তাদের মায়ের দিদির মুগ্ধ হইল। নাচখানা যেমন অপূর্ব গানখানাও তেমনি নূতন। এর ভাব, এর ভাষা, এর ভঙ্গি মালোদের গানের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এর স্বরও অন্য রাজ্যের। তারা মুগ্ধ হইল এবং পরদিন হইতে যাত্র দলের প্রতি অনুরক্ত হইল।
অন্যান্য মালোরা তাদের বাঁধা দিল। একঘরে করিবার ভয় দেখাইল। বুঝাইতে চেষ্টা করিল যাত্রার ঐ গান গানই নহে। উহার ভাব খারাপ, অর্থ খারাপ। এতে ছেলেদের মাথা বিগড়াইবে। মেয়েদেরও মন খারাপ হইবে। কিন্তু তারা বিচলিত হইল না। বরং বলিল; আরে রাখ রাখ, মালোদের গান আবার একটা গান ৷ এও গান আর আমরা যা গাই তাও গান। আমরা তো গাই—’আজো রাতি স্বপনে শ্যামরূপ লেগেছে আমার নয়নে। ফুলের শয্যা ছিন্নভিন্ন ছিন্ন রাধার বসনে ॥ কিবা গানের ছিরি। যাত্রার ঐ গানের কথা যেমন সুন্দর, সুর ও তেমনি, শোনা মাত্রই মুগ্ধ করে। আমরা ছেলে যাত্ৰাদলে দিবই, তোমরা একঘরে কর আর যাই কর।
ফলে মালোদের মধ্যে দুইটা পক্ষ হইয়া গেল।
মঙ্গলার বউ একদিন ঘাটে পাইয়া জানাইল, ‘পথে বিপদ আছে ভইন, একটু সাবধানে পা বাড়াইও। একজন নাকি তোমারে ‘আজ্নাইবে’। কথাখান আমার মহনের কানে আইছে।‘
সে কে, জিজ্ঞাসা করাতে মঙ্গলার বউ যার নাম করিল সে পাটনী-পাড়ার অশ্বিনী। বেটে-খাট চেহারা। মাথায় ঝাঁকড়া চুল। আগে গয়নার নৌকা বাহিত। এখন যাত্ৰাদলে রাজার ভাই সাজে।
এর প্রমাণও একদিন পাওয়া গেল। সুবলার বউ কলসী ও কাপড় লইয়া ঘাটে গেলে, সহস দেখিতে পাইল অশ্বিনী একটু দূরে থাকিয়া তাহাকে দেখিতেছে। চোখাচোখি হওয়া মাত্রই সে গান তুলিল, ‘যেইনা বেলা বন্ধুরে ধইল-ঘোড়া দৌড়াইয়া যাও, সেই বেলা আমি নারী সিনানে যাই। কুখেনে বাতাস আইলো বুকের কাপড় উড়াইল, প্রাণবঁধু দেখিল সর্ব গাও।‘
গানের অর্থ সহজেই হৃদয়ঙ্গম হইল।
দুপুরে ঘরে বসিয়া রাঁধিতেছিল। এমন সময় সেই গানেরই আর একটা কলি শোনা গেল। উঠান দিয়া হাঁটিয়া যাইতেছে আর গান করিতেছে, ‘যেই না বেলা বন্ধুরে রাজ-দরবারে যাও, সেই বেলা আমি রান্ধি। কাচা চুলা আর ভিজা কাষ্ঠরে বন্ধু, ধুয়ার ছলনা কইরে কান্দি।‘
এতদূর পর্যন্তও সহ্য করা গিয়াছিল। কিন্তু আরেকদিন যখন খাইতে বসিয়া সুবলার বউ আবার সেই গানেরই আরেক কলি শুনিল, ‘যেইনা বেলা বন্ধুরে বাঁশিটি বাজাইয়া যাও, সেই বেলা আমি নারী খাই। শাশুড়ী ননদীর ডরে কিছু না বলিলাম তোরে, অঞ্চল ভিজিল আঁখির জলে।’ তখন সে আর সহ্য করিতে পারিল না। এঁটো হাতেই ছুটিয়া বাহিরে আসিল, চীৎকার করিয়া বলিল, ‘আমার ঘরে শাশুড়ীও নাই ননদীও নাই। আমি কুন বেটারে ডরাই না। নিৰ্ভয়েই কই, তুই আয়। বাপের ঘরের হইয়া থাকিস তো, অখনই আয়। আশপড়সীর সামনে দিনে পরেই তরে আমি ঘরে নিতে পারি, তুই আয়।’
