বনমালীর সঙ্গে উদয়তারার এই শেষ দেখা।
৮.৩ ভাসমান
নদীতে নৌকা ভাসিলে উদয়তার ছইয়ের ভিতর চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। একটি কথাও বলিল না। একটানা কোরা টানিতে টানিতে তার স্বামী অধৈর্য হইয়া পড়িয়াছিল। আর থাকিতে না পারিয়া শেষে নিজেই কথা কহিল, ‘নিত্যর মামী, অ নিত্যর মামী, একটু তামুক নি খাওয়াইতে পারে।‘
তারা নদীবক্ষে একে অন্ত্যকে পাইয়াছে অনেকদিন পরে। কিন্তু উদয়তারার মনে কোনই উৎসাহ নাই। সে নির্লিপ্ত ভাবে কলকেতে তামাক ভরিল, মালসার আগুনে টিকা গুঁজিয়া দিল, লাল হইলে তুলিয়া হুকাটা ছইয়ের বাহিরে বাড়াইয়া দিয়া নিস্পৃহ কণ্ঠে বলিল, ‘নেউক, হুঙ্কা নেউক।‘
বনমালীর জন্য এক অব্যক্ত বেদনা তার মনে অনবরত লুটোপুটি খাইতেছে, তার স্বামী কোরা টানিতেছে আর চারিদিক দেখিতেছে। দুই পারের চাষীদের গ্রামগুলি তেমনি সবুজ। কিন্তু মালোদের পাড়াগুলি যখনই চোখে পড়িতেছে, তখনই বেদনায় বুক টনটন করিয়া উঠিতেছে। গাছগাছালি আছে, কিছু দিন আগে যেখানে যেখানে ঘর ছিল তার অনেকই এখন খালি-ভিটা। ঘাটে আগে সারি সারি নৌকা ছিল, এখন আর নাই। মাঝে মাঝে দুই একটা কেবল বাঁধা রহিয়াছে। যেখানে তারা জাল শুখাইত, এখন সেখানে গরু চরিতেছে। ঘরগুলি কোথায় লুকাইয়াছে, ভিটাগুলি নগ্ন। তার উপরে বাঁশের খুঁটির গর্ত, ভাঙা উনানের গর্ত, শিলনোড়া রাখার সিড়ি, মাটির কলসী রাখার সিড়ি আধ-ভাঙ্গা পড়িয়া আছে। উঠানে ঝরাপাতার রাশি, তুলসীমঞ্চ ভাঙ্গিয়া শত খান। প্রদীপ দেখাইবার কেউ নাই। মাঝেমাঝে দুই একটি বাড়ি এখনো আছে। তারা বড়ঘর বেচিয়া ছোটঘর তুলিয়াছে।
‘রাধানগর কিষ্টনগর মনতলা গোঁসাইপুর সবখানের দেখি একই অবস্থা?’ বলিয়া হাত বাড়াইয়া হুঁকা লইল।
নৌকা ঘাটে ভিড়িলে, উদয়তারা নামিতে নামিতে পাড়াটার দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া বলিল, ‘তোমার গেরামেও ত দেখি একই অবস্থা।’
সে অনেক দিন পর স্বামীর ঘর করিতে আসিয়াছে। সুবলার বউ তখন এই ঘাটেই স্নান করিতেছে। কিন্তু সেই যে গলা-জলে নামিয়া গাঁ ডুবাইয়াছে, আর উঠিবার নামও করিতেছে না।
‘কিলা বাসন্তী, জলে কি তোরে যাদু করছে। ‘টানে’ উঠবি না? তোর সাথে একখান কথা আছিল।’
সুবলার বউ গলা-জলে থাকিয়াই ঘাড় ফিরাইল, ‘বাসন্তী আছলাম ছোটবেলা, যখন মাঘমাসে ভেউরা ভাসাইতাম। তার পরে হইলাম কার বউ, তার পরে হইলাম রাঁড়ি। মাঝখানে হইয়া গেছলাম অনন্তর মাসী। অখন আবার হইয়া গেলাম বাসন্তী।’
