বিধির বিধানে বর্ষার স্থায়িত্বের একটা সীমারেখা আছে। তার দিন ফুরাইলে তিতাস আবার সেই রকম হইয়া গেল। তার বুকের চরটা নগ্ন হইয়া জাগিয়া উঠিল। এবার সেটা আয়তনে আরো বাড়িয়াছে। উজানের দূরদূরান্তর হইতে একেবারে মালোপাড়ার ঘাট পর্যন্ত সেটা প্রসারিত হইয়া পড়িয়াছে।
এবারও কৃষকেরা লাঠি লইয়া দখল করিতে আসিবে। রামপ্রসাদ ঘুরিয়া ঘুরিয়া জেলেদের উত্তেজিত করিতে চেষ্ট৷ করিল, ওরা কৃষক। ওদের জমি আছে। ওরা আরো দখল করিবে। যতদিন জল ছিল, আমাদের ছিল দখল। এখন জল গিয়াছে। তার মাটিও এখন আমাদেরই। ওরা অতদূর হইতে আসিয়া দখল করিয়া নিবে, আর এত নিকটে থাকিয়া আমরা জেলেরাই বা নিশ্চেষ্ট থাকিব কেন।
নিজেদের মধ্যে দীর্ঘকাল দলাদলির ফলে তারা একযোগে কাজ করার ক্ষমতা একেবারেই হারাইয়া ফেলিয়াছিল। তাই মারামারির নাম শুনিয়া আঁতকাইয়া উঠিল। বলিল; গাঙ শুখাইয়া জল গিয়াছে, তার সঙ্গে আমরাও গিয়াছি, এখন মাটি নিয়া কামড়াকামড়ি করিতে আমরা যাইব না। তোমার সাধ হইয়াছে তুমি একলা যাও।
রামপ্রসাদ একলাই গিয়াছিল। তার বাড়ি-সোজা চরের মাটি দখল করিবার জন্য নিশ্চিত মৃত্যু জানিয়াও ঝাঁপাইয়া পড়িল। জোয়ান ভাইদের পাশে রাখিয়া লড়াই করিতে করিতে বৃদ্ধ সেই মৃত্যুও বরণ করিল। করম আলি বন্দে আলি প্রভৃতি ভূমিহীন চাষীরাও আসিয়াছিল, কিন্তু মার খাইয়া ফিরিয়া গিয়াছে। কেহ এক খামচা মাটিও পাইল না। তবে পাইল কে। দেখা গেল, যারা অনেক জমির মালিক, যাদের জোর বেশি, তিতাসের বুকের নয়-মাটির জমিনের মালিকও হইল তারাই।
তাতে জেলেদের কিছু যায় আসে না। কারণ যেদিন
থেকে জল গিয়াছে সেদিন থেকে তারাও গিয়াছে।
উপরি উপরি কয়েকটা বছর ঘুরিয়া গেল। এবারের বর্ষার পর নবীনাগর গ্রামের জেলেদেরও টনক নড়িল। ভাসমান চরটা ভাসিতে ভাসিতে তাদের গ্রাম পর্যন্ত ছড়াইয়া গিয়াছে। অনন্তবালার বাপ বিষম ভাবনায় পড়িয়াছে। একদিন বনমালীকে ডাকিয়া বলিল, ‘একবার দেখনা, তার নি খোঁজ পাও।’
অনন্তবালার বয়স বাড়িয়াছে। তার বয়সের অন্যান্য মালোর মেয়েরা সকলেই স্বামীর ঘর করিতে চলিয়া গিয়াছে। সে এখনো মাঘমণ্ডলের পুজা করে। অনন্ত নাকি তাকে বলিয়া গিয়াছে। লেখাপড়া শিখিয়া সে যেদিন ফিরিয়া আসিবে, সেদিন সে যাহা বলিবে অনন্ত তাহাই করিবে। ‘আমি আর কি বলিব। মা খুড়িমা যে-কথা অহৰ্নিশি বলে, আমিও সে কথাই বলিব, বলিয়াছিল অনন্তবালা। সেটা ছিল অবোধ বয়সের ছেলেমানুষি। এখন বয়স বাড়িয়া সে চিন্তাটা আরো প্রবল হইয়াছে। তার বয়সের অন্য মেয়েদের যখন একে একে বর আসিল, অনন্তবালা দেখিয়াছে, কিন্তু মনে করিয়া রাখিয়াছে, তারও একদিন বর আসিবে। সে বর আর কেউ নয়। সে অনন্ত।
