জেট লেগের কারণে ফার্গুসেন জুনিয়র কাহিল। তিনি এখন সিটে হেলান দিয়ে নিদ্রা যাচ্ছেন। আমার সঙ্গে তাঁর কথাবার্তা তেমন হয় নি। তিনি গাড়িতে উঠেই আমাকে বলেছেন (ইংরেজিতে), আমার মেয়েকে অন্য একটা বাড়িতে আটকে রেখে তার অপছন্দের ছেলের সঙ্গে কেন বিয়ে দেয়া হচ্ছে?
আমি বললাম, (বাংলায়। ভদ্রলোক বাংলা ভালো জানেন।) আপনি তো নিজেই যাচ্ছেন। মেয়েকে জিজ্ঞেস করে জেনে নেবেন।
তিনি বললেন, যে ছেলেটির সঙ্গে জোর করে আমার মেয়েকে বিয়ে দেয়া হচ্ছে তার বিষয়ে তুমি কিছু জানো?
জানি।
ছেলে সম্পর্কে আমাকে একটা প্রাথমিক ধারণা দাও।
ছেলে ভালো। তার বুদ্ধিও ভালো। IQ কত তা বলা যাচ্ছে না। আমাদের দেশে IQ মাপার ব্যবস্থা নেই। ছেলেটার মনও ভালো। মানুষের দুঃখকষ্টে ব্যথিত হয়। উচ্চশ্রেণীর দার্শনিক, চিন্তাভাবনা করতে ভালোবাসে।
ছেলে কী করে?
কিছুই করে না। ভ্যাগাবণ্ড বলা যায়।
তার সোর্স অব ইনকাম কী?
এর ওর কাছে হাতপাতা। ভিক্ষাবৃত্তি বলতে পারেন।
ফার্গুসেনের চোখ থেকে ঘুমঘুম ভাব উধাও হলো। তিনি অবাক হয়ে বললেন—ভিক্ষাবৃত্তি?
ভিক্ষাবৃত্তিকে আমাদের সমাজে খুব খারাপভাবে দেখা হয় না। আমরা সবাই কোনো না কোনোভাবে ভিক্ষা করি। আমাদের রাষ্ট্রও ভিক্ষুক রাষ্ট্র। দাতা দেশের ভিক্ষায় আমরা চলি।
ফার্গুসেন বিরক্ত গলায় বললেন, রাষ্ট্র আপাতত থাক। তুমি ছেলেটি সম্পর্কে বলো। আমি তার বিষয়ে জানতে চাই।
আপনি কী জানতে চান? আপনি যা জানতে চান সবই আপনাকে জানাতে পারব। আমি ঐ ছেলের নাড়িনক্ষত্র জানি।
কীভাবে জানো?
আমিই সেই ছেলে। আমার নাম হিমু।
আমি হ্যাণ্ডশেকের জন্যে হাত বাড়ালাম। ধারণা করেছিলাম, ফার্গুসেন আমার আবেদন অগ্রাহ্য করবেন। তা করলেন না। হ্যাণ্ডসেক করতে করতে বললেন—I See.
মেয়ের জামাইকে দেখে তিনি খুব আহ্লাদিত হলেন বলে মনে হলো না। গাড়ির সিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করলেন। আমার ধারণা তিনি ঘুমিয়েও পড়লেন।
আমেরিকান শুনলেই বিশাল দেহী গোয়ান ধরনের মানুষের ছবি চোখে ভাসে। ভদ্রলোক সেরকম না। মাঝারি স্বাস্থ্যের লম্বা একজন মানুষ। মুখে খোঁচা খোঁচা শাদাপাকা দাড়ি। মাথাভর্তি চুল। মাথার চুল যথেষ্ট লম্বা। সবসময় রিডিং গ্লাস পরে থাকেন। চোখ দেখা যায়। চোখের নিচে অর্ধেক চশমা। যিশুখ্রীষ্টকে নিয়ে ছবি বানালে এই ভদ্রলোককে নামভূমিকায় নেয়া যেত । শুধু চোখে কনটাক্ট লেন্স দিয়ে নীল করতে হবে। পশ্চিমাদের যিশুখ্রিষ্টের চোখ হয় নীল। যদিও তিনি জন্মসূত্রে আরব। আরবদের চোখ কটা, নীল না।
হিমু!
জি স্যার।
গাধার কাছে খড়ের মূল্য স্বর্ণের চেয়ে অনেক বেশি।
আপনার কাছে কি আমাকে গাধা মনে হচ্ছে?
তুমি এবং আমার কন্যা এই দু’জনের মধ্যে একজন অবশ্যই খড় পছন্দ করে। সেটা কে আমার দেখার শখ আছে। আমার কেন জানি এখন মনে হচ্ছে আমার মেয়েই খড় পছন্দ করে।
এরকম মনে করার কারণ কী?
আমি নিজে খড় পছন্দ করি। আমার মেয়ে তো আমার মতোই হবে। ভালো কথা, তোমার এই গাড়িটা আরামদায়ক।
আমি বললাম, আমার গাড়ি বলছেন কেন? আমি এমন গাড়ি পাব কোথায়?
এটা চোরাই গাড়ি।
তুমি কি আমার সঙ্গে ঠাট্টা করছ?
ঠাট্টা করছি না। চোরাই গাড়ি। যে-কোনো মুহূর্তে আমাদের পুলিশ ধরতে পারে।
Are you serious?