তার গলা শুনিয়া মঙ্গলার বউ, দয়ালচাঁদের বিধবা ভগিনী, কালোবরণের মা সকলেই বাহির হইল। তার চীৎকারের কারণ শুনিয়া ওদিকে মঙ্গলার ছেলে মহন, রামদয়াল গুরুদয়াল তারা দুই ভাই, লাঠি লইয়া ছুটিয়া আসিল। কিন্তু অশ্বিনী ততক্ষণে পাড়া ছাড়াইয়া বাজারে পা দিয়াছে।
‘কিরে মহন, কি অ সাধুরবাপ মধুরবাপ! ইটা আমার বাপের দেশ ভাইয়ের দেশ। ইখানে আমি কারুরে ডরাইয়া কথা কই না। ইখানে আমারে যেজন আজ্নাইব, এমন মানুষ মার গর্ভে রইছে। আমার কথা ছাড়ান দেও, আমি কই মালোপাড়ার কথা। দিনে দিনে কি হইল কও দেখি।‘
রামদয়াল গুরুদয়াল সকলেই খুব চটিল এবং পাড়ার লোককেও চটাইল, আর তাকে সমুচিত শাস্তি দিবে বলিয়া সকলে সঙ্কল্পও করিল। কিন্তু যাত্রার মহড়াতে সে যখন দরাজ গলায় গানে টান দিল, ‘হরির নামে মজে হরি বলে ডাক, অবিরাম কেন কাঁদবে বেটী-ঈ-ঈ-।’ তখনই মালোদের রাগ পড়িয়া গেল। কেবল মোহনের মনে সুবলার বউয়ের কথাগুলি জ্বলন্ত অঙ্গারের মত জ্বলজ্বল করিতে লাগিল।
মালোদের নিজস্ব একটা সংস্কৃতি ছিল। গানে গল্পে প্রবাদে এবং লোকসাহিত্যের অন্যান্ত মালমসলায় সে সংস্কৃতি ছিল অপূর্ব। পূজায় পার্বণে, হাসি ঠাট্টায় এবং দৈনন্দিন জীবনের আত্মপ্রকাশের ভাষাতে তাদের সংস্কৃতি ছিল বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। মালো ভিন্ন অপর কারে পক্ষে সে সংস্কৃতির ভিতরে প্রবেশ করার বা তার থেকে রস গ্রহণ করার পথ সুগম ছিল না। কারণ মালোদের সাহিত্য উপভোগ আর সকলের চাইতে স্বতন্ত্র। পুরুষানুক্রমে প্রাপ্ত তাদের গানগুলি ভাবে যেমন মধুর, সুরেও তেমনি অন্তরস্পর্শী। সে ভাবের, সে সুরের মর্ম গ্রহণ অপরের পক্ষে স্বসাধ্য নয়। ইহাকে মালোর প্রাণের সঙ্গে মিশাইয়া নিয়াছিল, কিন্তু অপরে দেখিত ইহাকে বিক্রপের দৃষ্টিতে। আজ কোথায় যেন তাদের সে সংস্কৃতিতে ভাঙ্গন ধরিয়াছে। সেই গানে সেই সুরে প্রাণ ভরিয়া তান ধরিলে চিত্তের নিভৃতিতে ভাব যেন আর আগের মত দানা বাধিতে চায় না, কোথায় যেন কিসের একটা বজ্রদূঢ় বন্ধন শ্লথ হইয়া খুলিয়া খুলিয়া যায়। যাত্রার দল যেন কঠোর কুঠারাঘাতে তার মূলটুকু কাটিয়া দিয়াছে।
অনেকেই নিরাশ হইয়া কালের স্রোতে গাঁ ভাসাইয়া দিল। নিরাশ হইল না কেবল মোহন। তার গলা ভাল। গানেও সে অনুরাগী। বাপ পিতামহের কাছ থেকে ভাটিয়ালী গান, হরিবংশ গান, নামগান অনেক শিখিয়াছিল। অধুনা মালোর সে সব গান ভুলিয়া যাইতেছে। নূতন ধরণের হাল্কা ভাবের হাল্কা কবির গান আসিয়া সে সব গাম্ভীর্যপূর্ণ, প্রাণময়, ভাব-সম্পদময় গানের স্থান অধিকার করিতেছে। এ দুঃখ সে মনের গভীরে বহুদিন অনুভব করিয়াছে। কিন্তু কালের স্রোত রুধিবার শক্তি কার আছে। এখন কালই পড়িয়াছে এই রকম। ভালো জিনিস পুরানো হইয়া হইয়া বাতিল হইয়া যাইবে আর হালকা জিনিস আসিয়া দশজনের আসরে জাকিয়া বসিবে। সে লোক ডাকিয়া খঞ্জনি ও রসমাধুরী যন্ত্র লষ্টয়া দুপুর বেলাতেই গান গাহিতে বসিল।