দিনদিনই তাকে একটু একটু করিয়া বড় দেখায়। শেষে মা খুড়িমাদের চোখেও সে দৃষ্টিকটু হইয়া পড়িল। তার চাইতে ছোট মেয়েরা দেখিয়া মাঝে মাঝে ছড়া কাটে, ‘অনন্তবালা ঘরের পালা, তারে নিয়া বিষম জ্বালা।‘ তার মা একদিন তার বাপকে তিরস্কার করিয়া বলিয়াছিল, ‘মাইয়া রে যে বিয়া দেও না, সে কি কাঠের পালা যে ঘরে লাগাইয়া রাখবা।‘
‘কথা শুন, বনমালী। তোমারে রেলের ভাড়া দেই, তুমি কুমিল্লা শহরে যাও, দেখ গিয়া, তার নি খোঁজ পাওয়া যায়।‘
বনমালী গিয়াছিল। দুইদিন হোটেলে বাস করিয়া রাস্তায় রাস্তায় ঢুঁড়িয়াছে। কোন হদিস মিলে নাই।
হদিস মিলিয়াছিল সাত বছর পরে। অনন্তবালা তখন ষোল ছাড়াইয়া সতরোয় পা দিয়াছে। মালোর ঘরে অত বড় আইবুড়ে মেয়ে কেউ দেখে নাই বলিয়া সকলেই তার বাপখুড়াকে ছি ছি করিত। বয়স যতদিন কম ছিল, ভাল বর আসিলে অনন্তর আশায় তার প্রত্যাখ্যান করিয়াছে। এখন অনন্তর আশা গিয়াছে; বর আসে তৃতীয় কিংবা চতুর্থ পক্ষ। তার উপর মূর্খ, দেখিতে কদাকার। তারই একটার সঙ্গে জুড়িয়া দিব, আর উপায় নাই, বলিয়া তার বাপ একদিন নিৰ্মম হইয়া উঠিলে, সে দুঃখে অপমানে মরিতে চাহিল এবং বিস্তর কাঁদিয়া মা খুড়িমাদের তিরস্কারে ও অনুরোধে মন স্থির করিল। এমন সময় খবর নিয়া আসিল বনমালী।
—গাড়ি যখন কুমিল্লার ইষ্টিশনে লাগিল, তখন সন্ধ্যা হইতেছে। এদিক দিয়া চেকার উঠিতেছে দেখিয়া আমি ওদিক দিয়া নামিয়া গেলাম। কাঁধে পোনার ভার। দৌড়াইতে পাড়ি না। হাঁড়ি দুইটা ভাঙ্গিয়া গেলে তুলেমূলে বিনাশ। ইষ্টিশনের পশ্চিমে ময়দান। ঠাকুর ডুবিতেছে। লুকাইতে গিয়া দেখি অনন্ত। আরো তিনজনের সঙ্গে ঘাসের উপর বসিয়া তর্ক করিতেছে। পরণের ধুতি ফরসা, জামা ফরসা। পায়ের জুতা পর্যন্ত পালিশ করা। আমার এ বেশ লইয়া তার সামনে দাঁড়াইতে ভয়ানক লজ্জা করিতে লাগিল। তবু সামনে গিয়া দাঁড়াইলাম। চিনিল না। শেষে পনার হাঁড়ির দিকে মুখ রাখিয়া নিজে নিজে বলিলাম, আমাদের অনন্ত না জানি কোথায় আছে। সে কি জানে না তিতাস নদী শুকাইয়া গিয়াছে, মালোর জল ছাড়া মীনের মত হইয়াছে। খাইতে পায় না। মাথারও ঠিক নাই। অনন্ত লেখাপড়া শিখিয়াছে। সে কেন আসিয়া গরমেন্টের কাছে চিঠি