জি স্যার।
উনি গাড়ির ব্যাক সিটে মাথা রেখে আবারো চোখ বন্ধ করলেন। নাক ডাকার মতো শব্দ হচ্ছে। মনে হচ্ছে ঘুমিয়ে পড়েছেন। অনেক মানুষের দুশ্চিন্তায় ভালো ঘুম হয়, উনি মনে হচ্ছে সেই শ্রেণীর। আমি তাঁকে নিয়ে যাচ্ছি হোটেল সোনারগাঁয়ে। সেখানে তাঁর জন্যে রুম বুক করা আছে। বিশ্বরোডের কাছাকাছি এসে ট্রাফিক সিগন্যালে গাড়ি থামল। মোটর বাইকে চড়ে একজন পুলিশ সার্জেণ্ট এগিয়ে আসছে। তার চোখে সানগ্লাস। সে কোনদিকে তাকাচ্ছে কী দেখছে সানগ্লাসের কারণে বোঝার উপায় নেই। আমার কাছে মনে হলো, সে আমাদের গাড়ির নাম্বার প্লেট দেখছে। ওয়াকিটকিতে কার সঙ্গে কথা বলা শুরু করছে। অবস্থা মোটেই ভালো বোধ হচ্ছে না।
খালি সাহেবকে না বলে গাড়ি নিয়ে বের হবার ব্যাপারটা ড্রাইভার মকবুল দুপুর থেকে টের পেয়েছে। তবে সে মোটেই ঘাবড়ায় নি। এখন ঘাবড়ে গেল।
লাল বাতি নিভে সবুজ বাতি জ্বলছে। মকবুক ইচ্ছা করলে একটানে গাড়ি নিয়ে বের হয়ে যেতে পারত। তা-না করে দরজা খুলে এক দৌড়ে সে পগার পার। সে আগে কিছুদিন ট্রাক চালিয়েছে। ট্রাক ড্রাইভাররা ট্রাক ফেলে দৌড়ে পালানোর বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়। মকবুলের দৌড় দেখে এই বিশ্বাস আমার দৃঢ় হলো।
পুলিশ সার্জেণ্ট সমানে বাঁশি বাজাচ্ছে। আরো পুলিশ জড়ো হয়েছে। বাঁশির শব্দে ফার্গুসেন জুনিয়র জেগে উঠে বললেন, কী হয়েছে?
আমি বললাম, খুব সম্ভবত আমরা পুলিশের হাতে অ্যারেস্ট হতে যাচ্ছি।
বলো কী?
আমাদের ড্রাইভার দৌড় দিয়ে পালিয়ে গেছে। আমিও দৌড় দিতাম। আপনাকে ফেলে পালাতে হয় বলে পালাই নি। বিপদ দেখে জামাই শ্বশুর ফেলে পালিয়ে যাবে এটা ঠিক না।
পুলিশ সার্জেণ্ট গাড়ির দরজা খুলল ফার্গুসেন জুনিয়র সঙ্গে সঙ্গে দুই হাত উপরে তুললেন। আমেরিকান ট্রেনিং। পিস্তল হাতে পুলিশ দেখা মাত্র আমেরিকানরা সুবোধ বালকের মতো দু’হাত উপরে তুলে। ফার্গুসেনের দেখাদেখি আমিও হাত উপরে তুললাম। পুলিশ সার্জেণ্ট বললেন, এটা তো চোরাই গাড়ি।
আমি বললাম, ইয়েস স্যার। আপনি অতি সত্য কথা বলেছেন।
গাড়ি চুরি কে করেছে?
আমি চুরি করেছি স্যার। ড্রাইভার মকবুলের সহায়তায় চুরি। মূল পরিকল্পনা আমার।
বিদেশী এই শাদা চামড়া কে?
উনি আমার শ্বশুর স্যার।
তোমার শ্বশুর? উনি তোমার শ্বশুর?
এখনও শ্বশুর হন নি। আজ রাত ন’টার মধ্যে হয়ে যাবেন ইনশাল্লাহ। উনার একমাত্র মেয়েকে আমি বিবাহ করছি। বিয়ের শাড়ি কেনা হয়েছে। হলুদ রঙের শাড়ি। ইচ্ছা করলে শাড়িটা দেখতে পারেন। আমার সঙ্গেই আছে।
সার্জেণ্ট এক চড় কষালেন। আমি আগে থেকে প্রস্তুত ছিলাম বলে যতটা ব্যথা পাওয়ার কথা ততটা পেলাম না। আমার হাতে সঙ্গে সঙ্গে হাতকড়া পরিয়ে রাস্তার একপাশে টেনে নিয়ে যাওয়া হলো। ফার্গুসেন সাহেব আমেরিকান বলেই হয়তো তাঁর হাতে হাতকড়া পরানো হলো না। তাঁকেও রাস্তার অন্যপাশে নিয়ে যাওয়া হলো। বেচারা পুরো ঘটনায় খুবই হকচকিয়ে গিয়েছে। শুরুতে হাত মাথার উপর তুলেছিল, এখনো নামায় নি। পুলিশ সার্জেণ্ট আরো দু’জন এসেছে। তারা বিদেশী আসামি দেখেই মহাউৎসাহে ক্রস একজামিনেশন শুরু করে দিয়েছে।
এই গাড়ি যে একটা চোরাই গাড়ি এটা তুমি জানো?
গাড়িতে উঠার পর জেনেছি। আগে জানতাম না।
এই গাড়ি যে একটা প্রাইভেট কারকে পেছন থেকে কয়েকবার ধাক্কা দিয়েছে, গাড়ির আরোহীদের মেরে ফেলার চেষ্টা করেছিল, এটা জানো?
না।
ওই গাড়িতে বিদ্যুত প্রতিমন্ত্রীর এক শ্যালক ছিলেন। উনিই গাড়ির নাম্বার নোট করে পুলিশকে জানিয়েছেন।
আমি কিছুই জানি না।
তুমি কি আন্তর্জাতিক ড্রাগ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত?
না।
তোমার কাছে কি কোনো ড্রাগস আছে?
