খালার ফ্যাট বাড়ির সামনে পা ছড়িয়ে হনুমানটাইপ কাউকে বসে থাকতে দেখা গেল না। এক চটপটিওয়ালা চাক্কাওয়ালা দোকান নিয়ে বসে আছে। তার হাতে ঘণ্টি। সে মাঝে মাঝে ঘণ্টি বাজাচ্ছে। চানাচুরওয়ালারা ঘণ্টি বাজায়। এই প্রথম চটপটিওয়ালাকে ঘণ্টি বাজাতে দেখলাম। মোবাইল ফোন বের করে তার ছবি তুলে ফেললাম। মাজেদা খালার এই যন্ত্র অতি উচ্চ শ্রেণীর—একের ভেতর অনেক। ছবি তোলা যায়, কথাবার্তা রেকর্ড করা যায়, ই-মেইল পাঠানো যায়। লাইলী-মজনুর আমনে এই যন্ত্র থাকলে তাদের এত কষ্ট করতে হতো না। বর্তমানকালের প্রেমিক-প্রেমিকারা বিরাট ভাগ্য নিয়ে এসেছে। মোবাইল কোম্পানিগুলোও প্রেমের ইজারা নিয়ে নিয়েছে। প্রেমিক-প্রেমিকারা যাতে রাতভর কথা বলতে পারে তার জন্যেও কত ব্যবস্থা। কলরেট অতি সামান্য। বিশেষ বিশেষ রাতে আবার ফ্রি। মোবাইল টেলিফোন কোম্পানিগুলোর একটাই মটো—‘বাঙালি জাতি! প্রেম করো। প্রেম।’ ‘হে বাঙালি! প্রেমে ধর হাত মম।’
কলিংবেলে চাপ ঠিকমতো পড়ার আগেই খালা দরজা খুলে হাসিমুখে বললেন, হারামিটাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। তোল খালু সাহেবকে টেলিফোন করেছিলাম। তাঁর এক বন্ধু আছে পুলিশ কমিশনার সাউথ। তাকে বলা মাত্র এক গাড়ি পুলিশ চলে এসেছে। হনুমানটাকে মারতে মারতে গাড়িতে নিয়ে তুলেছে। দশ মিনিট আগে এলে দৃশ্যটা দেখতে পেতি।
মজাদার দৃশ্য?
অবশ্যই মজাদার। হনুমানটা চেঁচাচ্ছে। পুলিশের হাতেপায়ে ধরছে। পুলিশ পিটাচ্ছে। পাবলিক হাততালি দিচ্ছে।
রেনু কি দৃশ্যটা দেখেছে?
হ্যাঁ দেখেছে। দুইজন তো একসঙ্গেই বারান্দায় এসেছি।
দৃশ্যটা দেখার পর তার রিঅ্যাকশন কী?
মেয়ে শক্ত আছে। কোনো রিঅ্যাকশন দেখায় নি।
সে এখন কোথায়?
গেস্টরুমে বসে আছে।
তুমি না বললে তালাবন্ধ করে রেখেছ?
তালাবন্ধই ছিল। কিছুক্ষণ আগে তালা খুলে দিয়েছি। সে বলেছে পালিয়ে যাবে না। এই মেয়ের কথার উপর ভরসা করা যায়। তুই মেয়েটার সঙ্গে কথা বলতে চাইলে কথা বল। দেখ মেয়ে পছন্দ হয় কি-না।
খালা, একটা কথা। বিয়ের পর মেয়েটাকে আমি খাওয়াব কী? লোকজনের পকেট থাকে গড়ের মাঠ কিংবা সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, আর আমার তো পকেটই নেই। মাঠ তো অনেক পরের ব্যাপার।
তোর ঐ মেয়েকে খাওয়াতে হবে না। ঐ মেয়ে তোকে খাওয়াবে। মেয়ের নামে বনানী এবং বারিধারায় তিনটা ফ্ল্যাট আছে। একটাতে তোরা দুইজন থাকবি, বাকি দু’টা ভাড়া দিবি। বউয়ের পয়সায় তুই মনের আনন্দে হাঁটাহাঁটি করবি। দেশে হাঁটাহাঁটি করতে ভালো না লাগলে বিদেশে হাঁটাহাঁটি করবি। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ব্যাংকক।
ঐ মেয়ে কি আমার সঙ্গে হাঁটবে? না-কি বিয়ের পরেও আমাকে একা হাঁটতে হবে?
