কামের সময় দিক করিস না, ভাল লাগে না। বলিয়া ছাদির তাহাকে এক ঝটিকায় ছাড়াইয়া, ঠেলিয়া দিল, তারপর নৌকায় উঠিয়া হালের খুঁটিতে হাত দিল।
আলীর নাম স্মরণ করিয়া তাহার নৌকা খুলিল, শত শত বৈঠা এক সঙ্গে উঠিল, পড়িল, জলের উপর কুয়াসা সৃষ্টি করিল, তারপর তিতাসের বুক চিরিয়া যেন একখানা শিকারীর তীর হিস্ হিস করিয়া ছুটিয়া চলিল।
ছাদির যখন হাল-কাঠি ধরিয়া সারিগানের তালে তালে তক্তার উপর পদাঘাত করিয়া নাচিতেছে, রমু তখন তিতাসের শূন্য তীরে বসিয়া ফোঁফাইয়া ফোঁফাইয়া কাঁদিতেছে। নানা সাধিল, মা সাধিল, কিন্তু কারো কথা সে শুনিল না। মুখে তখনও সে বলিতেছে, ‘বাজান, আমারে লইয়া যাও।‘
তিতাসের বুকে সেদিন অনেকগুলি পালের নৌকা দেখা গেল। সব নেীকারই গতি এক দিকে। যে স্থানে আজ দুপুরের পর নৌকা-দৌড় হইবে, সেই দিক লক্ষ্য করিয়া ছোট বড় নানা আকারের পালের নৌকা ছুটিয়া চলিয়াছে। অনেক নৌকাতেই যত পুরুষ তার বেশি স্ত্রীলোক। বনমালীর নৌকাতেও তাই। পুরুষের মধ্যে বনমালী নিজে আর বড়বাড়ির দুইজন। তাছাড়া অনন্ত। মেয়েদের মধ্যে আসিয়াছে বড়বাড়ির সকলে আর তাদের নন্দিনী অনন্তবালা, আর আসিয়াছে বনমালীর বোন উদয়তারা।
নৌকা-দৌড়ের স্থানটিতে গিয়া দেখে সে এক বিরাট কাও। তিতাসটা এইখান হইতে মাইল খানেক পর্যন্ত অনেকটা মোটা হইয়া গিয়াছে। তারই দুইপার ঘেঁষিয়া হাজার হাজার ছোট বড় ছইওয়ালা নৌকা খুঁটি পুতিয়াছে। কোথাও বড় বড় নৌকা গেরাপি দিয়াছে, আর তাহারই ডাইনে বাঁয়ে ও সামনের দিকে দশ বিশটা ছোট নৌকা তাহাকে আশ্রয় করিয়৷ রহিয়াছে। এই ভাবে যত দূর চোখ মেলা যায়, কেবল নৌকা আর নৌকা, আর তাতে মানুষের বোঝাই। নদীর মাঝখান দিয়া দৌড়ের নৌকার প্রতিযোগিতার পথ।
সবে বেলা পড়িতে শুরু করিয়াছে। প্রতিযোগিতা শুরু হইবে শেষবেলার দিকে। এখন দৌড়ের নৌকাণ্ডলি ধীরেসুস্থে বৈঠা ফেলিয়া নানা সুরের সারিগান গাহিয়া গাঙ্ময় এধার ওধার ঘুরিয়া ফিরিতেছে। হাজার হাজার দর্শকের নৌকা হইতে দর্শকের সে-সব নৌকার কারুকার্য দেখিতেছে, বৈঠা মারিয়া কি করিয়া উহারা জলের কুয়াসা সৃষ্টি করিয়া চলিয়াছে তাহা দেখিতেছে।
এক সঙ্গে এতগুলি দৌড়ের নাও দেখিয়া অনন্তর বুক আনন্দে লাফাইয়া উঠিল। একটা না ও ছাৎ করিয়া অতি নিকট দিয়াই চকিতে চলিয়া গেল, গানের কলিটাও শোনা গেল বেশ—আকাঠ মান্দাইলের নাও, ঝুমুর ঝুমুর করে নাও, জিত্যা আইলাম রে, নাওয়ের গলুই পাইলাম না।
