুল বলল, গাড়ি চুরির কথা কী বললেন বুঝলাম না।
আমি বললাম, সবকিছু বোঝার প্রয়োজন নেই মকবুল। কম বুঝতে পারার মধ্যে শান্তি আছে। পাগলের দিকে তাকিয়ে দেখ। তারা কিছুই বুঝে না বলে মহাশান্তিতে আছে।
কথা সত্য বলছেন। ভাইজান, সামনের প্রাইভেট কারটাতে একটা ছোটখাট ধাক্কা দিব? নজর কইরা দেইখা তারপর বলেন। আমি তৈয়ার আছি।
আমি মকবুলের কথামতো নজর করে দেখলাম। চারজন তরুণ-তরুণীর দল। পেছনের দু’জন লটকালটকি করছে। জানালার কাচ খোলা। বিকট শব্দে গান বাজছে। হার্ড রক নামের বস্তু। ড্রাইভাবের সিটে যে বসেছে সে গানের তালে স্টিই য়ারিং-এ মাথা ঠুকছে। ঢাকা শহরে এমন দৃশ্য আগে দেখা যেতে না। এমন দেখা যাচ্ছে। আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম, ছোটখাট ধাক্কা একটা দিতে পার।
মকবুল মনের আনন্দে ধাক্কা দিল। তরুণ-তরুণীর দল হতভম্ব। প্রাইভেট কারের তরুণ ড্রাইভার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। চোখ-মুখ খিঁচিয়ে বলল, এই শুয়ার কি বাচ্চা!
আজকালকার তরুণরা ইংরেজি গালি দেয় ভালো এ হিন্দিতে গালি দিচ্ছে কেন বোঝা গেল না।
মকবুল বলল, স্যার আরেকটা দেই?
আমি বললাম, দাও।
দ্বিতীয় ধাক্কার পর তাদের ভীতি চরমে উঠল। তারা এখন অতি দ্রুত গাড়ি চালাচ্ছে। পালিয়ে যেতে পারলে বাঁচে এমন অবস্থা। মকবুল বলল, পিছে পিছে যাব স্যার?
যাও।
প্রাওভেট কার দ্রুত ডানদিকে ঢুকে গেল। আমরাও ডানদিকে ঢুকলাম। ওরা গাড়ির গতি বাড়াচ্ছে। আমরাও বাড়াচ্ছি। ওরা লেফট টার্ন নিয়ে গলিতে ঢুকে পড়ল। আমরাও গলিতে ঢুকলাম। মাইকেল মধুসূধনের ভাষায়—‘হে পামর! পালাবি কোথায়? যেথায় পশিবি তুই, পশিব সে দেশে।’
আমি বললাম, আরাম পাচ্ছ মকবুক?
মকবুল সব ক’টা দাঁত বের করে বলল, বিরাট আরাম পাইতেছি ভাইজান। পনেরো বছর ধইরা গাড়ির ড্রাইভারি করতেছি, এমন আরাম পাই নাই। আরেকটা ধাক্কা দিব?
দাও। দানে দানে তিন দান।
একবার একটু পাওয়ারের ধাক্কা দেই?
দাও।
তৃতীয় ধাক্কা দেবার পর গাড়ি সামান্য এগিয়ে থেমে গেল। আমরাও তাদের পাশে গাড়ি থামালাম। প্রাইভেট কারের তরুণ-তরুণীরা উদ্বিগ্ন চোখে তাকাচ্ছে। এরা যথেষ্টই ভয় পেয়েছে। এ সময়ের তরুণরা সাহসী কর্মকাণ্ড করে, তবে এরা সাহসী না। আমি জানালার কাচ নামিয়ে বললাম, তোমরা ভালো আছ?
কেউ জবাব দিল না।
আমি বললাম, গাড়ি বন্ধ করলে কেন? চালাও। নাকি আমরা ধাক্কাতে ধাক্কতে নিয়ে যাব? সেই ক্ষেত্রে গিয়ার নিউট্রালে দিয়ে রাখ।
প্রাইভেট কারের চালক বলল, Who are you?
আমি বললাম, তুমি নিজেই আন্দাজ কর আমি কে?
আমাদের কাছে কী চান?
তোমাদের সঙ্গে গল্প করতে চাই।
তারা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল।
তোমাদের মধ্যে কেউ গল্প জানো? যে-কোনো একটা গল্প বললেই হবে। টোনাটুনির গল্প বললেও হবে।
পেছনের সিটের মেয়েটা বলল, Leave us alone.
আমি বললাম, তোমরা গাড়ি স্টার্ট কর। আমরা লাস্ট একটা ধাক্কা দিয়ে টেনে বের হয়ে যাব।
গাড়ির চালক বলল, ধাক্কা কেন দেবেন জানতে পারি?আমি বললাম, সবাইকে দেখিয়ে তোমরা যে লদকালদকি করছ এটা পছন্দ হচ্ছে না। তোমাদের কুৎসিত কর্মকাণ্ডের সামান্য প্রতিবাদ।
পেছনের সিটের মেয়েটা বলল, সরি।
তুমি একা সরি বললে তো হবে না। সবাইকে একসঙ্গে সরি বলতে হবে।
সবাই একসঙ্গে বলল, সরি।
আমরা গাড়ি নিয়ে বের হয়ে গেলাম। মকবুল দাঁত বের করে বলল, বিরাট মজা পাইলাম ভাইজান।
আমি বললাম, মজার যে একটা অঙ্ক আছে সেটা জানো?
জি-না।
জটিল অঙ্ক না, সহজ অঙ্ক। আবার বুঝতে না পারলে ভয়ঙ্কর জটিল।
বুঝায়া বলেন।
আজকের এই ঘটনায় তুমি যতটুকু মজা পেলে প্রাইভেট কারের যাত্রীরা ততটুকুই বেমজা পেল। দু’টা মিলে কাটাকাটি। বুঝেছ?
বুঝলাম।
একদল আনন্দ পেলে আরেকদলকে সেই পরিমাণ নিরানন্দের ভেতর দিয়ে যেতে হবে। বিজ্ঞানের ভাষায় Conservation of আনন্দ। পৃথিবীতে আনন্দ এবং দুঃখ সবসময় থাকবে সমান সমান। একজন কেউ চরম আনন্দ পেলে অন্য একজনকে চরম দুঃখ পেতে হবে।