সারা দিনের শ্রান্তি। ঝগড়ার ঝামেলা। তার উপর ক্ষুধা। গোয়ালঘরে বসিয়া কলাপাতায় তুধবাতাস মিশাইয়া তার সেদিন পরিতৃপ্তির সহিত ‘জলচিড়া’ খাইল। খাওয়ার পর জমিলা উদয়তারাকে টানিয়া অন্দরে নিয়া বসাইল, বলিল : বিয়ার পর আমার পয়লা নাইওর। আমি ছিলাম নৌকার ছইয়ের ভিতরে। ছইয়ের মুখ ছিল একখানা শাড়ি গুজিয়া বন্ধ করা। বাতাসে শাড়ির গোজাটা খুলিয়া গেল। তুমি তখন ঘাটে ঢেউ দিয়া জল ভরিতেছিলে। আমি তোমাকে দেখিলাম। মনে হইল যেন কতকালের চেনা। জানা নাই শোনা নাই, কি জানি কেন একজনকে দেখিয়া এত ভাল লাগে। তাই আমি বারে বারে দেখিলাম। কিন্তু তুমি আমাকে দেখিলে না। পরের বারে এখানে আসিয়া বাপকে বলিয়াছিলাম, সই পাতিব। বাপ বলিল, নাম জানিনা নিশানা জানিনা, কি করিয়া খুঁজিয়া পাইব। তারপর কতবার তোমার ঘাট দিয়া নাইওরে গিয়াছি। তখন আমি পুরান। শাড়ির বেড়া নিজ হাতে খুলিয়া আতিপাতি করিয়া চাহিয়াছি, তোমাকে দেখিতে পাই কিনা। দেখিতে পাই নাই। আর কি কাণ্ড, আজ তুমি নিজে যাচিয়া আসিয়াছ। আসিয়াছ যখন, তুমি এখানে দুইদিন বেড়াও, তোমার বাড়িতে আমারে নিয়া দুইদিন রাখ।
শুনিয়া উদয়তার শুধু একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল। তার জমিলা নামটা খুব ভাল লাগিল, কিন্তু সে সংসারের সম্বন্ধে এত অনভিজ্ঞ দেখিয়া বেদনাবোধ করিল।
কালোমেঘ সরিয়া গিয়া চাঁদ উঠিলে দেখিতে কেমন সুন্দর হয়; তেমনি একটা খুববড় বিপদ কাটিয়া গিয়া মনের মুখের উদয় হইলে সে মুখ কত মধুর হয়, তাহা কাদিরের বাড়িতে তখন যে না দেখিয়াছে তাহাকে কি বলিয়া বুঝানো যায়।
নৌকায় ঝগড়া মারামারির দরুণ মনে যে অস্বস্তিটুকু ছিল কাদিরের বাড়ি অতিথি হইয়া তারা তাহা সম্পূর্ণরূপে ভুলিয়া গেল। মনে স্নেহ ও প্রীতির অনুপম এক ছোপ লইয়া তারা নৌকাতে গিয়া উঠিল।
আকাশে তখন চাঁদ উঠিয়াছে। তারই আলোকে তিতাসের ছোট ছোট ঢেউগুলি চিক্মিক্ করিতেছে। সেই ঢেউ ভাঙ্গিয়া নৌকা আগাইয়া চলিল। গেল না কেবল বনমালী আর অনন্ত। গৃহকর্তার নির্বন্ধাতিশয্যে তারা আজ এখানে রহিয়া গিয়াছে।
পরদিন সকালে অনন্তর ঘুম ভাঙ্গিলে বাহিরে গেল। গোয়ালঘরে একপাল গরু ডাকাডাকি করিতেছে। বাছুরগুলি ছাড়া পাইয়া অকারণে লাফাইতেছে। অদূরেই বর্ষার জল থই থই করিতেছে। ছোট বড় নানা জাতের গাছগুলি কোমর-জলে আটকা পড়িয়াছে। তারই সঙ্গে এক একটা ডিঙ্গি বাঁধা। একটা খোলা জায়গাতে বাঁশের লম্বা ‘আড়া’ বাঁধিয়া তার উপর ঝুলাইয়া পাট শুকাইতে দিয়াছে। যেন খুব বড় একটা পাটের দেওয়াল বানাইয়া রাখা হইয়াছে। ভিজ পাটের গন্ধ দিগ্বিদিকে ছাইয়া ফেলিয়াছে। আকৃষ্ট হইয়া ঝাঁকে ঝাঁকে ফড়িং উড়িতেছে বসিতেছে। অনন্ত নিবিষ্ট মনে সেগুলি দেখিয়া চলিয়াছে। দেখিতে দেখিতে একখানে মোড় ঘুড়িবার সময় দেখিল রমু দাঁড়াইয়া আছে। অনন্তর মত তারও চোখেমুখে বিস্ময়। তার সঙ্গে কথা বলিবার জন্য রমুর প্রাণ ছটফট করিতেছিল। সে শুধু ভাবিতেছিল তাহাদের বাড়িতে এরা রহিয়া গিয়াছে, তাদের আপন হইয়া গিয়াছে, কি মজা। কথা বলার উপলক্ষ্য খুঁজিতে খুঁজিতে এক সময়ে রমু বলিল, ‘তুমি ফড়িং ধরনা?’