আমার কাছে কোনো ড্রাগস নেই।
ইউ আর আণ্ডার অ্যারেস্ট।
ফার্গুসেন চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলছেন। আমি পুলিশ সার্জেণ্টকে বললাম, স্যার উনি নির্দোষ মানুষ। উনার কাছে কিছুই নাই। তবে আমার কাছে এক পুরিয়া হিরোইন আছে। আমি দুই পুরিয়া কিনেছিলাম। এক পুরিয়া একজনকে দিয়েছি, আরেকটা নিজের কাছে রেখে দিয়েছি।
ফার্গুসেন জুনিয়র বিড়বিড় করে বললেন, My God!
পুলিশ সার্জেণ্ট তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, হলুদ পাঞ্জাবি পরা এই ছেলেকে কি আপনি চেনেন?
না।
আরেকবার জিজ্ঞেস করছি, তাকে চেনেন?
অবশ্যই না।
তাকে চেনেন না কিন্তু তার চোরাই গাড়িতে ঘুরছেন, এটা কেমন কথা?
ফার্গুসেন চুপ করে গেলেন। তিনি হতাশ চোখে আমার দিকে তাকাচ্ছেন।
সার্জেণ্ট ধমক দিলেন, চুপ করে থাকবেন না। কথা বলুন।
ফার্গুসেন চাপা গলায় বললেন, তাকে আমি আজ এই প্রথম দেখলাম।
তার সঙ্গে আপনার মেয়ের বিয়ে হচ্ছে, এই তথ্য কি সঠিক?
আমি কিছুই বলতে পারছি না। আমি অন্যন্ত কনফিউজড।
থানায় চলুন।
ফার্গুসেন হতাশ গলায় কয়েকবার বললেন—Oh my God! Oh my God!
পুলিশের প্রিজন ভ্যান চলে এসেছে। আমাদেরকে প্রিজন ভ্যানে তোলা হচ্ছে। সীট বলে কিছু নেই। গাড়ির ছাদ থেকে হুকের মতো ঝুলছে। হুক ধরে দাঁড়িয়ে থাকা। গাড়ির ছাদের সঙ্গে গ্রীল দেয়া খুপড়ি জানালার মতো আছে। পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে উঁচু হয়ে দাঁড়ালে বাইরের পৃথিবীর কিছুটা দেখা যায়। আমি ভবিষ্যত শ্বশুর সাহেবের দিকে তাকিয়ে মধুর গলায় বললাম, স্যার জানালা দিয়ে ঢাকা শহরটা দেখে নিন। প্রিজন ভ্যান থেকে শহর দেখার আলাদা মজা আছে।
ফার্গুসেন বললেন, আমাকে সত্যি করে বলো তো, তোমার সঙ্গেই কি আমার মেয়ের বিয়ে হচ্ছে?
জি স্যার।
আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।
বুঝতে না পারারই কথা। এই জন্যেই কবি বলেছেন—
The hurt is not enough :
I long or weight and strength
To feel the earth as rough
To all my length.
ফার্গুসেন বললেন, এই কবিতা কার লেখা জানো?
আমি বললাম, জানি স্যার। Robert Frost. আপনার প্রিয় কবি।
রবার্ট ফ্রস্ট আমার প্রিয় কবি জানলে কীভাবে?
আপনার কন্যা রেনুর খাতা পড়ে জেনেছি। চার লাইনের এই কবিতা রেনুর খাতায় পেয়েছি। মুখস্ত করে রেখেছিলাম সুযোগমতো আবৃত্তি করে আপনাকে চমকে দেবার জন্যে। আপনি কি চমকেছেন?
ফার্গুসেন জবাব দিলেন না। কঠিন চোখে তাকিয়ে রইলেন।
আপনাকে চমকে দেবার ব্যবস্থা আমার কাছে আছে। আপনার অনুমতি পেলে চেষ্টা করে দেখতে পারি।
তুমি চুপ করে থাকলে খুশি হবো। এই গাড়ি কতক্ষণে থানায় পৌঁছবে বলতে পার?
দেরি হবে। বিভিন্ন জায়গা থেকে অপরাধী ধরে ধরে সন্ধ্যাবেলায় থানায় নিয়ে যাবে। তবে সত্যি কথা বলতে কী, আমরা দু’জনই ভাগ্যবান।
আমরা ভাগ্যবান?
অবশ্যই। আমাদের দেশে র্যাব নামের এক বস্তু আছে। এরা আসামি ধরে কিন্তু থানায় জমা দেয় না।
তারা কী করে?
তারা থানা কোর্ট হাজত এইসবের ঝামেলায় যেতে চায় না। মেরে ফেলে।
মেরে ফেলে মানে?
কোনো এক ফাঁকা জায়গায় নিয়ে গিয়ে বলে, তোমাকে ছেড়ে দিচ্ছি।
দোউ দাও। ঝেড়ে দৌড দেবে। খবরদার পেছনের দিকে তাকাবে না। অপরাধী ঝেড়ে দৌড় দেয়, তখন পেছন থেকে গুলি।
ফার্গুসেন তাকিয়ে আছেন, আমি হাসিমুখে বললেন, এই জন্যেই আপনার প্রিয় কবি Robert Frost বলেছেন-The hurt is not enough.
