তার চেয়েও উত্তম গান মোহনের স্মরণেই ছিল। বলিল, তার আগে এই গানটা হোক, ‘এহি বৃন্দাবনে ব্ৰজগোপীগণে বুরিয়াছে ছ’নয়ানে। পশুপক্ষী সবে কান্দিছে নীরবে হায় হায় কৃষ্ণবলে।’
আজ কৃষ্ণের মথুরায় গমন। শূন্য বৃন্দাবন একসারে ক্ৰন্দন করিতেছে। পশুপাখী, গাভীবৎস, দ্বাদশবন, যমুনাপুলিন, চৌরাশি ক্রোশ ব্রজাঙ্গন একযোগে রোদন করিতেছে। ব্ৰজগোপীর চোখের জলে পথ পিছল। সেই পিছল পথে রথের চাকা কতবার বসিয়া গিয়াছে। ব্ৰজগোপী কতবার গাহিয়াছে, ‘প্রাণ মোরে নেওরে সঙ্গেতে, ব্ৰজনাথ রাখ রথ কালিন্দীর তটেতে।‘ কিন্তু তবু তার যাত্রা থামে নাই। ব্ৰজগোপীর বুকজোড়া কামনা হৃদয়ছোঁয়া ভালবাসাকে দলিত মথিত করিয়া, তার বুকখানা দুমড়াইয়া গুড়াইয়া দিয়া তার রথ চলিয়া গিয়াছে। ব্ৰজগোপী সবদিক দিয়া আজ কাঙাল। তবু আশা ছাড়ে না। তবু বলে, ‘ম’লে নি গো পাব, এ প্রাণ জুড়াব, যায় যায় চিত্ত জ্বলে।’
একটা বেদনা-বিধুর ভারাক্রান্ত পরিবেশের মধ্যে গানটা সমাপ্ত হইল। ও বাড়িতে তখন বিবেকের গলা শোনা গেল, ‘লাগল বিষম যুদ্ধ এবার দেবতা দানবে—এ-এ। লাগল বিষম যুদ্ধ এবার।’
বিশ্রাম নিতে নিতে উদয়চাঁদ বলিল, লাগছে যখন, যুদ্ধ ভাল কইরাই লাগুক। ভাইট্যাল গান একটা স্মরণ কর মহন। রাত বাড়িয়া চলিয়াছে। কালোবরণের বাড়ি হইতে হাসির কলরোল ভাসিয়া আসিতেছে। বোধ হয় কোনো হাসির পাঠ অভিনয় হইতেছে। মালোদের ছেলেমেয়ে বউঝি গিন্নিবান্নিরা পর্যন্ত সেখানেই গিয়া ভিড় বাড়াইতেছে। মোহনের বাড়ির জনতা পাতলা হইয়া আসিতেছে। কিন্তু যারা গাহিতেছে, জনতা বাড়িল কি কমিল সেদিকে তাদের লক্ষ্য নাই। এখন রাত গভীর হইয়াছে। এখন ভাটিয়াল গাহিবার সময়। এখন এমন সময়, যখন জীবনের ফাঁকে ফাঁকে জীবনাতীত আসিয়া উঁকি দিয়া যায়। এখন কান পাতিয়া রাত্রির হৃদস্পন্দন শুনিতে শুনিতে অনেক গভীর ভাবের অজানা স্পর্শ অনুভব করা যায়। অনেক অব্যক্ত রহস্যের বিশ্বাতীত সত্তা এই সময় আপনা থেকে মানুষের মনের নিভৃতে কথা কহিয়া যায়। সে কথা ভাটিয়ালী সুরে যে ইঙ্গিত দিয়া যায় অন্য সময়ে তাকে ধরাছোঁয়ার মধ্যে পাওয়া যায় না।
মোহনের দল এখন যে গান তুলিল, তিতাসের অপর তীরে গিয়া তাহা প্রতিধ্বনি জাগাইয়া দিল। ‘কানাইরে বেলা হইল দুই রে প’র। প্রাণটি কাঁপে রাধার থর থর রে, মথুরার বিকি যায় রে বইয়া রে সুন্দর কানাইরে। কানাইরে, পার হইতে কংস রে নদী, নষ্ট হইল রাধার ভাণ্ডের দধি রে অ কানাই, নষ্ট করলি দধির ভাণ্ড ছাইয়া রে সুন্দর কানাইরে। এই রাধা বৃন্দাবনের প্রেমাভিসারিকা রাধা নহে। এ রাধা জন্ম-মৃত্যু দুই তীরের পারাপারশীল মানব আত্মা। কংসনদী অর্থাৎ যমুনা নদী এখানে জন্মমৃত্যুর সীমারেখা। আত্মা তার খেলাঘর ছাড়িয়া উজান ঠেলিয়া চলিয়াছে। নিঃসীম