সেটা রেনু জানে। তাকে জিজ্ঞেস কর।
মারবে না তো!
মারলে মার খাবি। শুধু পুরুষরাই বউ পিটিয়ে যাবে কেন? বউরাও স্বামী পিটাবে।
আমি গেস্টরুমের দিকে এগুলাম। গেস্টরুমের দরজা খোলা। স্কার্ট পরা তরুণী বসে আছে। তরুণীর মুখ দেখা যাচ্ছে না। পা দেখা যাচ্ছে। সে পা দোলাচ্ছে। পা দোলানো থেকে একজন মানুষের মনের অবস্থা বলা কি সম্ভব? মন শান্ত মানুষ যে ভঙ্গিতে পা দোলায় অশান্ত মানুষ কি সেইভাবেই দোলায়?
ডেমোগ্রাফি
মানব মনের গতিপ্রকৃতি এবং পদ সঞ্চালন
আমি ঘরে উঁকি দিলাম। যথাসম্ভব বিনীত গলায় বললাম, ওহে! (হ্যালোর বাংলা বললাম।)
রেনু চমকে তাকাল। আমি তার দিকে তাকিয়ে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। স্তম্ভিত শব্দের অর্থ স্তম্ভের মত। কেউ যখন কোনো বিশেষ দৃশ্য দেখে স্তম্ভের মতো নড়নচনড় বন্ধ করে দেয় তাকেই বলা হয় স্তম্ভিত। স্তম্ভিত না বলে আমরা খাম্বিতও বলতে পারি। খাম্বিত মানে খাম্বার মতো হয়ে যাওয়া।
আমার খাম্বিত হবার প্রধান কারণ মেয়েটির রূপ। রবীন্দনাথ ঠিক এই ধরনের কোনো একটা মেয়েকে দেখে লিখেছিলেন—
মুখের পানে চাহিনু অনিমেষে
বাজিল বুকে সুখের মতো ব্যথা।
প্রাচীন কবি সাহিত্যিকরা হাস্যকর ভঙ্গিতে মেয়েদের রূপ বর্ণনা করেছেন—কমলার কোয়ার মতো ঠোঁট, ইঁদুরের দাঁতের মতো দাঁত, বাঁশের কঞ্চির মতো নাক…। মতো মতো করে সৌন্দর্য ব্যাখ্যা করা যায় না। সব সৌন্দর্য ব্যাখ্যাতীর কিছু ব্যাপার থাকে। রবীন্দ্রনাথ ব্যাপারটা বুঝেছিলেন বলেই ব্যাখ্যা না গিয়ে বলেছেন—বাজিল বুকে সুখের মতো ব্যথা।
রেনু শান্ত গলায় বলল, আপনি কে?
এই মেয়েই টেলিফোনে আমাকে ‘শালার বাচ্চা শালা’ বলেছে এটা বিশ্বাস করা শক্ত। মিষ্টি কিশোরী কণ্ঠ। আমি বললাম, আমার নাম হিমু।
মেয়ে চমকাল না। সহজ ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইল। সকালবেলায় এই মেয়ে তুই তুই করে গালাগালি করেছে। দ্রুত এই পরিবর্তন কী করে হলো? এই জন্যেই কি কবি বলেছেন—দেবা না জানন্তি কুত্রাপি মনুষ্যা?
এখানে কী চান?
আমি তোমার জন্যে একটা জিনিস নিয়ে এসেছি।
রেনু বলল, আমি কি আপনাকে কিছু আনতে বলেছি?
আমি বললাম, তুমি বলো নি। তবে আমি মাজেদা খালার কাছে শুনলাম, ব্লেডের অভাবে তুমি হাতের রগ কাটতে পারছ না। আমি ব্লেড নিয়ে এসেছি। দুই কোম্পানির ব্লেড এনেছি। তোমার যেটা পছন্দ রাখ।
আমি ব্লেড এগিয়ে দিলাম। মেয়েটির যথেষ্ট পরিমাণেই বিস্মিত হবার কথা। তা না হয়ে সে স্বাভাবিক গলায় বলল, Will you please sit down?