আজ হিমুর বিয়ে – পর্ব ৭
আমরা হাজতে বসে আছি। হাজতবাস আমার জন্যে নতুন কোনো অভিজ্ঞতা না। আমরা খারাপ লাগছে না। দেয়ালে হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে বসে থাকার আলাদা আনন্দ আছে। নিজেকে সক্রেটিস সক্রেটিস মনে হয়। সক্রেটিস তাঁর শেষ সময় এরকম ছোট্ট একটা ঘরে পা ছড়িয়ে বসেছিলেন। তার সামনে ছিল হেমলক বিষের পেয়ালা হাত জল্লাদ। সক্রেটিস জল্লাদকে বললেন, আশা করি তুমি তোমার কাজ ভালো মতো জানো। পেয়ালায় চুমুক দিয়ে শেষ করার পর আমার কী হবে বলো তো! জল্লাদ বলল, প্রথমে আপনার দু’টা পা ভারি হয়ে যাবে। তকন বুঝতে হবে বিষ ক্রিয়া করতে শুরু করেছে। তখন আপনি শুয়ে পড়বেন। ঘুমে আপনার চোখ জড়িয়ে যাবে।
সক্রেটিস অবাক হয়ে বললেন, পুরো ব্যাপারটা ঘুমের মধ্যে ঘটলে আমি মৃত্যু অনুভব করব কীভাবে? আমি মৃত্যু অনুভব করতে চাই।
সক্রেটিস তাঁর চারপাশের জগৎ সবসময় অনুভব করতে চাইতেন। আমরা সাধারণ মানুষ। আমরা অনুভবের ধার ধারি না। হাজতখানা কেউ অনুভব করতে চাইছেন না। ড. ফার্গুসেন হতভম্ব অবস্থায় আছেন। মনে হচ্ছে তিনি এখন জাগতিক অনুভবের ঊর্ধ্বে। একবার তিনি শুধু তূর্যকে দেখিয়ে বললেন, এই ছেলেটিও কি ক্রিমিন্যাল?
আমি বললাম, জি।
এমন রূপবান, ইনোসেন্ট লুকিং ইয়াংম্যান। সে ক্রিমিন্যাল?
ক্রিমিন্যালের চেয়েও বড় কথা সে ড্রাগ অ্যাডিক্ট।
তুমি তাকে চেন কীভাবে?
আমি জবাব না দিয়ে হাসলাম। ড. ফার্গুসেন বললেন, ছেলেটির সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করছে।
কথা বলুন।
তোমাদের আইন কী বলে? ক্রিমিন্যালরা কি নিজেদের মধ্যে কথা বলতে পারে?
ক্রিমিন্যাল তো ক্রিমিন্যালদের সঙ্গেই কথা বললে। সাধু কথা বলবে সাধুর সঙ্গে। আপনি নিজেও ক্রিমিন্যাল। গাড়ি চোরদের সঙ্গে যুক্ত। আপনি অন্য আরেকজন ক্রিমিন্যালের সঙ্গে কথা বলবেন, সেটাই স্বাভাবিক।
এই জটিল সমস্যা থেকে উদ্ধার পাওয়ার উপায় কী? তোমার কি মনে হয় না আমার একজন ল’ইয়ারের সঙ্গে কথা বলা উচিত এবং আমার অ্যাম্বেসিকেও জানানো উচিত?
আমি হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লাম। ফার্গুসেন বললেন, আমার ইউরিনেট করার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। এখানে বাথরুমের ব্যবস্থা কী?
জটিল অবস্থা হলে পুলিশ ভাইদের হাতে-পায়ে ধরে বাথরুমে যাওয়া যায়।
সবসময় পুলিশ ভাইরা রাজি হয় না।
তকন কী করা হয়?
কাপড়চোপড় নষ্ট করতে হয়। আপনি বরং এই ছেলের সঙ্গে কথা বলুন। জটিল কোনো বিষয় নিয়ে আলোচনা শুরু করুন। তাহলে বাথরুমের ব্যাপারটা আপাতত ভুলে থাকতে পারবেন।
ফার্গুসেন তূর্যের দিকে এগিয়ে গেলেন, সংকোচের সংঙ্গেই হাত বাড়িয়ে বললেন, হ্যালো!
তূর্য নিখুঁত ইংরেজিতে চমৎকার উচ্চারণে বলল, আপনি রেনুর বাবা। আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে সম্মানিত বোধ করছি।
ফার্গুসেন হতভম্ব। কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে বললেন, তুমি আমাকে চেন কীভাবে?
তূর্য বলল, আমি আপনার অনেক ছবি দেখেছি। রেনুর কাছে দেখেছি।
রেনুর সঙ্গে তোমার পরিচয় আছে?
জি।
তুমি কি সেই ভয়ঙ্কর ড্রাগ অ্যাডিক্ট যার কাছ থেকে আমাকে মেয়েকে আলাদা রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে?
জি।
তোমাকে দেকেহ মনে হয় না তুমি অ্যাডিক্ট। তুমি কি সত্যি অ্যাডিক্ট?
জি। একসময় ছিলাম। এখন ছেড়ে দিয়েছি।
কবে ছাড়লে?
আজই ছেড়েছি। আজ সকাল এগারোটায় ছেড়েছি।
আবার কখন ধরবে?
মনে হয় না আবার ধরব। হাজতখানায় আমাকে এক পুরিয়া হিরোইন দেয়া হয়েছে। এখনো ব্যবহার করি নি, পকেটে নিয়ে বসে আছি। কাজেই আমি এখন নিশ্চিত যে, আমার ভেতর মানসিক শক্তিটা তৈরি হয়েছে।
হাজতে তোমাকে হিরোইন কে সাপ্লাই দিল?