‘আমারও ছোটকালেই বিয়া হইছিল। এই গাওয়ে আইয়া পাইলাম তোরে। বাড়ির লগে বাড়ি—দুইজনে এক সাথে গলায়-গলায় রইছি, তখনও যেমন তুই বাসন্তী অখনও তুই আমার তেমুনই বাসন্তী। নে উঠ, কথা আছে।‘
‘তোর সাথে আমার না একখান ঝগড়া আছিল কোন সত্যিকালে, মনে কইরা দেখ। তোর সাথে কথা কওন মানা।‘
উদয়তারার মন বেদনার্ত হইয়া উঠিল। যে-মানুষের গায়ে জীবনে কোনোদিন ‘ফুলটুঙি’র ঘা পড়ে নাই, তাকে সেদিন তারা কি নিষ্ঠুর ভাবে মারিয়াছিল। আজ সে নিস্তেজ, নিম্প্রভ। ঘাড়টা কেমন সরু হইয়া গিয়াছে। গালদুটি কেমন ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছে। মাথা-ভরতি কি লম্বা চুল ছিল। আজ সে চুলের অর্ধেকও নাই। বনমালীর মত এও যৌবন থাকিতে বুড়ি হইয়া গিয়াছে। আজ তাহাকে দেখিলেই মায়া জাগে। আজ হইলে উদয়তারা নিজের কপাল খাইয়াও তাহার গায়ে হাত তুলিতে পারিত না।
অগত্যা সে নিজেই ধীরে ধীরে গলাজল পর্যন্ত নামিল। বলিল, একদিন তোর হাতের মার খাইলে বড় ভাল হইত ভইন, বুকটা ঠাণ্ডা হইত। তোরে মাইরা যে আনল জ্বলল, সে আনল আর নিবল না। মিছা না বাসন্তী। তুই মারবি আমারে?’
‘আমি মারুম তোর শত্তুররে। নিশত্তুরী। তুই লাউয়ের কাঁটা ফুইট্যা মর, তুই শুকনা গাঙে ডুইব্য মর।‘
দুইজনের মনই হালকা হইয়া গেল।
‘অনন্তর কথা জানবার মনে লয় না?’
‘অনন্ত? ও অনন্ত। অনন্ত অখন কার কাছে থাকে?’
—অনন্ত কি এখনও তেমন ছোটটি আছে যে, কারো কাছে থাকিবে। সে কত বড় হইয়াছে। শহরে থাকিয়া এলে-বিয়ে পাশ করিয়াছে। দাদা পোনার ভার লইয়া আসিতে দেখিয়া আসিয়াছে। কত কথা বলিয়াছে। ভদ্রলোকের সঙ্গে থাকে। দেখিতেও হইয়াছে ঠিক যেন ভদ্রলোক।
—সুবলার বউ কেমন উদাস হইয়া যায় : ভদ্রলোকের সঙ্গে থাকে। ভদ্রলোকে যদি তারে যাত্রা শিখাইয়া নষ্ট করিয়া ফেলে।
—আ লো, না লো, তারা বাজারের ভদ্রলোক না, তারা পড়ালেখার ভদ্রলোক। তোর একখানা আমার একখানা কাপড় কিনিয়া দিয়াছে। আমারখানা আমার পরণে তোরখানা ঐ ‘টানে’। স্নানের শেষে একেবারে কোমরে গুঁজিয়াই বাড়ি যাইবি।
সুবলার বউ হঠাৎ আনমনা হইয়া যায়। কি ভাবিতে থাকে। কথা বলে না।
‘কি লা বাসন্তী, মনে বুঝি মানে না। আমারও মানে না। আমার ত ভইন কৃষ্ণহারা ব্রজনারীর মত অবস্থা। কিন্তু পরের পুত, তোরও পেটের না, আমারও পেটের না।’