অন্ধকারে তার এপার ওপার আবৃত। কানাই বেশী ভূমাই তাহাকে পার করিয়া চালাইয়া নিবার মালিক, আত্মা নিষ্কলুষ হইলে কি হইবে, তার পার্থিব দধিভাণ্ডের প্রতি মায়া জাগে। কিন্তু নারায়ণ তাকে ঐহিক সবকিছুর কলঙ্ক-স্পর্শ থেকে নিমুক্ত করিয়া, পরিশুদ্ধ করিয়া লইতে চান, নিজের মধ্যে গ্রহণ করিবার পূর্বে। এই জন্য তিনি দধির ভাণ্ড স্পর্শ করিয়া সব দধি নষ্ট করিয়া দিয়াছেন। সকল মালো এর সব অর্থ না বুঝিলেও, গানের স্বরে সুদূরের কি কথা যেন ভাসিয়া আসিয়া তাদের জীবনে এক জীবনাতীতের বাণী শুনাইয়া গেল। গানে তারা উদ্দাম হইয়া উঠিয়াছে।
‘কালো কালো কোকিল কালো, কালো ব্রজের হরি। খঞ্জন পক্ষীর বুক কালো, চিত্ত ধরিতে না পারি।। শুতিলে না আসে নিদ্রা বসিলে ঝুরে আঁখি। ( আমি ) শিথান বালিশ পইথান বালিশ বুকে তুইল্যা রাখি।।‘ পরম প্রাৰ্থিতের সঙ্গে মিলনের চরম ক্ষণ ঘনাইয়া আসিতেছে। রজনীর ক্রমবর্ধমান গভীরত। এই কথাই জানাইয়া দিতেছে। চতুর্দিকে আদি অস্তহীন কালোবরণ। তারই স্নিগ্ধ অরূপ রূপমাধুর্যে চিত্ত পিপাসিত। এ পিপাসা অনন্তের রূপমুধা পানে উন্মুখ। মুহূর্তগুলি আর কাটিতে চাহিতেছে না। ক্রমেই অস্থিরতা বাড়িতেছে, এমন সময় আসিয়াছে যখন শুইলে না আসে নিদ্রা বসিলে ঝুরে আঁখি।
রাত বোধ হয় আর বেশি নাই। এখনই হরিবংশ গানের সময়। এর নাম কি কারণে হরিবংশ গান হইল, মালোরা তাহা জানে না। বাপ পিতামহের কাছ হইতে শিখিয়াছে এই গান, আর শিখিয়া রাখিয়াছে যে এর নাম হরিবংশ গান। এর কথা বিচ্ছেদবিধুর মানবাত্মার সুগম্ভীর আকুতি। এর স্বর অত্যন্ত দরাজ। পুরা করিয়া টান দিলে দিকদিগন্তে তাহা ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়। এ গান এখন আর বেশি লোকে গাহিতে পারে না। পুরাপুরি স্বর খুলিয়া গাহিতে পারে একমাত্র উদয়চাঁদ।
‘মাটির উপরে বৃক্ষের বসতি, তার উপরে ডাল, তার উপরে বগুলার বাসা, আমি জীবন ছাড়া থাকব কত কাল ॥ নদীর ঐ পারে কানাইয়ার বসতি, রাধিকা কেমনে জানে।…’ কথার ওজস্বিতায় না হোক সুরের উদাত্ততায় জীবন-রাধিক কাণ্ডারীকানাইকে সহজেই খুঁজিয়া বাহির করিল এবং মরণ-নদী পার হইল। এদিকে রাত্রিও শেষ হইয়া আসিয়াছে। ওদিকে কালোবরণের বাড়ি হইতে তখনও গান ভাসিয়া আসিতেছে, সারারাতি মালা গাথি মুখে চুমু খাই রে, চিনির পান। মুখখান তোর আহ৷ মরে যাইরে। কিন্তু এ গান অপেক্ষা ভাটিয়াল গানের আকর্ষণ অধিক হওয়ায় দলে দলে লোক কালোবরণের বাড়ি হইতে মোহনের বাড়িতে চলিয়া আসিল। উৎসাহ পাইয়া উদয়চাঁদ তার সবচেয়ে প্রিয় গানখানাই এবার তুলিল। সকলেই জানে যে এ গানটি যতবার গাহিয়াছে প্রত্যেকবারই উঠিয়া সঙ্গে সঙ্গে নাচিয়াছে। এ গানে তার সঙ্গে আরও দুই একজনে উঠিয়া হাত নাড়িয়া নাচিয়া থাকে।