শ্রোতারা সমবেদন জানাইল, আহা বড় দুঃস্বপ্ন দেখিয়াছে রাধাচরণ। মাথায় তেল দিয়া স্নান কর গিয়া।
তার স্বপ্নকে স্বপ্ন বলিয়াই সকলে উড়াইয়া দিল। কেউ বিশ্বাস করিল না। কিন্তু একটা কালোছায়ার মত কৌতুহলমিশ্ৰিত আশঙ্কা তাহাদিগকে পাইয়া বসিল। কুড়াইল৷ খালের মুখ হইতে উজানের দিকে যখনই জাল ফেলিতে যায়, ভয়ে ভয়ে বাঁশ দুটিকে খাড়া করিয়া একটু বেশি করিয়া ডোবায়। আর দুরু হুরু বুকে মুহূর্ত গোণে মাটিতে ঠেকিল কি না। আর কোথায় স্রোতের কি নড়চড় হইল পই পই করিয়া খোজে। খুঁজিতে খুঁজিতে সত্যই দেখিল, হিসাবে মিলে না, কোথায় যেন গোলমাল হইয়া গিয়াছে। তারা বহুপুরুষ ধরিয়া এই নদীর সঙ্গে পরিচিত। তাদের দিনেরাতের সার্থী বলিতে এই নদী। এর মনের অলিতে-গলিতে তাদের অবাধ পথ-চলা। এর নাড়ি-নক্ষত্র তাদের নখদপণে। কাজেই স্রোতের একটুখানি আড় টিপিয়াই বুঝিতে পারে কোথায় এর ব্যাধি ঢুকিয়াছে। বুঝিতে পারে এর বুকে কাছেই কোথাও খুব বড় একটা চর ভাসিতেছে।
তাদের হিসাব ভুল হয় না।
ভাসমান চরটা একদিন মোহনের জালের খুঁটিতে ধরা পড়িয়া গেল। সেটা ছিল ভাঁটার শেষ দিন। বড় নদী তার বহু জল টানিয়া নিয়াছে। এমন সব ভাঁটাতেই নেয়। আবার জোয়ারে ফিরাইয়া দেয়। যত ইচ্ছা দিয়াও যা থাকে, তিতাস তাকে নিয়াই থমথম করে। জলগৌরব তার কোনো কালে ম্লান হয় না।
মোহনের বুক ধড়াস ধড়াস করিতে লাগিল।
সে ছোটবেলা গল্প শুনিয়াছে। কোন এক সাধু খড়ম পায়ে দিয়া এই তিতাসের বুকের উপর দিয়া হাঁটিয়া পার হইয়া যাইত। সেটা শুধু মন্ত্রবলেই সম্ভব হইয়াছিল। পাঠকের নিকট শুনিয়াছে, বিশাল যমুনা নদী, অগাধ তার জলরাশি; আর ঝড়ে বৃষ্টিতে দুর্যোগপূর্ণ রাত। বাসুদেব কৃষ্ণকে লইয়া জলে নামিল এবং খাপুর খুপুর করিয়া হাঁটিয়া পার হইয়া গেল। সেটা শুধু তারা দেবতা বলিয়াই সম্ভব হইয়াছিল।
আর এখানে দিনে-দুপুরে। চর্ম-চোখের সামনে। জালট ফেলিতেই তার বাঁশ এই মাঝগাঙেও খুচ করিয়া তলার মাটিতে ঠেকিল। নৌকাটা কাঁপিয়া উঠিল, আর কাঁপিয়া উঠিল মোহন নিজে।
মোহন বাড়িতে আসিয়া স্তব্ধ হইয়া রহিল। পাড়ার লোকের ডাকাডাকি করিলে সহসা সে রাগে ফাটিয়া পড়িল, ‘মালোগুষ্টি যাত্রা করুক, কবি করুক, নাচুক, মারামারি কামড়াকামড়ি যা মন চায় করুক। আর ভাবনা নাই। গাঙ শুখাইছে।’
‘কি কইলি, আরে মহন কি কইলি? আরে আ মন-মোহন কি কইলি?