তূর্য হাত ইশারায় আমাকে দেখিয়ে দিল। ফার্গুসেন আমার কাছ থেকে একটু সরে বসলেন। তিনি এখন আমার দিকে ভীত চোখে তাকাচ্ছেন। যে মানুষ হাজতে হিরোইন সাপ্লাই করে সে সহজ ব্যক্তি না। তার কাছ থেকে যত দূরে থাকা যায় ততই ভালো। হাজতের ঘর ছোট, বেশি দূরে যাওয়া সম্ভবও না।
আমি উদাস মুখে বসে আছি। মহান দার্শনিকের মতো জীবনকে অনুভব করার চেষ্টা করছি। কী ঘটছে আমার চারপাশে? তেমন কিছু ঘটছে না। তূর্য এবং ফার্গুসেন নিচু গলায় কথা বলছেন। তাদের বডি ল্যাংগুয়েজ বলে দিচ্ছে তারা একে অন্যকে পছন্দ করেছেন। ফার্গুসেনের পছন্দের মাত্রাটা বেশি। কারণ তিনি এখন তূর্যকে কবিতা আবৃত্তি করে শোনাচ্ছেন।
When you old and grey and full of sleep,
And nodding the fire, take down this book,
And slowly read, and dream off the soft look
Your eyes had once, and off their shadows deep;
তূর্য আগ্রহ করে শুনছে। তার চোখ জ্বলজ্বল করছে। হাজতের এক কোনায় কম্বল মুড়ি দিয়ে একজন শুয়ে আছে, তার মুখ দেখা যাচ্ছে না। প্রচণ্ড গরমে কম্বল মুড়ি দিয়ে সে কেন শুয়ে আছে সেই রহস্যও ভেদ হচ্ছে না। মেঝেতে কেউ চা ফেলেছে। চায়ের উপর কিছু মাছি ভনভন করছে। এক্সপোর্ট কোয়ালিটির কিছু মশা দেখা যাচ্ছে। এরা প্রাণশক্তিতে ভরপুর। দিনের আলো অগ্রাহ্য করে উড়াউড়ি করছে। এদের ভয়ডরও মনে হয় কম। হাতের নাগালের মধ্যেই উড়ছে। এই হচ্ছে হাজতের ভেতরের জীবন। এখানে কিছুই ঘটছে না, তবে অনেক কিছুই ঘটার সম্ভাবনা।
আমার ক্ষীণ সন্দেহ কম্বল মুড়ি দেয়া লোকটা মৃত। গায়ে যাতে দাগ না পড়ে তার জন্য কম্বল দিয়ে মুড়িয়ে পেটানোর একটা বিশেষ পদ্ধতি পুলিশের আছে। হঠাৎ হঠাৎ পদ্ধতিতে সামান্য গণ্ডগোল হয়। আসামি মারা যায়। পুলিশের তাতে তেমন অসুবিধা হয় না। হার্ট অ্যাটাকে মানুষ তো কতই মরে। পুলিশের ডেডবডি ডিসপোজাল সিস্টেমও ভালো। সম্ভব অসম্ভব যে-কোনো জায়গায় তারা ডেডবডি ফেলে দিয়ে আসতে পারে। নিজেদের পানির ট্যাংকে ডেডবডি ফেলে সেই পানি খেতেও তাদের আপত্তি নেই।
কম্বলে মোড়া মানুষটা যে মৃত তা ভাবার পেছনে আমার প্রধান কারণ হচ্ছে—কয়েকটা পিঁপড়ার সারি ঐ দিকে যাচ্ছে। পিঁপড়ার সারি কখনো জীবন্ত মানুষের দিকে যায় না। জীবন্ত মানুষকে পিঁপড়ারা ভয় করে।
আমি চোখ বন্ধ করে দেয়ালে হেলান দিলাম। হাজত নাটকের যবনিকাপাতের সময় হয়ে গেছে। যে-কোনো সময় গাড়ি উদ্ধারের জন্যে খালু সাহেব চলে আসবেন। হাজতে তাঁর বন্ধুকে দেখে যতটুকু বিস্মিত হওয়া প্রয়োজন তারচে’ অনেক বিস্মিত হবেন। ফার্গুসেন হাজত থেকে একা বের হবেন না, তূর্যকে নিয়ে বের হবেন। হাজত নাটকের যবনিকা ঘটবে।
আমি তূর্যকে বললাম, তোমাকে যে টেলিফোনটা দিয়েছিলাম সেটা দাও তো। খালার সঙ্গে কথা বলি।
প্রয়োজনের সময় নেটওয়ার্ক ব্যস্ত থাকে কিংবা ফোনের চার্জ থাকে না। নেটওয়ার্ক আছে, ফোনে চার্জও আছে। কাজেই এখন সময় সাধারণ।
হ্যালো মাজেদা খালা।
তুই কোথায়?
আমি ভালো জায়গাতেই আছি। খালু সাহেব কোথায়? উনার গাড়ি যে উদ্ধার হয়েছে এই খবর উনি জানেন?
হ্যাঁ জানে। যে হারামজাদা গাড়ি চুরি করেছিল, পুলিশ তাকে ধরেছে। সে সব স্বীকার করেছে। পুলিশের ডলা খেয়েছে। স্বীকার না করে উপায় আছে?
খালু সাহেব কোথায়?
সে নারায়ণগঞ্জ ছিল, ঢাকা ফেরার পথে ট্রাফিক জ্যামে আটকা পড়েছে। রাস্তা বন্ধ। গাড়ি ভাংচুর হচ্ছে। কতক্ষণে এই জট খুলে কে জানে!
বিয়ের কনের কী অবস্থা?
রেনু ভালো আছে। হাসিখুশি।
বিয়ের শাড়ি পরেছে?
না। এত সস্তার শাড়ি এই মেয়ে পরবে! তুই কী মনে করে এই শাড়ি কিনলি?
রেবু বলেছিল ব্লেড দিয়ে হাত কাটবে—এখন নিশ্চয়ই তেমন কিছু বলছে না?
না। সে কিছুক্ষণ আগে শাওয়ার নিয়েছে। নিজে বানিয়ে এক কাপ কফি খেয়েছে। আমাকেও বানিয়ে দিয়েছে। তুই কতক্ষণে আসবি?
