অনন্তবালা চুপি চুপি তাকে আসিয়া বলিল, ‘অ বনমালী দা, কাপড় দিল তোমারে একখান, মাসীরে একখান, উদি বোনদিরে একখান, আমারে একখান দিল না?’
—নিশ্চয়ই দিত। আমি যে তোমার কথা তাকে বলিই নাই।
— বল নাই। কেন বল নাই।
—চিনিতে পারিবে না যে। আমারেই কত কষ্টে চিনিয়াছে।
—চিনিতে পারিবে না কেন। আমার কি তোমার মত দাড়ি হইয়াছে, না, আমি তোমার মত বুড়া হইয়া গিয়াছি।
বনমালীর বোন উদয়তারারও বয়স বাড়িয়াছে। শরীরের লাবণ্য গিয়াছে। কিন্তু মনের রঙ মুছিয়া যায় নাই। নূতন বর্ষায় তিতাসে আবার নূতন জল আসিয়াছে। স্বপ্নের মত অভাবিত এই জল। কি স্বচ্ছ। বুকজলে নামিয়া মুখ বাড়াইলে মাটি দেখা যায়। এই মাটিটাই সত্য। এই মাটিই যখন জাগিয়া উঠিত প্রথম প্রথম দুঃস্বপ্ন বলিয়া মনে হইত। এখন ঐ মাটিই স্বাভাবিক। জল যে আসিয়াছে ইহা একটা স্বপ্নমাত্র। মনোহর। কিন্তু যখন চলিয়া যাইবে ঘোরতর মরুভূমি রাখিয়া যাইবে। সে মরুভূমি রেণু রেণ, করিয়া খুঁজিলেও তাতে একটি মাছ থাকিবে না। তবু সেই জলেই গাঁ ডুবাইয়া উদয়তারার খুশি উপছাইয়া উঠিল। সেই ঘাটে অনন্তবালাও গাঁ মেলিয়া ধরিয়াছে। ছোট ঢেউগুলি তার চুলগুলিকে নাড়াচাড়া করিতেছে দেখিয়া উদয়তারা বলিয়া উঠিল, ‘জিলাপির পেচে-পেচে রসভরা, মগু কি ঠাণ্ডা লাগে জল ছাড়া। যতই দেখ মেওয়া-মিছরি কিছু এই জলের মতন ঠাণ্ডা লাগে না। অনন্তর ত অস্ত নাই। জলের তবু অস্ত আছে। লও, ভইন ডুব দেই।’
‘কেন গো দিদি। আমরা কি বাজারের গামছা না সাবান যে ডুইব্যা তলায় পইড়া ক্ষয় হমু। তোমার যদি জ্বালা হইয়া থাকে, জুড়াইতে চাও, তবে তুমি ডোব।’
‘আমার ত ভইন কেশটি পড়িল দন্তটি নড়িল যৈবনে পড়িল ভাটি। আমার আবার জ্বালা কি?’
এইবার কথায় তার বয়সের খোঁটা আসিয়া পড়িবে আশঙ্কা করিয়া অনন্তবালা জল হইতে উঠিয়া পড়িল। কাপড়খানা বুকের উপর দুই তিন ভাজে বিছাইয়া বাড়িমুখে হইল।
‘আহা আমি যেন মারছি না ধরছি’ বলিয়া উদয়তারাও উঠিয়া পড়িল।
ভিজা কাপড়। আলুলায়িত চুল। কয়েক পা যাইতেই পাশের ঘাট হইতে দুইজনের কথাবার্তা তার কানে গেল। একটা লোক নৌকা ভিড়াইয়া খুঁটি পুতিল এবং দড়ি দিয়া নৌকা বাধিল। অন্য লোকটি ঘাটে দাঁড়াইয়া বলিতেছে, নিতে আসিয়াছ বুঝি? হাঁ। না দেখিলে বুঝি অন্তর দাহনি করে? করে। তা বেশ। বুদ্ধিমানের মতই কাজ করিয়াছ। গাঙে জল থাকিতে থাকিতে নিয়া যাও। সুদিনে গাঙ যতদিন শুকনা ছিল, ততদিন তুমি আস নাই। জল শুকাইবার সঙ্গে সঙ্গে তোমার প্রেমও শুকাইয়া গিয়াছিল, কেমন কহিলাম? হা, কথা কিছু মিছা বল নাই। তা শুক্না গাঙে তুমি কেমন করিয়াই আসিতে! নৌকা ত আর কাঁধে করিয়া আনিতে পারিতে না? না। তা তুমি যাই কও আর তাই কও, আমি কিন্তু সাঁচা কথাখান কই, ‘যদি থাকে বন্ধুর মন, গাঙ পার হইতে কতক্ষণ?’ মনে থাকিলে গহীন গাঙে কি করিবে। মনে থাকিলে মরাগাঙেও আটকাইতে পারে না; গানে আছে না, ‘ভেবে রাধারমণ বলে, পিরিতের নাও শুকনায় চলে।‘ কেমন কহিলাম। হাঁ, কথা তুমি কিছু মিছা কও নাই।
উদয়তারাকে তার স্বামী নিতে আসিয়াছে।
আজ বনমালীর দিকে সে নূতন করিয়া চাহিল। নূতন এক রূপে তাহাকে দেখিতে পাইল। যতবার চায় তার বুক সমবেদনায় ভরিয়া উঠে। দাদাকে জড়াইয়া ধরিয়া হু হু করিয়া কাঁদিতে চায় সে।
বনমালী দিন দিন শুকাইয়া যাইতেছে। কিই বা তার বয়স। তবু ইহারই মধ্যে তাহাকে অনেক বুড়া দেখাইতেছে। তার উপর একমাথা চুল একমুখ দাড়ি। কটিতে ছেঁড়া গামছা, কাঁধে ছেঁড়া গামছা। গাঙ ত তার একার জন্য শুকায় নাই। সব জেলের জন্যই শুকাইয়াছে। তারা বুঝি আর চিন্তা করে না। না কি দাদা সমস্তের চিন্তা একলা মাথায় করিয়া তারই ভারে নুইয়া পড়িতেছে। এখনো ত কিছু কিছু রোজগার হয়; পেটে দুইটা দানা পড়ে। পরে যখন রোজগারে আরো ভাঁটা পড়িবে, তখন কি সকলে না মরিতে দাদাই আগে মরিবে। দাদার প্রতি স্নেহে ও করুণায় বুক ভরিয়া উঠে; কিন্তু তারই আড়ালে জাগিয়া থাকে একটা অস্ফূট হাহাকার।
‘দাদা, তুমি একটা ফুলের নাম কও ত!’
বনমালী মলিন মুখে একটু হাসিল, ‘আমার লাগি তুই দিশা চাইবি বুঝি। আছিলি জামাই-ঠকানী, অখন হইলি গণকঠাকুরাইন।‘
‘ঠিসারা রাখ। তুমি অত শুকাইয়া যাইতাছ কেনে? গাঙে জল ত অখনো আছে।’
—-আছে টুনির মুত। বছরের পাঁচ রকম জো-এ পাঁচ কিসিমের জাল ফেলিতাম। রাজার হালে মাছ ধরিতাম। সেই দিন গেছে। তার কথা এখন স্বপ্নে দেখিলেও বিশ্বাস হয় না। স্বাধীনভাবে জাল ফেলিতাম জাল তুলিতাম। এখন করি পরের গোলামি। পোনার ভার বহিতে বহিতে কাঁধে কড়া বাঁধিয়াছে, কোমরও কুঁজা হইয়া আসিতেছে। কিন্তু তার জন্যও ভাবি না। আমি ভাবি, সামনের সুদিনে মালোগুষ্টির কি অবস্থা হইবে।
ধৈর্যহীন স্বামীর তাগিদে কাতর হইয়া উদয়তারা বনমালীর গলা জড়াইয়া কাঁদিয়া ভাসাইল। বনমালী তার হাত ছাড়াইতে ছাড়াইতে বলিল, ‘পাগলামি করিস না। কথা রাখ। অখন বুঝি তর কান্দবার বয়স আছে!’
উদয়তারা ফোঁপাইতে ফোঁপাইতে বলিল, ‘দাদা, তোমার মাথায় বুঝি আর শোলার মটুক উঠল না।’
‘শোলার মটুক উঠব। মড়াপোড়ার টেকে গিয় উঠব। তুই কান্দিস না।’