শুনিয়া বনমালী মন্তব্য করিল, তবে একখানাতে রাধাউক্তি আরেকখানাতে কিষ্ণউক্তি করিল না কেন? পূর্বোক্ত নৌকা হইতে জবাব আসিল, সবখানেই রাধা রে দাদা, সবখানেই রাধা।
চোখা মন্তব্যটা শুনিয়া আশেপাশের নৌকার লোকজন হাসিয়া উঠিল। এমন সময় বড়বাড়ির একজন উদয়তারার মনোযোগ আকর্ষণ করিয়া বলিল, এদিকে শুন ভইন কি মজার গানখান হইতেছে—
ও তোরে দেখিনাই রে, কাল সারা রাত কোথায় ছিলি রে। থানায় থানায় চকিদার পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে, কোন্ কোন্ নারীর শুভ বরাত, আমার বরাত পুড়ে—বরাত পুইড়া গেলরে, কাল সারা রাত কোথায় ছিলি রে ॥
হবিগঞ্জে নবীগঞ্জে কোণাকুণি পথ, প্রাণবন্ধু গড়াইয়া দিছে ইল্শা-পাট্যা নথ—সে নথ পইড়া গেল রে, কাল সারা রাত কোথায় ছিলি রে ॥
শুনিয়া উদয়তারা একটু হাসিল। পরে খানিকক্ষণ কান খাড়া রাখিয়া বলিল—এমন গান আরও কত আছে —অই শুন না, পেটমোটা পাতাম নাওয়ে কি গানখান হইতেছে—সামনে কলার বাগ, পূব-দুয়ারী ঘর। রাইতে যাইও বন্ধু, প্রাণের নাগর।। আরেকখানা গান অনন্তবালার প্রতি সকলকে সচেতন করিয়া তুলিল—তীরের মত লম্বা নাও, কিন্তু চলিতেছে ধীরে ধীরে; চলিতেছে আর গাহিতেছে—ঝিয়ারীর মাথায় লম্বা কেশ, খোঁপা বান্ধে নানান বেশ, খোঁপার উপর গুঞ্জরে ভোমরা।। গাঙে আইলে আঞ্জন মাঞ্জন, বাড়িতে গেলে কেশের যতন, ঝিয়ারী জানি কোন পীড়িতের মরা ॥
গানটা শুনিতে শুনিতে অনন্তবালার বয়সাধিক বড় খোঁপাটা ধরিয়া উদয়তারা আস্তে একটু মোচড়াইয়া দিল।
অনন্ত আর অনন্তবালার চোখ অন্যদিকে। দুইটি প্রকাও মাটির গামলা বিচিত্র রঙে সাজাইয়া, দুইটি করিয়া হাত-বৈঠা হাতে করিয়া দুইটি লোক উহাদিগকে লইয়া ভাসিয়া পড়িয়াছে। উহাদের মুখে গান নাই, হাতে ছন্দ নাই। ফেশন করিয়া চুল দাড়ি ছাঁটাই করা, মাথায় জব জবে তেল, পরিষ্কার ধুতির উপর গায়ে সাদা গেঞ্জি। মুখ টিপিয়া হাসিতেছে। আর জলে বৈঠা ডুবাইয়া এলোমেলো ভাবে টানিয়া আগাইতেছে।
দেখিতে দেখিতে তারা অনন্তদের নৌকার একান্ত নিকটে আসিয়া পড়িয়াছে, আর একটু অসাবধান হইলে তাহাদের নাওয়ের বাতায় ঠেকিয়াই গামলা ভাঙ্গিবে। অনন্তবালা হাত বাড়াইয়া ছুঁইতে গেলে লোক দুইটা বৈঠা দেখাইল। বনমালী মেয়েদের দৃষ্টি আকৃষ্ট করিয়া বলিল, ‘সকলে দৌড়ায় নাও, তাইনে দৌড়ায় গামলা। অনন্ত ও বলিল, ‘জুড়ি কেনে ধরনা তোমরা, দেখতাম কে আগে যাইতে পারে।‘ কিন্তু লোক দুটি এসব কথায় কান দিতেছে না। তাদের দিকে গ্রাম গ্রামান্তরের মেয়েদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হইতেছে, ইহাতেই তাহারা খুশি।
‘আমি কেনে একটা গামলা আনলাম না। তা হইলে ত বৈঠা মাইরা বেশ দৌড়াইতাম।‘ অনন্ত বলিল।
‘তুমি একলা পারতা নাকি, জিগাই? তুমি কি ঐ লোকটার মতন চালাক, না চতুর? বৈঠা হাতে লইয়া চাইয়া থাকবা দৌড়ের নাওয়ের দিকে, শুনা কথা, আর কোনখানের কোন যাত্রিকের নাও দিব ধাক্কা। ঠুনকা গামলা ভাঙ্গলে তখন কি হইব। তুমি আমি দুইজনে থাকলে কোন ডর নাই; তুমি যখন একদিকে চাইয়া থাকবা, গামলারে আমি তখন সামলামু। আর গামলা যদি ভাইঙ্গা যায়, তখন তুমি আমারে সামলাইও, কেমুন?’
