ও বাড়িতে তারা অন্তের গান কেবল শুনিয়াছে, গাহিবার যারা তারা একাই গাহিয়াছে। কিন্তু এবাড়ির গান মালোদের সকলেরই প্রাণের গান। যতদূরেই থাক, এর সুর একবার কানে গেলে আর যায় কোথা। আমনি সেটি প্রাণের ভিতর অনুরণিত হইয়া উঠে। কাছে থাকিলে সকলের সঙ্গে গলা মিলাইয় গায়। দূরে থাকিলে আপন মনে গুন গুন করিয়া গায়। আজও তারা উদয়চাঁদের সহিত স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দ মিশাইয়া গাহিল :
না ওরে বন্ধ্ বন্ধ্ বন্ধ্, কি আরে বন্ধ্ রে,
তুই শ্যামে রাধারে করিলি কলঙ্কিনী।
মথুরার হাটে ফুরাইল বিকিকিনি।।
না ওরে বন্ধ্ —
তেল নাই সলিতা নাই, কিসে জ্বলে বাতি।
কেবা বানাইল ঘর, কেব। ঘরের পতি॥
না ওরে বন্ধ্ —
উঠান মাটি ঠন্ ঠন্ পিড়া নিল সোতে।
গঙ্গা মইল জল-তরাসে ব্রহ্মা মইল শীতে ॥
এমন সময় কাক ডাকিয়া উঠিল। চারিদিক ফরসা হইয়া আসিল এবং আসরের বাতি নিভাইয়া দেওয়া হইল। কালোবরণের বাড়ি একেবারেই নীরব ও নির্জন হইয়া গিয়াছে। মোহনের উঠানে লোকের আর ঠাঁই কুলাইতেছে না। বিজয়ের গর্বে উল্লসিত মোহন বলিয়া উঠিল, ‘ঠাকুর সকল, দুইখান নামগান গাইয়া যাও। আমি গিয়া খোল করতাল আনি।‘
নামগান আরও কঠিন। তাই বহুদিন ধরিয়া গাওয়া হয় না। আজ অনেকদিন পরে এক উঠানে সব মালো সমবেত হইয়াছে। এমন আর কোন দিন হইবে। তাই আজ একবার প্রাণ ভরিয়া নামগান গাহিতেই হইবে। এ গানের সুর খুব চড়া। গাহিতে খুব শক্তির দরকার। গায়কেরা চার ভাগে ভাগ হইয়া খণ্ডে খণ্ডে উহাকে গাহিয়া নামায়। একটি গান নামাইতে ঝাড়া এক প্রহর সময় লাগে।
মোহন বলিল, ‘ঠাকুর সকল, সহচরী গাইবা না বস্ত্রহরণ গাইবা।’
‘সহচরী’ই গাহিবে ঠিক হইল।
‘সহচরী, উপায় বল কি করি,’ এই বলিয়া রাধা তার আক্ষেপ শুরু করিল। আমার অতি সাধের সাধনার ধন হারাইলাম। আগে জানিলে কি সই করিতাম প্রেম, তারে দিতাম কুলমান। যা হোক, অনেক চেষ্টা চরিত্র করিয়া তাকে তো প্রায় ভুলিয়াই গিয়াছিলাম। কিন্তু তোরা একি করিলি, চিত্রপটে তার রূপ দেখাইয়া আমায় আবার কেন তাকে মনে করাইয়া দিলি। তোরা আমায় ধর; আমার জীবন যাইবার সময় উপস্থিত, তোরা আমায় ধর।
গান শেষ হইল, যখন রোদ চড়িল তখন। মালোদের মনও বুঝি এই কাঁচা রোদের মতই স্বচ্ছ হইয়া গিয়াছে। অনেকদিন পরে আজ তারা প্রাণ খুলিয়া মিশিল এবং গান গাহিয়া মনের গ্লানি দূর করিল।
কিন্তু দুইদিন পরে যখন কালোবরণের বাড়িতে বাক্স-বাক্স সাজ আসিল, এবং রাত্রিতে যখন সাজ পোষাক পড়িয়া সত্যিকারের যাত্রা আরম্ভ হইল, মালোরা তখন সব ভুলিয়া যাত্রার আসর ভরিয়া তুলিল। বালক বৃদ্ধ নারী পুরুষ কেউ বাদ রহিল না। সকলেই গেল। মাত্র দুইটি নরনারী গেল না। তারা সুবলার বউ আর মোহন। অপমানে সুবলার বউ বিছানায় পড়িয়া রহিল, আর বড় দুঃখে মোহনের দুই চোখ ফাটিয়া জল আসিতে লাগিল।