মেয়েটির সামনের বেতের চেয়ারে বসলাম। এখন সে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে আমাকে দেখছে। তার পা দোলানো বন্ধ। আমাদের মধ্যে কিছু কথাবার্তা হলো। সে প্রতিটি কথাই বলল ইংরেজিতে। আমি তার বঙ্গানুবাদ করে দিলাম।
তুমি কি সেই ব্যক্তি যে আমাকে বিয়ে করবে?
হ্যাঁ।
তোমার স্পর্ধা দেখে অবাক হচ্ছি।
অবাক হবার কিছু নেই। বামুনেরাই চাঁদ ধরতে চায়। লম্বা মানুষ চায় না।
রেনু বলল, বামুন এবং লম্বা কেউ কিন্তু চাঁদ ধরতে পারে না।
আমি বললাম, সেটা চাঁদের জন্যে দুঃখের ব্যাপার। সে ধরা দিতে চায়, অথচ কেউ ধরতে পারে না।
রেনু বলল, চাঁদ কখনো ধরা দিতে চায় না। ধরা দিতে চাইলে সে নিজেই নেমে আসত। সে কখনো তা করে না।
তুমি তা করেছ। এক ড্রাগঅ্যাডিক্টকে বিয়ে করার জন্যে নেমে এসেছ।
আমি কাকে বিয়ে করতে চাই সেটা আমার ব্যাপার। সোসাইটির এখানে কোনো দায়িত্ব নেই।
সোসাইটির দায়িত্ব অবশ্যই আছে। তুমি যদি HIV Positive কাউকে বিয়ে করতে চাও সোসাইটির উচিত সে বিয়ে আটকানো।
কেন আটকাবে?
আটকাবে, কারণ সোসাইটি নিজেকে প্রটেক্ট করতে চাইবে। সে কখনো চাইবে না HIV Positive-এর সংখ্যা বাড়তে থাকুক।
আমি তোমার সঙ্গে তর্কে যাচ্ছি না। তোমার জানার জন্যে বলছি, আমি ভালো তর্ক জানি।
আমার মনে হয় না তুমি ভালো তর্ক জানো। যারা তর্ক জানে তারা গালাগালি জানে না। তার্কিকদের গালাগালি প্রয়োজন হয় না বলেই তারা জানে না। তর্কক্ষমতাশূন্য মানুষরাই গালাগালি করে জিততে চেষ্টা করে।
তুমি কি দয়া করে আমার ঘর থেকে বের হবে? তুমি একজন শালার বাচ্চা।
শালার বাচ্চা কিন্তু গালি না। Dog গালি, ডগের বাচ্চা Puppy গালি না। আদরের ডাক।
তর্ক বন্ধ করো এবং বিদেয় হও। আমি এক থেকে তিন গোনার মধ্যে। নয়তো কামড় দিয়ে আমি তোমার কান খেয়ে ফেলব।
আমি দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললাম, তোমার প্রেমিকের সঙ্গে কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার দেখা হবে। তুমি কি আমার মাধ্যমে তাকে কোনো ইনফরমেশন পাঠাতে চাও? এই সুযোগ বিয়ের পরে পাবে না। বিয়ের পর আমার সামনে হনুমানটার নামও নিতে পারবে না। স্বামীরা খুব জেলাস হয়। ভালো কথা, হনুমানটার নাম কী?
হনুমান মানে? হনুমান কী?
তোমার প্রেমিকের কথা বলছি। শুনেছি সে দেখতে হনুমানের মতো। তার পছন্দের খাবারও না-কি কলা?
One, Two,…
থ্রি বলার আগেই আমি বের হয়ে এলাম। এই মেয়ে কামড় দিয়ে কান ছিঁড়ে ফেলতে পারে। একে বিশ্বাস নেই।
মাজেদা খালা আমার অপেক্ষায় ড্রয়িংরুমে বসেছিলেন। তাঁর চোখেমুখে প্রবল কৌতূহল। আমি তাঁর কাছে আসার আগেই তিনি গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বললেন, বউ কেমন দেখনি?
আমি বললাম—