৭.১ দুরঙা প্রজাপতি
সুবলার-বউয়ের জীবনে একটা প্রচণ্ড ঝড় বহিয়া গিয়াছে। ছেলেবেলা মা বাবা তাকে অত্যন্ত ভালবাসিত। কোনদিন তারা তার গায়ে হাত তোলে নাই। মালোদের পাড়ার মেয়েতে মেয়েতে ঝগড়া হয়, গালাগালি করে। কিন্তু পাড়ার পাঁচজনের কেউ কোনদিন তার প্রতি কটুবাক্য প্রয়োগ করে নাই। পাড়ার মধ্যে তার নিজের একটা মর্যাদা ছিল। একটা গর্ব ছিল। আজ তাহা একেবারে খর্ব হইয়া গিয়াছে।
আজ সে দেহে মনে বিপর্যস্ত। সমস্ত শরীরে ব্যথা; এখানে-ওখানে ফুলিয়া গিয়াছে। নৌকা হইতে নামিয়া কোনো রকমে বাড়ি আসিল। কাহাকেও কিছু না বলিয়া একটা পাটি বিছাইয়া শুইয়া পড়িল। নৌকাতে অন্যান্য মেয়ে যারা ছিল, তাদের নিকট হইতে সকল প্রতিবেশীরা অগোঁণে ঘটনাটা জানিতে পারিল। সকল কথা শুনিয়া তার মা একবাটি হলুদ-বাট গরম করিয়া আনিয়া বলিল, ‘কাপড় তোল, কুনখানে কুনখানে বেদনা করে ক’। দেখি। ইস, গাও যে আগুনের মত ততা।’
আদর পাইয়া তার চোখে জল আসিয়া পড়িল।
মা তার তুই চোখ মুছাইয়া দিয়া বলিল, আ-লো নিশত্তুরি, তর নি এই দশা। তর বুকের না, পেটের না, তার লাগি তর কি!’
সুবলার বউ কোনো কথা বলিল না।
– ঐ কলিজা-খেকোকে তুই কেন আদর জানাইতে গেলি, দশজনের মাঝে তুই বেইজ্জত হইলি!
সে এবারও নিরুত্তর রহিল।
তার মা আর কথা না বাড়াইয়া, তারই কাছে শুইয়া পড়িল। বুড়া রাতের জালে গিয়াছে।
বুড়ি শুইয়া শুইয়াই তামাক টানিল, তারপর বাতি নিভাইল এবং সারারাত মেয়েকে বুকে করিয়া রাখিল। তার স্তন ফুটি শুখাইয়া দড়ির মত হইয়া গিয়াছে। মেয়ে তারই মধ্যে তার অলস স্তনদুটি ডুবাইয়া দিয়া গভীর আরাম পাইল। মা তার তোবড়ানো গালের সঙ্গে মেয়ের মসৃণ গৌরবর্ণ গালখানা মিশাইলে, মেয়ের দুই চোখ ঘুমে জড়াইয়া আসিল। শরীরের ব্যথায় মাঝে মাঝে ঘুম ভাঙ্গে, আবার ঘুম আসে। এই চেতন-অচেতনের ফাঁকে ফাকে কেবলই তার মনে হইতে থাকে, এ সংসারে কেবল মা-ই সত্য, আর কিছু না।
পরের দিন তার শরীরের ফোলা কমিয়া গেল, ব্যথা কমিয়া গেল। মনও অনেকট হালকা হইয়া আসিল। মনে তখনো যেটুকু দাহ ছিল, জুড়াইবার জন্য সূতা-কাটা আর জাল-বোনাতে আত্মনিয়োগ করিল। কিন্তু পাড়াতে তার হারানো মর্যাদা আর ফিরিয়া পাইল না।
পাড়ার পাঁচজনের মুখ হইতে ঘটনাটা ভিনজাতের পাড়াতেও ছাপাইয়া পড়িল। এঘটনার পর পাড়ার যুবকদের নিকটই তার মুখ দেখাইতে লজ্জা করিত। তার উপর বামুন কায়েতের যুবকরা পর্যন্ত উঠান দিয়া যাইবার সময় তার ঘরের দিকে উঁকি মারিতে থাকিত। এভাবে লাঞ্ছিত হইয়া শেষে সে ঘরের দরজা বন্ধ করিয়া রাখিত, সারাদিন আর খুলিত না। কিন্তু তবু তার নিস্কৃতি হইল না। একদিন থালা ধুইবার জন্য ঘাটে যাওয়ার সময়ে মঙ্গলার বউ তাকে পথে দেখিতে পাইয়া বলিল, ‘কি গ ভইন, বাড়ির কাছে বাড়ি, ঘরের কাছে ঘর, তবু যে দেখা পাওয়া যায় না, কারণ কি?’