একটু দেরি হবে।
দেরি হলেও অসুবিধা নেই। দেরি হওয়া বরং ভালো। এর মধ্যে তোর খালুও চলে আসবে। বাড়িতে একটা বিয়ে হবে, সে থাকবে না—এটা কেমন কথা!
ফার্গুসেন কঠিন চোখে আমার দিকে তাকাচ্ছে। তাঁর দৃষ্টিতে শঙ্কা। আমি তাঁকে হাসিমুখে বললাম, আপনার জন্যে একটা ভালো খবর আছে, আরেকটা খারাপ খবর আছে। কোনটা আগে শুনতে চান?
ভালো খবরটা কী?
রেনু ঠিক করেছিল, ব্লেড দিয়ে হাতের রগ কেটে স্যুইসাইড করবে। এই প্রজেক্ট মনে হচ্ছে বাতিল। সে আনন্দে আছে। একটু আগে নিজের হাতে কফি বানিয়ে খেয়েছে।
রেনু ব্লেড দিয়ে হাতের রগ কাটতে চাচ্ছিল?
জি। ব্লেড আমি কিনে দিয়ে এসেছিলাম।
তুমি কিনে দিয়ে এসেছিলে?
জি।
জানতে পারি কেন?
আমি সবসময় চাই, সবাই যেন তাদের পরিকল্পনা কার্যকর করতে পারে। অন্যের পরিকল্পনায় সাহায্য করাকে আমি মানবিক ধর্ম মনে করি।
তোমার মানসিক সুস্থতা বিষয়ে আমার সন্দেহ হচ্ছে।
এটা দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপার। একজন মহান দার্শনিক বলেছেন—‘তুমি নিজেকে যা মনে করো তুমি তাই। তুমি যদি নিজেকে মহাপুরুষ ভাব তুমি মহাপুরুষ। আর তুমি যদি নিজেকে পিশাচ ভাব তুমি পিশাচ।’
যে মহান দার্শনিক এই কথা বলেছেন তাঁর নাম জানতে পারি?
তিনি আমার বাবা। মহাপুরুষ বানাবার তিনি একটি স্কুল খুলেছিলেন। তিনি একটি স্কুল চালাতেন। আমি সেই স্কুলের ছাত্র। তবে দুঃখের বিষয় হচ্ছে গ্র্যাজুয়েশনের আগেই বাবা মারা গেলেন।
দয়া করে চুপ কর, আর কিছু জানতে চাচ্ছি না। খাবার খবরটা কী?
খারাপ খবর হলো—আপনার রিলিজ পেতে একটু দেরি হবে। যিনি আপনাকে রিলিজ করবেন, তিনি রাস্তার ট্রাফিক জ্যামে আটকা পড়েছেন। গাড়ি ভাংচুর হচ্ছে। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে তিনি যে গাড়িতে আছেন সেটা ভাঙা হবে।
গাড়ি ভাঙচুর হচ্ছে কেন?
আমাদের এখানে গাড়ি ভাঙচুর করতে কারণ লাগে না। যে-কোনো কারণে মেজাজ খারাপ হলে আমরা প্রথম যে কাজটা করি সেটা হচ্ছে গাড়ি ভাঙচুর। আমি এক্ষুনি খোঁজ নিয়ে জানাচ্ছি—গাড়ি ভাঙচুরের অবস্থা কী?
তোমাকে কোনো খোঁজ নিতে হবে না।
আমি উনার আপত্তি অগ্রাহ্য করেই খালু সাহেবকে টেলিফোন করলাম। তাঁর টেলিফোন ব্যস্ত। অনেক টেপাটিপি করে তাঁকে পাওয়া গেল। তিনি বিরক্ত গলায় বললেন, কী চাও?
আমি আগ্রহের সঙ্গে বললাম, আপনার গাড়ি তো পাওয়া গেছে।
খালু সাহেব বললেন, পুলিশ তাই জানিয়েছে। কোথায় গেছে, গাড়িচোর ধরা পড়ল কি-না কিছুই না বলে টেলিফোন রেখে দিল। এরপর থেকে কতবার যে টেলিফোন করলাম—কেউ টেলিফোন ধরে না।
খালু সাহেব, গাড়িচোর ধরা পড়েছে। সে হাজতে আছে।
বদমাইশ মকবুলটা কি ধরা পড়েছে?
না। পুলিশ তার দিকে ধাওয়া করার আগেই সে এক দৌড়ে হাওয়া।
গাড়ি আছে কোথায় জানো?
গাড়ি আছে ধানমণ্ডি থানায়। ওসি সাহেবের নির্দেশে কিছুক্ষণের মধ্যেই ফুল-টুল দিয়ে গাড়ি সাজানো হবে।
ফুল দিয়ে গাড়ি সাজানো হবে মানে?
বরের গাড়ি, না সাজালে কি হয়? বর তার বন্ধুবান্ধব নিয়ে এই গাড়িতে করেই যাবে।
বর মানে? বরটা কে?
এত তাড়াতাড়ি সব ভুলে গেলেন? বর আমি।
হিমু, Enough is enough.
জি আচ্ছা।
তুমি কখনো আমার সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করবে না।
কখনো না।
সরাসরি দেখা তো করতে পারব?
তাও পারবে না।
বিয়ের পর আমরা স্বামী-স্ত্রী কি আপনাকে কদমবুসিও করব না?
তুমি কোনো একটা খেলা নিয়ে মেতেছ। বিশেষ কোনো খেলা খেলছ। আমি তোমার খেলায় নেই।
জি আচ্ছে।
মনে রেখো, টেলিফোনে সরাসরি আমার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করবে না।
আপনি যদি টেলিফোন করেন তখন কি ধরব?
