কিন্তু তারা যখন গাহিল, ‘গউর রূপ অপরূপ দেখলে না যায় পাসর। আমি, গিয়াছিল সুরধুনী, ডুবল তুই নয়নতারা।‘ তখন অপর দুইজন মালোরছেলে আর দুইটি যুগী ছেলের সঙ্গে সুর মিলাইয়া পাশের বাড়ির উঠান হইতে তারস্বরে গাহিয়া উঠিল, ‘সাজ সাজ সৈন্যগণ সাজ সমরে। তোমরা যত সৈন্যগণ যুদ্ধের কর আয়োজন, সাজ সাজ সৈন্যগণ সাজ সমরে।‘ দেখিয়া মোহনের মনে খেদ উপস্থিত হইল যে, তার গান ঐ গানের মধ্যে কোথায় তলাষ্টয়া যাইতেছে। তার দলের লোকেরাও যেন অন্তমনা হইয়া গিয়াছে। মনে মনে যেন সেই গানেরই তারিফ করিতেছে। আজকাল দুপুরবেলা আর গান জমে না, এই বলিয়া তারা বৈঠক ভাঙ্গিয়া উঠিয়া পড়িল।
কিন্তু এখনো পর্যন্ত যাহা শুনিতে বাকি ছিল, একদিন বৈকালে তাহাও শুনিতে পাওয়া গেল; আজ রাতে যাত্রার নূতন পালার মহড়া হইবে কালোবরণের বাড়িতে।
মালোদের এখনো যারা নিজেদের সংস্কৃতিকে বাঁচাইতে তৎপর তারা শুনিয়া হায় হায় করিতে লাগিল। কেউ কেউ কালোবরণকে গিয়া বুঝাইতে চেষ্টা করিল; দেখ বেপারী, মালোপাড়ার যারা মাথা, সেই দয়ালচাঁদ, কৃষ্ণচন্দ্র, হরিমোহন সবইত যাত্রার দিকে ঝু কিয়াছে। ছিলাম এক, হইয়া গেলাম দুই, নিত্য রেষারেষি, নিত্য খোচাখুচি। কোন দিন আমরা নিজেরাই লগি-বৈঠা লইয়া মারামারি করিতে লাগিয়া যাইব তার ঠিক নাই। মালো পাড়ার মাথায় যারা এই বজ্র ডাকিয়া আনিল, শেষ পর্যন্ত তুমি তাদের পথেই পা বাড়াইলে। না বেপারী, তুমি আমাদের দলে থাক। চল, মাতবরদের বুঝাইয়া সুঝাইয়া আবার মালোপাড়াতে আগের মত একতা ফিরাইয়া আনি। আমরা যাত্রা গাহিব কেন। আমাদের কি গান নাই! ময়-মুরুবিবর কি আমাদের জন্য গান কিছু কম রাখিয়া গিয়াছে। সে সব গানের কাছে যাত্রা গানতো বাদী। সামনে ঘোর দুর্দিন দেখিতেছি। যাত্রা লইয়া পাড়াতে যাহা শুরু হইয়াছে, তাহার শেষ না জানি কত ভয়ানক হইবে, সেই চিন্তাই করি। এখন তুমিই ভরসা। আজ তোমার বাড়িতে যাত্রা গাহিয়া যাওয়ার অর্থই সারা মালোপাড়ার বুকের উপর বসিয়া যাত্রা গাহিয়া যাওয়া।
কিন্তু কালোবরণ কথাগুলি শুনিয়াও যেন শুনিল না এইরকম ভাব দেখাইয়া চুপ করিয়া রহিল।
তারা ক্ষুন্নমনে ফিরিয়া আসিল।
‘অ, মহন, আ মনমহন, আর ভরসা নাই। কালনাগে দেখি তারেও খাইছে।’
মনমোহন নিস্তেজ কণ্ঠে বলিল, আমাদিগকে ফেলিয়া সকলেই লঙ্কা পার হইতেছে। দয়ালচাঁদ গিয়াছে, কৃষ্ণচন্দ্র গিয়াছে। গৌরকিশোর গিয়াছে, কালোবরণও গেল। সব যাইবে।
না না, মহন, সব যাইব না। সুবলার বউয়ের দৃঢ় কণ্ঠস্বরে সকলেই যেন সচকিত হইয়া উঠিল।
