কে বলে শারদশশি সে মুখের তুলা
পদনখে পড়ে আছে তার কতগুলা।
খালা ভ্রু কুঁচকে বললেন, তার মানে?
আমি ব্যাখ্যায় গেলাম, প্রাচীন কবি ভারতচন্দ্র প্রেমিকার রূপ বর্ণনা এইভাবে করেছেন। তিনি বলেছেন—কোন মূর্খ বলছে মেয়েটি শরৎকালের চন্দ্রের মতো সুন্দর? এরকম কিছু চন্দ্র তো তার পায়ের নখের কাছেই দাঁড়াতে পারে না।
খালা আনন্দিত মুখে বললেন, মেয়েটা আসলেই অতিরিক্ত সুন্দর। এমন রুপবতী একটা মেয়ে হাতছাড়া করা ক্রাইম। আমার এমনই কপাল, বিয়ের কোনো পাত্রও হাতে নেই। বাধ্য হয়ে তোর সঙ্গে বিয়ে দিচ্ছি। আমাকে একটা থ্যাংকস দে।
থ্যাংক য়ু। আচ্ছা খালা, আমি কি শ্বশুর-শাশুডি ছাড়া বিয়ে করব?
শ্বশুর কোথায় পাবি? তোর শ্বশুর আমেরিকায়। ওদের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। শাশুড়ি অবশ্যি ঢাকায় আছে। সেও মরমর, ভয়াবহ অ্যাজমা। এখন অ্যাপোলো হাসপাতালের কেবিনে আছে।
উনার নাম-ঠিকানা দাও। দেখা করে আসি। কদমবুসি করে দোয়া নিয়ে আসি।
সত্যি যাবি?
অবশ্যই যাব। আমি আদর্শ জামাই।
তার সঙ্গে উল্টাপাল্টা কথা বলবি না কিন্তু। ঠাট্টা মশকরাও করবি না।
খালা, তুমি নিশ্চিন্ত থাক। রেনুর মা তাঁর মেয়ের জামাই পছন্দ করবেন।
কাগজ-কলম আন, ঠিকানা লিখে দিচ্ছি।
আমি কাগজ-কলম আনতে গিয়ে গেস্টরুমে আরেকবার উঁকি দিলাম। রেনু ঠিক আগের জায়গায় বসে আছে। তার সামনে আমার নিয়ে আসা দু’টা ব্লেড। তার মুখে বিচিত্র হাসির আভাস। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়—
কাহারো হাসি ছুরির মতো কাটে
কাহারো হাসি অশ্রুজলের মতো।
মেয়েটির হাসি অবশ্যই অশ্রুজলের মতো।
রেনুর আমাকে দেখতে পাওয়ার কথা না, তারপরেও দেখে ফেলল। কঠিন গলায় বলল, তুই আবার এসেছিস?
আমি বিনীত ভঙ্গিতে বললাম, একটা বিশেষ কাজে এসেছি। দু’টা ব্লেড তো তোমার লাগবে না। একটা ব্লেডেই কাজ হবে। অন্যটা আমাকে দিয়ে দাও। আমি তোমার প্রেমিককে দিয়ে আসব। একটা ব্লেড দিয়ে তুমি রগ কাটবে, অন্যটা দিয়ে সে। সময় ঠিক করা থাকবে। একই সময়ে রগ কর্তন অনুষ্ঠান।
রেনু ইংরেজিতে বলল, তুমি সার্কাসের ক্লাউন ছাড়া কিছুই না। আমি ক্লাউন পছন্দ করি না।
ক্লাউন কিন্তু সবাই পছন্দ করে। হুতোম প্যাঁচা কেউ পছন্দ করে না।
তোর কাছে সিগারেট আছে?
না।
আমাকে এক প্যাকেট সিগারেট আর একটা লাইটার এনে দিতে পারবেন?
অবশ্যই পারব। তুমি কিন্তু তুই-আপনি-তুমির মধ্যে ভজঘট পাকিয়ে ফেলছ। একটা সেটেলমেণ্টে আসো—তুই-তুমি-আপনির মধ্যে যে-কোনো একটা বেছে নাও।
Get lost.
সিগারেট কোন ব্রাণ্ডের কিনব?
Any brand will do.
টাকা দাও।
এক প্যাকেট সিগারেট কেনার টাকাও কি তোমার কাছে নেই?
না।
এই অবস্থায় বিয়ে করতে চাচ্ছ?
বিয়ে করতে টাকা লাগবে না। বিয়ের খরচ মাজেদা খালা দেবেন।
Get lost.
সিগারেট আনতে হবে না?
