মাঠে পাঠাইলে সে আমার মত মূৰ্খ চাষাই থাকিয়া যাইবে। দুনিয়ার হাল-অবস্থা কিছুই জানিতে পারিবে না। মানুষ হইতে পারিবে না।
আর ইশ্কলে পাঠাইলে, তোর শ্বশুরের মত মুহুরী হইতে পারিবে আর শাশুড়ীর বিছানায় বৌকে ও বৌয়ের বিছানায় শাশুড়ীকে শোয়াইয়া দিয়া দূরে সরিয়া ঘুষের পয়সা গুণিতে পারিবে। কাজ নাই বাবা অমন লেখাপড়া শিখিয়া।
রমুর মার রাগ হইল। যত দোষ বুঝি আমার বাপের। আমার বাপ ঘুষ খায়; আমার বাপ চুরি করে; আমার বাপ ফল্না করে, তস্কা করে—কি যে না করে!
তুষ্ট থাম, ছাদির ধমক দিল।
না, থামিব না, আমার বাপ যখন অত দোষের দোষী, তখন জানিয়া শুনিয়া এমন চোরের মাইয়া ঘরে আনিলে কেন? আর আনিলেই যদি, খেদাইয়া দিলে না কেন?
খেদাইয়া দিলে আরেক খানে গিয়া খুব সুখে থাকিতে পারিতিস্, না?
আহা, কত সুখেই না আছি এখানে!
বিষমুখী তুই থামিবি, না চোপা বাজাইবি?
ইস থামিবে। আমি বিষমুখী, আমার বাপ চোর, আবার থামিবে।
রাগে ছাদির উঠিয়া গিয়া মারে আর কি। কাদির তাহাকে ঘাড় ধরিয়া বসাইয়া দিল।
মেয়েটার মধ্যে এক বিদ্রোহের মূর্তি দেখা গেল এই প্রথম। কাদিরের মনের কোথায় যেন একটু খোঁচা লাগিল। মুহুরীর মেয়ে জোর গলায় বলিয়া চলিল, ‘চোর হোক ধাওর হোক, তারইত আমি মাইয়া। বাপ হইয়া মার মতন পালছে, খাওয়াইছে ধোয়াইছে—হাজার হোক, তবু বাপ। চোর হইলেও আমারই বাপ, আর কাউর বাপ না। আমি মরলে এই বাপেরই বুক খালি হইব। আর কোন বাপের বুক খালি হইব না।
না হইব না! চোরের মাইয়ার আবার টাস-টাইস্যা কথা। খালি হইব না তোমারে কইল কেডায়?—কাদিরের চোখ ছলছল করিয়া উঠিল। তার জমিলার কথা মনে পড়িয়া বেদনায় বুকটা টনটন করিতে লাগিল, মনে মনে বলিল, মুহুরী যত দোষের দোষী না, তার চাইতে অধিক দোষী করিয়া আমরা এই অসহায় মেয়েটাকে সকলে মিলিয়া জর্জরিত করিতেছি। আমি যত দোষের দোষী না, তার চাইতেও অধিক দোষের দোষী করিয়া তারাও যদি আমার জমিলাকে এমনি জর্জরিত করিতে থাকে, জমিলা কি তখন নিথর পাষাণের মত চুপ করিয়া শোনে আর চেখের জল ফেলে? জমিলা কি তার এতটুকু প্রতিবাদ করে না? করিলে তবু মেয়েটা বাঁচিয়া যাইত মন হালকা করিয়া, কিন্তু না করিলে, সে যখন নিরুপায়ের মত সহিতে হইবে মনে করিয়া তিলে তিলে ক্ষয় হইতে থাকিবে, তখন তাহাকে দুইটা সান্তনার কথা শুনাইবে কে? জমিলা। সে ও মা-মরা মেয়ে। এ যেমন মুহুরীর বুক-সেঁচা ধন, জমিলাও তেমনি কাদিরের বুক-সোঁচ ধন। তবে, বাপ হিসাবে মুহুরীতে আর কাদিরেতে তফাৎ কি? তফাৎ শুধু এই যে, মুহুরী আবার একটা শাদি করিয়াছে। কাদির