‘কইলাম। গাঙে নাইম্যা দেখ গিয়া।’
এখান হইতে আধ মাইল দূরে যাত্রাবাড়ির টেক। নৌকা লইয়া তারা সেখানে গিয়া বাঁশ ফেলিল। এই টেক হইতে শুরু করিয়া এই অভাসিত চর উজানে কোথায় যে শেষ হইয়াছে, তার কিনারা করিতে পারিল না। যারা স্নান করিতে নামিয়াছে, তাদেরই একজন বার-পানির নেশায় পা টিপিয়া টিপিয়া একেবারে মাঝ নদীতে আসিয়াছে দেখা গেল। মাঝ নদীতে তার মোটে গলাজল। এমন আশ্চর্য ঘটনা তারা জীবনে এই প্রথম দেখিয়াছে।
বড় বড় নদীতে এক তীর ভাঙে, অপর তীরে চর পড়ে। ইহাই ধর্ম। কিন্তু তিতাসের ধর্ম তা নয়। এ নদীর কোন তীরই ভাঙে না। কাজেই তার বুকে যখন চর পড়িল, সে চর দিনে দিনে জাগিতে থাকে আয়তনে বাড়িয়া, চৌড় বুক চিতাইয়া।
বর্ষাকালে জল বাড়িয়া তিতাস কানায় কানায় পূর্ণ হইল। বর্ষা অস্তে সে জল সরিয়া যাওয়াতে সেই চর ভাসিয়া বুক চিতাইয়া দিল। কোথায় গেল এত জল, কোথায় গেল তার মাছ। তিতাসের কেবল তুই তীরের কাছে দুইটি খালের মত সরু জলরেখা প্রবাহিত রহিল, তিতাস যে এককালে একটা জলেভরা নদী ছিল তারই সাক্ষী হিসাবে।
৮.২ ভাসমান
দুই তীরের উচ্চতা ডিঙ্গাইয়া একদিন দূরদূরাস্তের কৃষকের লাঠি-লাঠা লইয়া চরের মাটিতে ঝাঁপাইয়া পড়িল। পরস্পর লাঠালাঠি করিয়া চরটিকে তারা দখল করিয়া লইল। জেলেরা তীর হইতে কেবল তামাসা দেখিল। এ জায়গা যতদিন জলে ছিল ডোবানো, ততদিনই ছিল মালোদের। যেই জল সরাইয়া ভাসিয়া উঠিয়াছে, তখনি হইয়া গেল চাষাদের। এখানে তারা বীজ বুনিবে, ফসল কাটিয়া ঘরে তুলিবে। তাদের এ দখল চিরকাল বর্তাইয়া রহিবে, কোনোদিন কেউ এ দখল হরণ করিয়া লইবে না। তাদের এ দখল যে বাস্তবের উপর; তা যে মাটির গভীরে অনুপ্রবিষ্ট। আর মালোদের দখল ছিল জলে; তরলতার নিরবলম্ব নিরবয়বের মধ্যে। কোনোদিন সেটা বাস্তবের গভীর স্পর্শ খুঁজিয়া পাইল না। পাইল না শক্ত কোনো অবলম্বন। কঠিন কোনো পা রাখিবার স্থান। তাই তারা ভাসমান। পৃথিবীর বুকে মিশিয়া যতই তারা, জেলেরা, গাছপালা বাড়িঘরের সঙ্গে মিতালি করুক, তারা বাম্পের মত ভাসমান। যতই তারা পৃথিবীর বুক আঁকড়াইয়া ধরিয়া থাকুক, ধরার মাটি তাহাদিগকে সর্বদা দুই হাতে ঠেলিয়া দিতেছে, আর বলিতেছে, ঠাঁই নাই, তোমাদের ঠাঁই নাই। যতদিন নদীতে থাকে জল, ততদিন তারা জলের উপর ভাসে। জল শুখাইলে তারা জলের সঙ্গে বাম্প হইয়া উড়িয়া যায়।
এখনো জোয়ার আসে। চরটা তখন ডুবিয়া যায়। সার তিতাস তখন জলে জলময়। নদীর দিকে দৃষ্টি প্রসারিত করিয়া মালোরা ভাবিতে চেষ্টা করে; এই তো জলে-ভরা নদী। ইহাই সত্য। একটু আগে যাহা দেখা গিয়াছিল ওটা দুঃস্বপ্ন। কিন্তু ভাঁটা আসিলেই সত্যটা নগ্ন হইয় উঠে। মালোদের এক একটা বুক জোড়া দীর্ঘনিশ্বাস বাহির হয়। তিতাস যেন একটা শত্রু। নির্মম নিষ্ঠুর হইয়া উঠিয়াছে সেইশত্রু। এতদিন ভালবাসিয়া আসিয়াছে। আজ সম্পূর্ণ অনাত্মীয় হইয়া গিয়াছে। এতদিন সোহাগে আহ্লাদে বুকে করিয়া রাখিয়াছিল। আজ যেন ঠেলিয়া কোন গহীন জলে ফেলিয়া দিতেছে। যেন মালোদের সঙ্গে তার সব সম্পর্ক চুকাইয়া নিক্ষরুণ কণ্ঠে বলিয়া দিতেছে, আমার কাছে আর অtসিও না। আমি আর তোমাদের কেউ না। বর্ষাকালে আবার সে কানায় কানায় পূর্ণ হইয় উঠে। সুদূরবর্তী স্থান হইতে ভাসিয়া আসে তার ঢেউ। তখন তার স্রোতের ধারা কলকল করিয়া বহিতে থাকে। আবার প্রাণচঞ্চল মাছের সেই স্রোতের তরী বাহিয়া পুলকের সঙ্গে উজাইয়া চলে। নূতন জলে মালোর প্রাণ ভরিয়া ঝাপবাপি করে। গাঁ ডোবায়, গাঁ ভাসায়। নদীর শীতল আলিঙ্গনে আপনাদের ছাড়িয়া দিয়া বলে, তবে যে বড় শুখাইয়া গিয়াছিলে। বলিতে বলিতে চোখে জল আসিয়া পড়ে, বড় যে তোমাকে পর পর লাগিত; এখন ত লাগে না। এত যদি স্নেহ, এত যদি মমতা, তবে কেন সেদিন নির্মম হইয়া উঠিয়াছিলে। এ কি তোমার খেলা! এ খেলা আর যার সঙ্গে খুশি খেলাও, কিন্তু জেলেদের সঙ্গে নয়। তারা বড় অল্পেতে অভিভূত হইয়া পড়ে। তোমার ক্ষণিকের খেয়ালকে সত্য বলিয়া মানিয়া নিয়া তারা নিজেরাই আত্মনির্যাতন ভোগ করে। তারা বড় দীন। দয়াল তুমি, তাদের সঙ্গে ঐ খেলা খেলাইও না। ঐ রূপ দেখাইও না। তারা তোমার প্রসন্ন দৃষ্টি দেখিয়াই অভ্যস্ত।