—দূর নিশত্তুরী। আমি বুঝি তার কথা ভাবি। আমি ভাবি অন্য কথা। গত বর্ষার আগে চরটা ছিল ওই-ই খানে। তারপর এইখানে। এখন যেখানে গাঁ ডুবাইয়া আছি। পরের বছর দেখিবি এখানেও চর। গাঁ ডোবে না। এইবারে যত পারি ডুবাইয়া নেই, জন্মের মত।
বছর ঘুরিতে মালোরা সম্পূর্ণ অচল হইয়া পড়িল। নদীর তুই তীর ঘেঁষিয়া চর পড়িয়াছে। একটিমাত্র জলের রেখা অবশিষ্ট আছে। তাতে নৌকা চলে না। মেয়েরা স্নান করিতে যায়, কিন্তু গাঁ ডোবে না। উবু হইয়া মাটি খুঁড়িতে খুঁড়িতে একটা গর্তের মত করিয়াছে। তাতে একবার চিৎ হইয়া একবার উপুর হইয়া শুইলে তবে শরীর ডোবে। তাতেই কোন রকমে এপাশ ওপাশ ভিজাইয়া তারা কলসী ভরিয়া বাড়ি ফিরে। জেলেদের নৌকাণ্ডলি শুকনা ডাঙ্গায় আটকা পড়িয়া চৌচির হইয়া যাইতেছে। জলের অভাবে সেগুলি আর নদীতে ভাসে না। মালোরা তবু মাছ ধরা ছাড়ে নাই। এক কাঁধে কাঁধ-ডোলা অন্য কাঁধে ঠেলা-জাল লইয়া তারা দলে দলে হন্যে হইয়া ঘুরিয়া বেড়ায়। কোথায় ডোবা, কোথায় পুষ্করিণী, তারই সন্ধানে। গ্রামে গ্রামান্তরে ঘুরিয়া কোথাও ডোবা দেখিতে পাইলে, শ্যেন দৃষ্টিতে তাকায়। দেহ হাড্ডিসার চোখ বসিয়া গিয়াছে। সেই গর্তে-ডোবা চোখ দুইটি হইতে জিঘাংসার দৃষ্টি ঠিকরাইয়া বাহির হয়। জালের সামনাটা জলে ডুবাইয়া ঠেলা মারিয়া সামনের দিকে দেয় এক দৌড়। দুই চারিটা মৌরলা উঠে আর উঠে একপাল ব্যাঙ। ব্যাঙ গুলি লাফাইয়া পড়িয়া যায়। মাছগুলি থাকে। সেগুলি বেচিয়া কয়েক আনা পাইলে তাতে ঘরে চাউল আসে, না পাইলে আসে না। মনমোহন সারাদিন ডোবায় ডোবায় জাল ঠেলিয়াছে, কিন্তু উঠিয়াছে কেবল ব্যাঙ। মাছ উঠে নাই। চাউল না লইয়া শুধুহাতে বাড়িতে ফিরিয়া আসিয়াছে। ডোলাটা একদিকে ছুড়িয়া ফেলিয়া জালটা একটা বেড়ায় ঠেকাইয়া রাখিল। তার বুড়ি মা শুখাইয়া দড়ির মত হইয়া গিয়াছে। কয়েক বছর আগে সে বিবাহ করিয়াছিল। খাইতে না পাইয়া তার বউও শুখাইয়া যাইতেছে। তার দিকে আর তাকানো যায় না। তার বাপ দাওয়ার উপর বসিয়া তামাক টানিতেছে। মা আর বউ দুইজনেই আগাইয়া আসিয়াছিল, চাউলের পুটুলি তার সঙ্গে দেখিতে না পাইয়া, নীরবে ঘরের ভিতরে চলিয়া গেল। আজ কারো খাওয়া হইবে না। কালও হইবে কিনা তাও জানা যায় নাই। অথচ বাপ কেমন নিরুদ্বিগ্ন মনে তামাক টানিতেছে।