৮.১ ভাসমান
এই পরাজয়ের পর মালোরা একেবারেই আত্মসত্তা হারাইয়া বসিল। তাদের ব্যক্তিত্ব, বৈশিষ্ট্য, সংস্কৃতি ধীরে ধীরে সবই লোপ পাইতে লাগিল। তাদের নিজস্ব একটা সামাজিক নীতির বন্ধন ছিল, সেইটিও ক্রমে ক্রমে শ্লথ হইয়া আলগা হইয়া গেল। একসঙ্গে কোন কাজ করিতেই তারা আর তেমন জোর পাইত না। সামান্ত বিষয় নিয়া তারা পরস্পর ঝগড়া করিত। এমন কি, ঘাটে নৌকা ভিড়াইবার সময়, কে আগে ভিড়াইবে এই লইয়া মারামারি পর্যন্ত হইত। জাল ফেলিবার সময় কার আগে কে ফেলিবে এ নিয়া তীব্র প্রতিযোগিতা হইত। তারই পরিণতিতে তাদের প্রধান দুইটি দলের মধ্যে মাথা ফাটাফাটিও হইত। অথচ এর আগে এসব কোনকালেই হইত না।
তাদের ছেলেরা হুকা ছাড়িয়া সিগারেট ধরিল। তারা আগের মত গুরুজনদিগকে মানিত না। বাপখুড়াদের প্রতি তাদের ভক্তি যেমন হ্রাস পাইল, তেমনি সহানুভূতিও কমিয় গেল। রোজগারের প্রতি তাদের মনও আর আগের মত রহিল না। তিতাসের মাছ ফুরাইয়া গেলে মালোর আগে তোড়জোড় করিয়া প্রবাসে যাইত। এখন আর যায় না।
তাদের পাড়াতে তখন যাত্রাওয়ালাদেরই আধিপত্য। তারা যখন যার বাড়িতে খুশি, গিয়া বসিত। আলাপ জমাইত। সে আলাপে শেষে মেয়েরাও যোগ দিত। ইহা মালোদের কখনো কখনো অস্বস্তিকর লাগিত; কিন্তু ইহার প্রতিবাদ করার জোর পাইত না। মেয়েদের কাছে এই সব রাজা, রাজপুত্র, সেনাপতি, বিবেক এক একটা অসাধারণ পুরুষ। মালোরা বড় ভাইয়ের বউদের ডাকে শুধু বউ বলিয়া আর এর ডাকে, বউদি বলিয়া। মেয়েরা আরও খুশি হয়। ইহারা মালোপাড়ার বউঝিদের সম্বন্ধে নিজেদের পাড়ার যুবকদের কাছে নানা রসাল গল্প বলিত। ঐসব যুবকরাও কৌতুহলের বশে তাদের সঙ্গে আসিয়া মালোদের বাড়িতে বসিত। কথা বলিত। বলিত ভাল কথাই। কিন্তু মেয়েরা যখন ঘাটে যাইত, তারা তখন সুযোগ দেখিয়া শিষ দিত কিংবা আচমকা কোনো বিচ্ছেদের গানে টান দিত। এইভাবে মালোর অন্তঃপুরের শুচিতা পর্যন্ত হারাইতে বসিল।
মালোর এ সবই দেখিত এবং ইহার ফলাফলও বুঝিতে পারিত। কিন্তু প্রতিবাদ করার জোর পাইত না। চুপ করিয়া থাকিত এবং সময়ে সময়ে নিজেরাও এই গডডালিকা প্রবাহে গাঁ ভাসাইয়া দিত। মাঝে মাঝে এ নিয়াও ঝগড়া হইত। এবাড়ির লোক ওবাড়ির লোককে খোঁটা দিত। ওবাড়ির লোক রাগিয়া বলিত, ভেন্ভেন্ করিস না ত। আগে নিজের ঘর সামলা। তারপর পরের তরকারিতে লবণ দিতে আসিস। সত্য কথাই। তার নিজের ঘরের লোককে সামলাইতে গেলে, সেখানেও রাগারাগি হইত।