আমি তোমাকে নিশ্চিত করছি—কখনো তোমাকে টেলিফোন করব না। Never ever. তোমার খালা এবং আমি ভিন্ন ব্যক্তি। দুইজন দুই গ্রহে বাস করি। তোমার খালা অকারণে তোমাকে দিনের মধ্যে একশবার টেলিফোন করবে। কারণ তার টেলিফোনে কথা বলার ব্যাধি আছে। আমার নেই। এটা তোমার সঙ্গে আমার শেষ সংলাপ। আর তোমার সঙ্গে কথা হবে না।
খালু সাহেবম আমার ধারণা কিছুক্ষণের মধ্যেই আপনি আবার আমাকে টেলিফোন করবেন। আমি সেই টেলিফোন ধরব না। কিন্তু আপনি করতেই থাকবেন। করতেই থাকবেন।
Stupid!
খালুসাহেব, Stupid শব্দের উৎপত্তি কি আপনি জানেন? সর্বপ্রথম এই শব্দ ব্যবহার করা হয় অ্যাথেন্সবাসীদের প্রতি। সমগ্র অ্যাথেন্সবাসীকেই Stupid বলা হয়েছিল, কারণ তারা গণতান্ত্রিক কার্যক্রমে অংশ নেয় নি।
চুপ ফাজিল!
ফাজিল শব্দের অর্থ জানলে আপনি আমাকে এই গালি দিতেন না। এটা আরবি ভাষার একটা শব্দ। এর অর্থ জ্ঞানী।
খালুসাহেব লাইন কেটে দিলেন। এই কাজটা তাঁর আরো আগেই করা উচিত ছিল। এতক্ষণ কেন করলেন না কে বলবে!
আমি কম্বল মোড়া ডেডবডির দিকে তাকিয়ে খালু সাহেবের টেলিফোনের অপেক্ষা করছি। তিনি টেলিফোন করলেন না। মাজেদা খালা করলেন।
হ্যালো খালা!
হ্যালো। কী জন্যে টেলিফোন করেছি ভুলে গেছি। অথচ তোর সঙ্গে জরুরি কথা ছিল। জরুরি কথা বলার জন্যে চুলায় গরুর মাংস রেখেই চলে এসে টেলিফোন করলাম—এখন কিছুই মনে পড়ছে না। কী করি বল তো?
আমি বুদ্ধি করে কথাটা তোমার মাথার ভেতর থেকে বের করে নিয়ে আসতে পারি। চেষ্টা করব?
কর।
কেউ একজন তোমাকে এমন কিছু বলছে তা তোমার আমাকে বলার কথা। সেই কেউ একজন তোমার তেমন পরিচিত না পরিচিত হলে নাম মনে পড়ত…।
থাক থাক আর বলতে হবে না। এখন সব মনে পড়েছে। রেনুর মা টেলিফোন করেছিলেন। তোকে চাচ্ছিলেন। রেনুর বাবা সম্পর্কে জানতে চাচ্ছিলেন। তোর তাঁকে এয়ারপোর্ট থেকে নিয়ে আসার কথা।
নিয়ে তো এসেছি।
উনি কোথায়?
উনি হাজতে।
হাজতে মানে?
পুলিশ চুরির অপরাধে তাঁকে হাজতে ঢুকিয়ে দিয়েছে। উনার পেয়েছে বাথরুম। এখনো বাথরুমে যাবার সুযোগ পান নি। শাদা চামড়া হিসেবে পুলিশ যে extra খাতির করবে, তা করছে না।
কী আবোলতাবোল বকছিস?
আবোলতাবোল হলেও যা বলছি সবই সত্যি। তুমি মনে করে দেখ তো—আমি কিখনো এমন কিছু বলেছি যা পরে দেখা গেছে সেটা মিথ্যা?
উনি কার গাড়ি চুরি করেছেন?
খালু সাহেবের গাড়ি। তবে উনি সরাসরি চুরির সঙ্গে যুক্ত না। উনি পাকচক্রে ধরা খেয়েছেন।
তোর খালু সাহেব কি ঘটনা জানে?
না। তুই নিজে কোথায়?
আমিও হাজতে।
খালা টেলিফোন নামিয়ে রাখলেন। মনে হয় অধিক শোকে লোহা, পাথরের চেয়েও কঠিন।
তোকে আল্লার দোহাই লাগে, সত্যি কথা বল।
আমি সত্যি কথাই বলছি। তুমি কি ফার্গুসেন জুনিয়রের সঙ্গে কথা বলবে?
খালা কিছু বললেন না। আমি টেলিফোন ফার্গুসেনের দিকে বাড়িয়ে বললাম, একটু কথা বলুন তো। ওপাশে আমার মাজেদা খালা। বলুন, হ্যালো মাজেদা। হাউ আর ইউ।
ফার্গুসেন যন্ত্রের মতো বললেন, হ্যালো মাজেদা। হাউ আর ইউ।
যা ভেবেছিলাম তাই হচ্ছে। খালু সাহেবের টেলিফোন আসতে শুরু করেছে। একের পর এক আসছে, আমি কেটে দিচ্ছি। মানুষটা রাগে চিড়বিড় করছে ভেবে আনন্দ পাচ্ছি। আমার আনন্দ পাবার জন্যে আরেকজনকে রাগে ছটফট করতে হচ্ছে। সব মিলিয়ে সমান। অংকের ভাষায়—
আনন্দ = f(x, y, z)
x = কষ্ট, y = বেদনা, z = দুঃখ
দুঃখ = বেদনা
আনন্দ – f(x, y, z) = 0
একজন ম্যাসাজম্যান গা টিপে অন্য একজনকে শারীরিক আরাম দিচ্ছে। অন্য একজনকে এই আরাম দেয়ার জন্যে ম্যাসাজম্যানদে শারীরিক কষ্টের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে।
কম্বলে মুড়ি দেয়া মৃতদেহ নড়ে উঠল। কম্বলের ফাঁক দিয়ে ছোট্ট একটা মুখ বের হয়ে এলো। ডারউইন সাহেবের থিওরি যে সত্যি তার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। অবিকল বেবুনের মতো মুখ। চিকচিক করার বদলে সে আনন্দিত গলায় চেঁচিয়ে উঠল, হিমু ভাই, আমারে চিনেছেন? আমি ক্ষুর আসলাম।
চিনেছি।
র্যাবের হাতে ধরা খাইছি। প্রথমে ভাবছি ক্রসফায়ারে ফেলব। মতলব সেই রকমই ছিল। চাইপ্যা পায়ে ধরনের কারণে মাফ পাইছি।
ক্ষুরের কাজ কি চালিয়ে যাচ্ছ?