‘ঠিক কথা।’
তাহারা এইরূপ কথাবার্তায় ব্যস্ত ছিল, এমনি সময়ে নিতান্ত খাপছাড়া ভাবে উদয়তার হাসিয়া উঠিল। উদয়তারা এমনি। মনে মনে কোনকিছু ভাবিতে থাকে। ভাবিতে ভাবিতে মন তার অনেকদূর আগাইয়া যায়। কোথাও গিয়া তার চিন্তা ঠেকিয়া যায়। তখন সে কোনদিকে না চাহিয়া, কাহারও উপস্থিতি সম্বন্ধে সচেতন না হইয়া, হঠাৎ আপন মনে হাসিয়া উঠে।
স্ত্রীলোকদের একজন, অনন্তবালার কাকীমা, মুখ ফিরাইয়া বলিল, ‘হাসলা কেনে দিদি।‘
‘হাসলাম ভইন একখান কথা মনে কইরা!’
‘কি কথা বেঙের মাথা—ক ও না শুনি।’
উদয়তারা মনে মনে বলিল, সে কথা কি বলা যায়? যে-কথা মনে করিয়া ক্ষণেক্ষণে হাসি, কারুরেই কইলাম না সে কথা—আর তুমি ত তুমি।
অনন্তবালার কাকী তরুণী। কৌতুহলে তুই চোখ ভরা। ছাড়িবার পাত্রী সে নয়। আবার ধরিল। ‘কও না গ দিদি?’
‘কি কমু গ ভইন।‘
‘কেনে হাসলা!’
‘হাসি আইল, হাসলাম।‘
‘জেতা মানুষেরে ভাঁড়াইতে চাও। না কইবা ত না কইবা।’
‘তবে কই শুন। যে-কথাখান মনে কইরা হাসলাম, সেই কথাখান এই—গাঙের উপর দিয়া কত নাও যায়। তারা কত রকমের গান গাইয়া যায়, ভালা গান, বুরা গান—ঘেন্নার গান অঘেন্নার গান! গাইয়া যায় ত?’
‘যায়।’
‘একটু আগেই ত শুনলা, কি বিটলা গান একখান তারা গাইতাছে।’
‘শুনলাম।’
‘তার একটু পরেই শুনলা, একখানা সুন্দর গান গাইয়া গেল।’
‘গেল।’
‘আচ্ছা, এই যে ভালাবুরা গান গাইয়া যায়—আমি ভাবি, গাঙ্গের বুকে ত সেই ভালাবুরার আর কোন রেখ ই থাকে না। থাকে কি?
‘না।‘
‘এইজন্যই হাসলাম।’
‘আমিও কথাখান বুঝলাম।‘
‘বুঝলা যদি, তা হইলে আসল কথাখান কই। অনন্ত আর অনন্তবালা। নামে নামে মিলছে। মনে মনেও মিলছে। কথাখান এই।‘
এমনি সময়ে পাশেই একখানা নৌকা ভিড়িয়াছে, তার মধ্যে একজন স্ত্রীলোককে আরেকজন স্ত্রীলোক এই বলিয়া প্রবোধ দিতেছে, ‘চিন্তা কইরা শরীর কালা কইর না দিদি। গাঙের বুকে কত লোক কত গান গাইয়া যায়, গাঙে কি তার রেখ থাকে?’
এমন সময় অনন্ত ফিসফিস্ করিয়া অনন্তবালার কানের কাছে বলিল, ‘মাসী।‘