লিখিয়া মালোদের একটা উপায় করিয়া দেয় না। হায় অনন্ত, যদি তুমি একবার আসিয়া দেখিতে তিতাস-তীরের মালোদের কি দশা হইয়াছে। দেখি অষুধে ধরিয়াছে। উঠিয়া কাছে আসিল। মুখের দিকে কতক্ষণ চাহিয়া রহিল। চিনিতে পারিয়া বুকে জড়াইয়া ধরিয়া কহিল, বনমালী দা, তুমি এই রকম হইয়া গিয়াছ। আমি একলা হই নাই রে ভাই, সব মালোরাই এইরকম হইয়া গিয়াছে। তবু ত আমি বাঁচিয়া আছি, মাছের পোনার ভার কাঁধে লইয়া ঘোরাফেরা করিতে পারি; কত মালো যে মরিয়া গিয়াছে; কত মালো যে খাইতে না পাইয়া একেবারে বলবুদ্ধি হারাইয়া ঘর-বৈঠক হইয়া গিয়াছে। সে দেখি ধ্যানস্থ হইয়া গেল। ধ্যান ভাঙ্গিলে বলিল, বনমালী দা, তুমি কি কর আজ কাল। বলিলাম, নদী শুকাইয়াছে, মালোদের মাছ ধরাও উঠিয়াছে। ব্যবসা ছাড়িয়া তারা দলেদলে মজুরি ধরিয়াছে। আমিও মজুরি ধরিয়াছি। একদিন চাঁটগাও হইতে এক মহাজন গেল মালোপাড়ায়। নাম কমল সরকার। বলিল, আমি এদেশে মাছের পোনা চালান দিব। এখানে দালাল থাকিবে। নানা গ্রামের পুকুরে সে পোনা ফেলিবে। তোমরা ত আর কোনো কালে মাছ ধরিতে পারিবে না। মজুরি কর। হাঁড়িতে জল দিয়া পোনা জিয়াইয়া ভার কাঁধে তুলিয়া দেয়, গামছায় বাঁধিয়া চিড়া দেয়, একখানা টিকেট কাটিয়া দেয়। দেশে গিয়া দালালকে বুঝাইয়া দেই। ক্ষেপ-পিছে একটা করিয়া টাকা দেয়। আমার গায়ে জোর আছে আমি পারি। অন্য মালোরা কি তা পারে। এবার আবার টিকেট কাটিয়া দিল না, বলিল, তোর পরণে ছোড়া গামছা, কাঁধে ছোড়া গামছা; মুখে লম্বা লম্বা দাড়ি। তোকে ঠিক ভিখারীর মত দেখায়। চেকারবাবু তোকে কিছুই বলিবে না। তুই বিনা টিকেটেই যা। একটাকার জায়গাতে না হয় পাঁচসিক দিব। এতদূর আসিয়াছিলাম। কিন্তু এখানে আসিয়া এত ভয় করিতে লাগিল যে নামিয়া পড়িলাম। আমার শরীরের দিকে কাপড়চোপড়ের দিকে, দাড়ির দিকে, চুলের দিকে চাহিয়া রহিল। এক সময়ে বলিল, বনমালী দা, তোমার একখানা ভাল গামছাও নাই। বলিলাম, আছে রে ভাই আছে। ভাল ধুতিও একটা আছে, কিন্তু তুলিয়া রাখিয়াছি। আর বিদেশ চলিতে এই পোষাকই ভাল। আমাকে হোটেলে নিয়া খাওয়াইল। দোকান হইতে আমাকে একটা, গোকনঘাটের তার মাসী সুবলার বউকে একটা আর উদয়তারাকে একটা কাপড় কিনিয়া দিল। নিজের কাছে নিজের বিছানায় শোয়াইল। পরদিন সকালে টিকেট কাটিয়া গাড়িতে তুলিয়া দিয়া গেল। বলিয়া দিল, বি-এ পরীক্ষার আর ছমাস বাকি। পরীক্ষা দিয়াই আমাদের দেখিতে আসিবে।