অনন্ত বলিল, ‘না।’
রমু আবার বলিল : ওই বাঁশের পুল পার হইয়া যে-বাড়ি, সে-বাড়িতে থাকে গফুর, আমার চাচাত ভাই। সে খুব ফড়িং ধরে আর আড়কাঠি বিঁধাইয়া ছাড়িয়া দেয়, তারা ছটফট করিয়া মরিয়া যায়। দেখিয়া আমার মনে বড় কষ্ট লাগে। তুমি ফড়িং ধরনা, তুমি কত ভাল।
এমন সময় রমুর মা গাদায় ফেলিবার জন্য গোয়ালঘর হইতে এক ঝুড়ি গোবর লইয়া যাইতেছিল। তারা দুইজনকে একসঙ্গে পরিচিতের মত কথা বলিতে দেখিয়া তার মাতৃহৃদয় উচ্ছসিত হইয়া উঠিল। যাইবার সময় শশী গাছ হইতে টুক্ করিয়া একটি শশা পাড়িয়া অনন্তর হাতে দিয়া বলিল, ‘ধর বা’জি, খাও।’
শশাটা হাতে লইয়া অনন্ত বিস্মিতভাবে চাহিয়া রহিল। রমু বলিয়া দিল, মা।
মা নাম শুনিয়াই অনন্ত তার পায়ে ঢিপ করিয়া একটা প্রণাম করিয়া আসিল।
৭.২ দুরঙা প্রজাপতি
গ্রামে ফিরিয়া অনন্ত লেখাপড়ায় মন দিল। গোঁসাই বাবাজী যেদিন তাকে প্রথম ‘কালা আখর’ শিখাইল, সেদিন তার আনন্দ উপছাইয়া উঠিল। একটি নূতন জগৎ তাকে দ্বার খুলিয়া ডাকিয়া নিয়া গেল। তারপর দুই আখরে তিন আখরে মিলিয়া এক একটা কথা হইল। এ সকল কথা মুখে যেমন বলা যায় তেমনি লিখিয়াও প্রকাশ করা যায়। দেখিয়া তার বিস্ময়ের অবধি রহিল না। তিনকোণা, চারকোণা, গোল, নানারকমের আখরগুলি কলাপাতায় নক্সা করিতে কি যে ভাল লাগে। রাতে শুইলেও সেগুলি আকার নিয়া চোখের সামনে জ্বলজ্বল করিতে থাকে।
দেখিতে দেখিতে শিশুশিক্ষা শেষ হইয়া যায়। বনমালীর গর্ব হয়। সে বইটার যে-কোন একটা জায়গা আঙ্গুল দিয়া দেখাইয়া বলে, এইখানে পড় দেখি। অনন্ত পড়ে। আবার অন্য জায়গায় দেখায়, এইখানে কি লেখা আছে পড় দেখি। অনন্ত পড়ে। কোথাও ঠেকে না। মাঝে মাঝে বনমালার দীর্ঘনিশ্বাস পড়ে। বলে, ‘কালা আখর কেমুন জিনিস সময় থাকতে জানলাম না, অখন তা-ই শিখলাম।’
শিশুশিক্ষা শেষ করিয়া বাল্যশিক্ষা ধরে। তার সঙ্গে ধারাপাত। ঘোড়ায় চড়িল আবার পড়িল, কথাগুলি নূতন কিন্তু আখরগুলি চেনা। শিশুশিক্ষাতেই এ সবই পাওয়া গিয়াছে। এখানে একটা ছবি আছে। লোকটা ঘোড়া ছুটাইয়াছে। পড়িয়া যাওয়ার ছবি নাই। কোন সময় পড়িয়া গিয়া উঠিয়া পড়িয়াছে, সেটা দেখিতে পায় নাই বলিয়াই ছবি দেয় নাই। তারপর আসিল যুক্তাক্ষর। এগুলি কঠিন এবং জটিল। কিন্তু এই কঠিনতায় জটিলতায় যে একটা মোহ আছে, অনন্তকে তাহা পাইয়া বসিল। তারা নূতন নূতন রূপ নিয়া তার মানসলোকে আপনা থেকে আসিয়া ধরা দিতে লাগিল।