তার ছেলের দিকে চাহিয়া তাহা করে নাই। আরেকটা শাদি করিয়াও যখন মুহুরী মেয়েটাকে ভুলিতে পারে নাই, তখন কাদির ঘরে একটা গৃহিণী না আনিয়া, ছেলেটার ও মেয়েটার উপর হৃদয়ের সবটুকু ভালবাসা উজাড় করিয়া দিয়া, জমিলাকে কেমন করিয়া ভুলিয়া থাকিবে? কিন্তু তবু ভুলিয়া সে আছে ইহা ঠিক। যদি ভুলিয়া না থাকিত, কতদিন আগে একবার সে দুই দিনের জন্য এখানে আসিয়াছিল —সেই গত অম্ৰাণে—দুই দিন থাকিয়া চলিয়া গিয়াছে। অতদিন আগে সে আসিয়াছিল, ভুলিয়া না থাকিলে এতদিনের মধ্যে দুইবারও কি জমিলাকে এখানে আনা হইত না? কিন্তু কেন কাদির অত আদরের জমিলাকেও ভুলিয়া থাকিতে পারে? কেন? এই রাক্ষুসী মেয়েটারই জন্য নয় কি? সে আসিয়া এ বাড়িতে কাদিরের বুকে জমিলার যে স্থানটুকু ছিল, সেটুকু যদি অধিকার করিয়া না বসিত, বুড়া কাদির কি তাহা হইলে পরের ঘরে মেয়ে দিয়া বাঁচিতে পারিত!
রমুর মা খুশী তখনও গজরাইতেছে, সাধে কি লোকে বলে পরের ঘর। পরের ঘরই ত। যে-ঘরে আসিয়া বাপ হয় চোর, আর নিজে হয় বিষমুখী, সে-ঘর কি আপনা-ঘর! সে ঘর কি পরের ঘর নয়?
হ, হ, পরের ঘর। মুহুরীর মেয়েট বলে কি? রাত না পোহাইতে উঠিয়া বিশটা গরুর গোয়াল সাফ করা, খইলভূষি দেওয়া, ঝাঁটা হাতে বাহির হইয়া এত বড় উঠানবাড়ি পরিষ্কার করা, কলসের পর কলস পানি তোলা, রান্ধ, খাওয়ানো, ধান শুকানো, কাক তাড়ানো, উঠান-ভরতি ধান রোদে হাঁটিয়া পা দিয়া উল্টানো পাল্টানো, তারপর খড় শুকানো, শোলা শুকানো, পাট ইন্দুরে কাটে, তারে দেখা, অত অত ধান ভানা, ফের রান্নাবাড়া করা–এত হাজার রকমের কাজ —পরের ঘরে কি কেউ এত কাজ করে কোন দিন? শরীর মাটি করিয়া এত কাজ যে-ঘরের জন্য করিতেছে, তারে কয় কিনা পরের ঘর। কহিলেই হইল আর কি, মুখের ত আর কেরায়া নাই।
খুশীর চোখে এবার দ্বিগুণ বেগে জল আসিয়া পড়িল। এবার সে ফোঁপাইয়া কাঁদিয়া উঠিল। অনেক কাঁদিবার পর তাহার মনে হইল, এমন কাঁদন কাঁদিয়াও সুখ।
পরিশেষে কাদির বলিল, ‘দে, তোর পুতেরে মক্তবে দে, কিন্তু কইয়া রাখলাম, যদি মিছাকথা শিখে, যদি জালজুয়াচুরি শিখে, যদি পরেরে ঠকাইতে শিখে, তবে তারে আমি কিছু কমু না, শুধু তোমার মাথাটা আমি ফাটাইয়া দিমু, ছাদির মিয়া।’
পরের দিন রমু নূতন লুঙ্গি জামা পরিয়া নূতন টুপি মাথায় দিয়া মক্তবে গেল। পড়িয়া আসিয়া মার কাছ হইতে কিছু খাবার খাইয়া হঠাৎ মনে পড়িয়া গেল, সেই চারজনকে ত নূতন লুঙ্গি গেঞ্জি টুপি দেখানে হয় নাই। মক্তবের ছেলেরা কতবার চাহিয়া দেখিয়াছে। আর সেই চারজন দেখিবে না।