গানের মত গান গাহিতেছে বটে একখান নৌকা। ধীরে সুস্থে চলিতেছে। বৈঠা জলে ছোঁয়াইয়া একসাথে শত শত বৈঠাকে উল্টাইয়া উপরে তুলিতেছে আর বৈঠার গোড়াটাকে একই সাথে নাওয়ের বাতায় ঠেকাইয়া বৈঠাধারীরা সামনের দিকে ঝুঁকিতেছে, আবার বৈঠা তুলিয়া জলে ফেলিতেছে। যেন হাজার ফলার একখানা ছুরি যাইতেছে আর তার সবগুলি ফলা একসাথে উঠিতেছে পড়িতেছে, আবার খাড়া হইয়া শির উচাইতেছে। মাঝখানে থাকিয়া একদল লোক গাহিতেছে, আর বৈঠাধারীরা সকলে এক তালে সে গানের পদগুলির পুনরাবৃত্তি করিতেছে।
তারে ডাক দে, দলানের বাইর হইয়া গো, অ দিদি প্রা-ণ্ বন্ধুরে তোরা ডাক দে ॥
আমার বন্ধু খাইবে ভাত, কিন্যা আনলাম ঝাগুর মাছ গো, অ দিদি দুধের লাগি পাঠাইয়াছি, পয়সা, কি মুকি, কি টেকা গো, আ দিদি প্রাণবন্ধুরে তোরা ডাক দে।।
আমার বন্ধু ঢাকা যায়, গাঙ্ পারে রান্ধিয়া খায় গো, অ দিদি জোয়ারে ভাসাইয়া নিল হাঁড়ি, কি ঘটি, কি বাটি গো, অ দিদি প্রাণ বন্ধুরে তোরা ডাক দে।।
আমার বন্ধু রঙ্গি ঢঙ্গি, হাওরে বেন্ধেছে টঙ্গি গো, আ দিদি, টঙ্গির নাম রেখেছে উদয়তারা, কি তারা গো, আ দিদি প্রাণ বন্ধুরে তোরা ডাক দে।।
আমার বন্ধু আসবে বলি, দুয়ারে না দিলাম খিলি গো, অ দিদি, ধন থুইয়া যৈবন করল চুরি, কি চুরি, কি চুরি গো, অ দিদি প্রাণ বন্ধুরে তোরা ডাক দে।।
উদয়তারা হাসিল, ‘খুব ত গান। মাঝখানে আমার নামখানি ঢুকাইয়া খুইছে।’
সকলেই হাসিয়া উঠিল। কিন্তু সকল নৌকাতেই এমন সুন্দর গান হইতেছে তাহা নয়। একটি নৌকা হইতে শোনা গেল নিতান্ত গদ্যভাবের গান—চাঁদমিয়ারে বলি দিল কে, দারোগা জিজ্ঞাসে, আরে চাঁদমিয়ারে বলি দিল কে ॥ দর্শকদের এক নৌকা হইতে কেউ বলিয়া উঠিল, ও, চিনিয়াছি; বিজেশ্বর গ্রামের নাও, চর দখল করিতে গিয়া উহারাই খুনখুনি করিয়াছিল। গানটা বাঁধিয়াছে সেই ভাব থেকেই।
তারপর যে দুইখানা নাও সারি গাহিয়া গেল, তাহাদের একটি হইতে শোনা গেল—জ্যৈষ্ঠ না আষাঢ় মাসে যমুনা উথলে গো, যাইস না যমুনার জলে। যমুনার ঘাটে যাইতে দেয়ায় করল আন্ধি। পন্থহারা হইয়া আমরা কিষ্ণ বলে কান্দি ॥ যমুনার ঘাটে যাইতে বাইরে-ঘরে জ্বালা। বসন ধরিয়া টানে নন্দের ঘরের কালা ॥
পরের নাওখানার গান শুনিয়া বোঝা গেল রাধা বিপ্রলব্ধা হইয়াছে— আম গাছে আম নাই ইটা কেনে মারো, তোমায় আমায় দেখা নাই আঁখি কেনে ঠারো। তুমি আমি করলাম পীরিত কদমতলায় রইয়া, শক্ত রবাদী পাড়াপড়শী তারা দিল কইয়া।।
সঙ্গের একখানা ছইওয়াল নৌকা হইতে বলিতে শোনা গেল, গোঁসাইপুরের নিকট রাধানগর আর কিষ্টনগর নামে দুই গাও আছে—সেই দুই গ্রামেরই এই দুই নাও।