না।
বাকিতে কিনে এনে দেই। টাকা পরে দিও।
তুমি এই মুহূর্তে আমার সামনে থেকে বিদেয় হবে।
আমি বের হয়ে এলাম। খালা রেনুর মা কোন হাসপাতালে আছেন, কেবিন নাম্বার কত লিখে দিলেন। সেই সঙ্গে চামড়ায় বাঁধানো একটা খাতা ধরিয়ে দিলেন। রেনুর ডায়েরি, তিনি চুরি করেছেন। নিজের কাছে রাখতে ভরসা পাচ্ছেন না।
খালা গলা নামিয়ে বললেন, ডায়েরিতে অনেক খোলামেলা কথা লেখা। তুই কিন্তু পড়বি না। তোর মন খারাপ হবে।
মন খারাপ, মন ভালোর কোনো সিস্টেম আমার মধ্যে নেই। স্বামী হিসেবে স্ত্রীর ডায়েরি পড়া আমার কর্তব্য। অতীত জানতে হবে না? মেয়েটাকে টাইটে রাখতে হবে। তুলসি দাস বলেছেন, ঢোল এবং স্ত্রী এই দুই শ্রেণীকে সবসময় মারের উপর রাখতে হবে।
খালা বললেন, তুলসি দাসটা কে?
আমি বললাম, কবি। তুমি চিনবে না। ভালো কথা, তুমি বিয়ের খরচ হিসেবে কিছু টাকা দাও। হাত খালি।
খালা একটা পাঁচশ টাকার নোট দিলেন।
আমি খাতা এবং পাঁচশ’ টাকার নোট বগলদাবা করে বের হয়ে এলাম।
এক প্যাকেট সিগারেট এবং একটা লাইটার কিনে আবার ফিরে গেলাম। স্ত্রীর নেশার বস্তু স্বামী জোগাড় করে না দিলে কে দেবে?
রেনু ঠিক আগের জায়গাতেই আছে। একই ভঙ্গিতে পা দোলাচ্ছে। আমি তার পাশে সিগারেটের প্যাকেট এবং লাইটার রাখলাম। সে সঙ্গে সঙ্গে সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, থ্যাংক য়্যু।
আমি বললাম, তোমাকে কি একটা হাসির গল্প বলব? তোমার সেন্স অব হিউমার কেমন আমার জানা দরকার।
আমার সেন্স অব হিউমার দিয়ে তোমার প্রয়োজন কী?
বিয়ের পর আমি হাসির গল্প করব আর তুমি মুখ ভোঁতা করে থাকবে এটা ঠিক না।
রেনু তাকালো আমার দিকে। তবে আমার কথা সে শুনতে পেয়েছে এরকম মনে হলো না। আমি বললাম, কী বলছি মন দিয়ে শোন। এক ছেলে ক্লাস সিক্সে পড়ে। ফাইনাল পরীক্ষা হয়ে গেছে। রেজাল্ট আউট হবে। সে খুবই চিন্তিত…
রেনু বলল, দয়া করে চুপ করবে?
আমি চুপ করলাম। রেনু বলল, তোমার এই মাজেদা খালা কি মানসিকভাবে অসুস্থ?
কেন বলো তো?
এই মহিলা ধরেই নিয়েছে আজ রাতেই সে আমাকে বিয়ে দিয়ে দেবে। এটা কি সম্ভব?
আমি বললাম, অবশ্যই সম্ভব। বিয়ে খুবই সহজ ব্যাপার। তিনবার শুধু কবুল বলবে। আর কিচ্ছু না। তিনবার কবুল বলতে সময় লাগবে তিন সেকেণ্ড। রাত দশটার মধ্যে তিনবার কবুল বলার সময় কি হবে না?
রেনু বলল, Get lost.
আমি বললাম, সিগারেটের টাকাটা দাও আমি চলে যাই। একশ’ টাকা দিলেই হবে।
রেনু টাকা বের করে দিল। তার ঠোঁটের ফাঁকে বিচিত্র হাসির আভাস। এই হাসির অর্থ কী কে জানে!
আজ হিমুর বিয়ে – পর্ব ২
রেনুর চামড়া বাঁধানো খাতাটাকে কিছুতেই ডায়েরি বলা যাবে না। খিচুড়ি খাতা বলা যেতে পারে। যেখানে অংক আছে, ছবি আঁকা আছে, ধাঁধা আছে। ফাঁকে ফাঁকে মন্তব্য। উদ্ভব কিছু বিষয়ও আছে, যার রহস্য বের করা অসম্ভব। যেমন–
৭+৩ = ১২ (হা হা হা)
১২+৩ = ০ (আবার হা হা হা)
এক পাতায় লেখা–
পৃথিবীর সর্বকালের সর্ব বোকা দুই রমণীর নাম–
১. আমার মা
২. আমি নিজে
রেনুর নিজের নাম নিয়েও অনেক চিন্তাভাবনা আছে। সে নিজের নাম লিখেছে–
Ray-নু
এই বানানের ব্যাখ্যাও আছে–
Ray-নু অর্থাৎ রশ্মিনু অর্থাৎ রশিনু অর্থাৎ রসুন।
মনস্তত্ত্ববিদরা রেনুর খিচুড়ি খাতা থেকে তার মানসিকতা বিষয়ে অনেক কিছু পেলে পেতে পারেন। আমি তেমন কিছু পেলাম না। মেয়েটা যে-কোনো কারণে তার মায়ের উপর রেগে আছে, এটা বোঝা যায়। কয়েক পাতা পরপরই সে তার মায়ের বিষয়ে লিখেছে। কঠিন সব মন্তব্য। যেমন–