—দয়ালচাঁদ গিয়াছে, কৃষ্ণচন্দ্র গিয়াছে। আরে মহন, তুইত যাস নাই। তুই আছিস, সাধুর বাপ মধুর বাপ আছে। ছ’কুড়ি ঘরের তিনকুড়ি গিয়াছে। আরো ত তিনকুড়ি আছে। এই নিয়াই আমরা শেষ পর্যন্ত টিকিয়া থাকিব। বেনালে বেঘোরে আমরা গাঁ ভাসাইব না। যে ক’ ঘর থাকিবে, তাই নিয়া আমরা শেষ পর্যন্ত সংগ্রাম করিয়া যাইব। মালোপাড়াতে যারা বিপদ ডাকিয়া আনিয়াছে, এক গুয়া কাটিয়া যারা দুইভাগ করিয়াছে, আমরা কিছুতেই তাদের নিকট নতি স্বীকার করিব না। কালোবরণ বেপারীর বাড়িতে আজ যদি যাত্রা দেয় ত, তোর বাড়িতেও আসর জমা। আজ একটা পরীক্ষা হইয়া যাক।
সুবলার বউ মোহনকে লইয়া বসিল। দুইজনেই স্মৃতির হয়ার খুলিয়া যে সকল ভাল ভাল গান বিস্মরণ হইয়াছিল, মনের মধ্যে সেগুলিকে ডাকিয়া আনিল। তারমধ্যে আবার যেগুলি খুব জমে, সেগুলিকে লইয়া মুখে মুখে একটা তালিকা প্রস্তুত করিল।
এই-এইগুলি বিচ্ছেদ গান। দেহতত্ত্বের পরেই গাইবি। আর নিশি-রাতে গাইবি ভাইট্যাল গান। হরিবংশ গাইবি রাত পোহাইবার অল্প বাকি থাকতে। ভোরে ভোরগান আর সকালে গোষ্ঠগান গাইয়া তারপর মিলন গাইয়া আসর ভঙ্গ করবি।
যাত্রাওয়ালারা সন্ধ্যার পর বেহালা ও হারমনিয়ামের বাক্স এবং বাঁয়া-তবলা লইয়া কালোবরণের উঠানে বসিয়া যখন ঢোলকে চাপড়ি দিল তখন মোহনের দলও খঞ্জনি রসমাধুরী যন্ত্র লইয়া বসিয়া গেল। এবাড়িতে ওবাড়িতে দূরত্ব শুধু খানদুই ভিটা। ওবাড়িতে কথা বলিলে এ বাড়ি থেকে শোনা যায়।
ও বাড়িতে যখন বীরবিক্রমে বক্তৃতা চলিতেছে, এবাড়িতে মোহনের দল দেহতত্ত্ব শেষ করিয়া বিচ্ছেদগান শুরু করিয়াছে : ভোমর কইও গিয়া, কালিয়ার বিচ্ছেদে রাধার অঙ্গ যায় জ্বলিয়া ॥ না খায় অন্ন না লয় পানি, না বান্ধে মাথার কেশ, তুই শ্যামের বিহনে রাধার পাগলিনীর বেশ।।
সারা মালোপাড়া দুই ভাগে ভাগ হইয়া দুই বাড়িতে ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছে। বেশির ভাগ গিয়াছে কালোবরণের বাড়িতে। তাদের চোখমুখে নূতনের প্রতি অভিনন্দনের ভাব। মোহনের বাড়িতে যারা আসরে মিলিয়া বসিয়া গিয়াছে তাদের চোখে মুখে সংস্কৃতি,রক্ষার দৃঢ়ত।
রাধার বিচ্ছেদবেদন সুরে স্বরে লহরে লহরে উৎসারিত ও বিচ্ছুরিত হইতেছে। সকলের প্রাণের মধ্যে একটা বেদনার হাহাকার গুমরিয়া উঠিতেছে। দলের বড় গায়ক উদয়চাঁদ রসমাধুরী ঠাট করিতে করিতে বলিল, এখানে এ গানটা চলিতে পারে, ‘জীবন জুড়াব যেয়ে কার কাছে, দয়াল কৃষ্ণবিনে বন্ধু ভবে কে আছে। কারো কারো মনঃপুত না হওয়াতে বলিল, তবে এটা তুলিতে পার, কি গো কালশশী, তোমার বাশি কেনে রাধা বলে, কৃষ্ণ বলে না। দুঃখিনী রাধারে হরি সপলা কার ঠাই। ব্ৰজগোপীর ঘরে ঘরে ঠাঁই মিলে না দাঁড়াইবার।’