আপনে আমারে একবার ডলা দিলেন, এরপর থাইকা ক্ষুর অফ। এখন ঠগবাজি করি। একদিনে তো ভালো মানুষ হওয়া যায় না। ধাপে ধাপে হইতেছি। খারাপ একদিনে হওয়া যায়, ভালো হইতে টাইম লাগে। আপনের পাশে এই শাদা বান্দরটা কে?
প্রফেসর। ইংরেজির প্রফেসর।
প্রফেসর সাবও ধরা খাইছে! শান্তি পাইলাম। কেউ বিপদে পড়ছে দেখলে এমন শান্তি পাই। এর কারণটা কী হিমু ভাই?
এর কারণ হচ্ছে, তোমার মতোই একজন পৃথিবীতে আছে যে কাউকে বিপদে পড়তে দেখলেই কষ্ট পায়। তুমি হচ্ছ এ পজেটিভ আর ঐ লোক হচ্ছে এ নেগেটিভ। দুইয়ে যোগফল শূন্য। বুঝেছ?
অবশ্যই বুঝেছি—যত ভালো তত মন্দ। হিমু ভাই, এই শাদা চামড়াটার পাছায় একটা লাথি মারতে ইচ্ছা করতাছে।
মারতে ইচ্ছা করলে মারো।
ডা. ফার্গুসেন ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকালেন। তিনি প্রতিটা বাংলা বাক্য বুঝতে পারছেন, কাজেই আমার দিকে বিস্মিত হয়ে তাকানোর অধিকার তাঁর আছে। আচ্ছা বিস্মিতের বিপরীতটা কী?
ভালোবাসা ঘৃণা
রাগ শান্তি
দুঃখ আনন্দ
বিস্ময়ের উল্টাটা কী? ভাবলেশহীন।
বিস্মিত চোখের বিপরীত কি ভাবলেশহীন চোখ?
ফার্গুসেন আমার দিকে তাকিয়ে ভীত গলায় বললেন, এ কে?
আমি বললাম, স্যার এর নাম আসলাম। ক্ষুরের কাজের বিশেষ নৈপুণ্যের জন্যে তাকে এখন সবাই চিনে ক্ষুর আসলাম হিসেবে। ক্ষুর এখন তার টাইটেল।
ক্ষুরের কাজ মানে কী?
ক্ষুরের প্রধান কাজ দাড়িগোঁফ কামানো, মাথা কামানো, তবে আসলাম অন্য কাজে ব্যবহার করত। ছিনতাইয়ের সময় সে পেটের ভিতর ক্ষুর ঢুকিয়ে দিত।
কেন?
ঐটাই তার আনন্দ।
ফার্গুসেন চোখ বড় বড় করে ক্ষুর আসলামের দিকে তাকালেন। আসলাম হেসে ফেলল। হ্যাণ্ডশেকের জন্যে ফার্গুসেনের দিকে হাত বাড়াল। ভদ্রলোক ভয়ে আঁতকে উঠলেন। আসলাম বলল, আপনে বাংলা ভাষা ভালো জানেন, এই জন্যে হ্যাণ্ডশেক করতে চাই। আমার মায়ের ভাষা যে জানে আমার কাছে তার ভালো কদর।
ফার্গুসেনকে হ্যাণ্ডশেক করতে হলো। তাঁর চোখে রাজ্যের বিভীষিকা। ক্ষুর আসলাম ফার্গুসেনের দিকে ঝুঁকে এসে বলল, ক্ষুরের কাজ করলেও আমার মধ্যে ধর্ম ছিল। কোনো মেয়েছেলের পেটে ক্ষুর ঢুকাই নাই।
হাজতের দরজা খোলা হচ্ছে। দরজার ওপাশে ওসি সাহেব কঠিন চোখে আমার দিকেই তাকিয়ে আছেন।
হিমু!
জি স্যার।
এই বার আমি তোমাকে ছাড়ব না। আমার সন্তানের কসম, তোমার শেষ দেখে নিব।
মেরে ফেলবেন?
ওসি সাহেব কুইনাইন ট্যাবলেট মুখে দিয়ে আছেন এমন ভঙ্গি করে পাশে দাঁড়ানো কনস্টেবলকে বললেন, হ্যাণ্ডকাফ দিয়ে একে আমার কাছে নিয়ে আসো।
কম্বল জড়িয়ে শুয়ে থাকা ক্ষুর আসলাম বলল, ওসি সাব, হিমু ভাইয়ের কিছু হইলে আপনেরে কিন্তু কাঁচা খাইয়া ফেলামু।
ওসি সাহেব নির্বিকার ভঙ্গিতে বললেন, ক্ষুর আসলামকে আরেক দফা মাইর দেও।