‘শরীর ভাল থাকে না দিদি ৷ মধ্যে মধ্যে জ্বর জ্বর লাগে। আর বাপের জালখান পুরান হইয়া গেছে। মাছের গুতায় টিকে না। নতুন একখান জালও চাই। ঘরে কি পাঁচটা ভাই আছে না ভাই-বউ আছে। একলা আমারই ত বেবাক করন লাগে।‘
‘ত দরজা বন্ধ থাকে কিয়ের লাগি?’
সুবলার বউ ইহার কোন উত্তর দিল না।
‘তা, দুয়ার বন্ধই কর আর যাই কর ভইন, কথাখান নগরে বাজারে জানাজানি হইয়া গেছে।’
সুবলার বউ আগুনের মত জ্বলিয়া উঠিল, ‘কোন কথাখান, কি গ মহনের মা, কোন কথাখান।‘
—আমার কোনো দোষ নাই ভইনসকল। বাজারের লোক যারা তামসীর বাপের বাড়ি তবলা বাজায় তারা কহিয়াছে। তারা বামুন, তার কায়েত। তারা শিক্ষিত লোক। মালোদের চেয়ে তারা বুঝে শুনে বেশি। তাদের দোকান থেকে মালোর জিনিস বাকি আনে। জিয়লের ক্ষেপে, যাইবার সময় তমলুক দিয়া তাদের নিকট হইতে টাকা আনে। বিয়া-শাদিতেও টাকা ধার দেয় তারা। গ্রামের অধিক মালো তাদের বশ। তাদের কথা মালোরা কি গ্রাহ্য না করিয়া পারে। তারা যা বলিয়াছে মালোদের কাছে তা ব্রহ্মার লেখ্। তারা বলিতেছে, বিধবামানুষ দরজা বন্ধ করিয়া থাকে, লাজে মুখ দেখায় না, কি হইয়াছে আমরা কি তাহা বুঝিতে পারি না?
শুনিয়া সুবলার বউ স্তম্ভিত হইয়া গেল। পায়ের তলা হইতে তার যেন মাটি সরিয়া যাইতেছে। কিন্তু সন্ধিৎ হারাইল না। পড়ি পড়ি করিয়া সে বাড়ি চলিয়া আসিল।
ইহার পর যে-কেহ তার দিকে তাকাইত, সে চক্ষু রক্তবর্ণ করিয়া তার দিকে এমনি জ্বলন্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করিত যে, সেখানে তার তিষ্টিবার উপায় থাকিত না। একদিন তামসীর বাপের বাড়ির কাছে দাঁড়াইয়া যারা তবলা বাজায় গান গায়, তাদের লক্ষ্য করিয়া এমন গালি শুরু করিল যে, একঘণ্টার আগে থামিল না। পাড়ার আর আর সব মেয়ের বলিতে লাগিল, মাগো মা, রাঁড়ি যেন একবারে ‘বান্ধে খাড়া’ হইয়াছে।
সে মালোপাড়া হইতে উহাদের পাট উঠাইবাব চেষ্টা করিতে লাগিল। কিন্তু কোন পথ পাইল না। আগের মাতবররা এখন আর তেমন নাই, থাকিলে অনায়াসে একটা বিহিত করা যাইত। যাত্রাবাড়ির রামপ্রসাদ মালো-সমাজে বিধবাবিবাহ চালাইতে গিয়া জব্দ হইয়াছে। গ্রামের চক্রবর্তী ঠাকুর পুরোহিত দর্পণ খুলিয়া মালোদিগকে বুঝাইয়াছে, বিধবার বিবাহ দিলে নরকে যাইতে হইবে। কাজেই ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের কথা শিরোধার্য করিয়া রামপ্রসাদকে তাঁরা অগ্রাহ করিয়াছে। এখন আর মালো-সমাজে তার তত প্রভাব নাই। দয়ালচাঁদ আগে উচিত কথা বলিত। তাদের যাত্রা দলে সেজন্য মুনিঋষি সাজিত। শহরে যাত্রা গাহিয়া তারা তাকে বড়লোকের কাছ থেকে সোনারূপার মেডেল পাওয়াইয়াছে। ইহার পর দয়ালচাঁদও আজকাল ইহাদের দিকেই ঝুকিয়া পড়িয়াছে। এখন আর আগের মত উচিত কথা কহিবে না। কিন্তু সুবলার বউয়ের মধ্যে বিপ্লবী নারী বাস করে। সে দমিতে জানে না।