এমন সময় পথে রশিদ মোড়লের সঙ্গে দেখা।
রশিদ মোড়লের খালি পা, লুঙ্গি পুরা, গায়ে একটা ফতুয়া। বয়সে মাগন সরকারের মতই প্রবীণ।
‘রসিদ ভাই!’
‘কি?’
‘দোলগোবিন্দ সা’র খবর শুনছ ত?’
‘তা আর শুনছি না। কলিকাতা থাইক্যা তার ভাতিজার নামে চিঠি আইছে।’
‘অবস্থা নাকি খারাপ?’
‘হ। একেবারে হাতে-বৈঠা-ঘাটে-নাও অবস্থা।‘
‘কি হইব দাদা!’
‘কি অরে হইব, মরব!’
‘মইরা কি হইব?’
রশিদ একটু হাসিল, কিন্তু জানিল না যে, মাগনের একটা ক্ষীণ দীর্ঘশ্বাস তিতাসের ছোট ঢেউয়ের মত বাতাসে একটু ঢেউ খেলাইয়া দিয়া গেল!
পরের দিন সকালে কাদির মিয়া আসিয়া ডাক দিল।
তার চোখ দুইটি দেখিয়া মাগন সত্যই আঁতকাইয়া উঠিল। সে-দুটি চোখ জবাফুলের মত লাল। সারারাত তার ঘুম হয় নাই। কেবল ভাবিয়াছে, আল্লা মানুষ এত বেইমান হয় কেন? মানুষে মানুষকে এতটুকু বিশ্বাস করিবে না কেন? আর কেনই বা মানুষ বিশ্বাসের মাথায় এভাবে নিজ হাতে মুগুর মারিতে থাকিবে। মানুষ না দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ জীব?
এদিকে মাগনেরও সারারাত ঘুম নাই। কাল রাত্রিতে বাড়িতে আসিয়া শুনিয়াছে, দোলগোবিন্দ সাহা আর ইহজগতে নাই। টেলি আসিয়াছে তার ভাইপোর নামে। হায় দোলগোবিন্দ! তুমি, আমি, রসিক ভাই একই ডিঙ্গার কাণ্ডারী, একই চাকরিতে ঘুষ খাইয়া পয়সা করিয়াছি, একই উপায়ে লোককে ঋণের জালে জড়াইয়া ভিটামাটি ছাড়া করিয়াছি, জমিজিরাত দেনার দায়ে নিলাম করিয়াছি; আজি তুমি মরিয়া গিয়াছ। আমিও তো মরিয়া যাইব। হায় দোলগোবিন্দ! তুমি মরিয়া গিয়াছ।
কাদির দেখিয়া অবাক হইল, তারও চোখ দুইটি সন্ধ্যার অস্তরাগের মতই লাল।
কাদির কিছু বলিল না। চুপ করিয়া তার সামনে দাঁড়াইয়া রহিল।
মাগন শিহরিয়া উঠিল, দোহাই তোমার কাদির মিয়া। শুধু একটিবারের জন্য তুমি আমাকে ক্ষমা কর। জীবনে সর্বনাশ তো অনেকেরই করিলাম। আর কারোর সর্বনাশ আমি করিব না, শেষবারের মতো শুধু তোমার এই সর্বনাশটুকু করিতে দাও। বাধা দিওনা, প্রতিবাদ করিও না, শুধু সহ্য করিয়া যাও। এই আমার শেষ কাজ। দেখিবে, তোমাকে ঠকানোর পর থেকে আমি ভাল মানুষ হইয়া যাইব। আর কাউকে ঠকাইব না; এই শেষবারের মত শুধু তোমাকে ঠকাইতে দাও। কাদির হতভম্ভ হইয়া গেল। কিছু না বুঝিয়াই বলিল, তাই হোক মাগন বাবু, আমি সহ্যই করিয়া যাইব। তোমার কোন ভয় নাই, নিৰ্ভয়ে তুমি মামলা চালাও। কোনো সাক্ষীসাবুদ আমি খাড়া করিব না। নীরবে সব স্বীকার করিয়া লইব এবং টাকা ডিগ্রি হওয়ার পর নগদ না থাকে তো জমি বেচিয়া শোধ করিব। তবু তুমি ভাল হও।
পরের দিন খবর পাওয়া গেল, মাগন সরকার মরিয়া গিয়াছে। বড় বীভৎস সে-মৃত্যু। একটা নারিকেল গাছে উঠিয়া মাটির দিকে নাকি সে লাফ দিয়াছিল।
এই সংবাদে কাদিরের মনটা কেমন যেন উদাস হইয়া গেল।
কাজেই ছাদির যখন একদিন প্রস্তাব করিল, এবার শ্রাবণে সে নৌকা দৌড়াইবে, এজন্য দৌড়ের নৌকা একটা বানাইতে হইবে, তার জন্য টাকা চাই, কাদির তখন ঝাঁপি খুলিয়া চার শ টাকা তার হাতে তুলিয়া দিয়া বলিল, নে, নাও বানা, ঘর বানা, পানিতে ফালাইয়া দে। যা খুশি কর।’
অত সহজে কাজ হাসিল হইয়া গেল দেখিয়া ছাদিরের খুশি আর ধরে না।
ছাদিরের কাঠ কেনার প্রসঙ্গে একদিন ঘরে আলোচনা হইল। ছাদির বলিল, ‘সে এক পরস্তাব।‘
গল্পের আভাস পাইয়া রমু তার কোল ঘেঁষিয়া বসিল এবং প্রকাণ্ড একটা বিস্ময়-ভরা জিজ্ঞাসা লইয়া বাপের মুখের দিকে তাকাইয়া রহিল।
তারা নাকি দুজন মালো। গায়ে নাকি তাদের হাতীর মতন জোর। নামও তাদের তেমনি জমকালো—একজনের নাম ইচ্ছারাম মালো, আরেকজনের নাম ঈশ্বর মালো—নিবাস নবীনগর গাঁয়ে।
তারা কি করিয়াছে, না, পাহাড় হইতে বহিয়া আসে যে জলের স্রোত, তারই সঙ্গে সঙ্গে কোমরে কাছি বাঁধিয়া বড় বড় গাছের গুঁড়ি টানিয়া নামাইয়াছে। সে গাছের গুঁড়ি চিরিয়া তক্তা করা হইবে, তাহাতে তৈয়ারী হইবে ছাদিরের দৌড়ের নৌকা, সে নৌকা সে হাজার বৈঠা ফেলিয়া আরও দশবিশটা দৌড়ের নৌকার সঙ্গে পাল্লা দিয়া দৌড়াইবে, আর সব নৌকাকে পাছে ফেলিয়া জয়লাভ করিবে, করিয়া মেডেল পাইবে, পিতলের কলসী পাইবে আর পাইবে বড় একটা খাসি।
‘বেহুদা—একেবারে বেহুদা! এর লাগি কত হাঙ্গামা কইরা নাও গড়াইবি?’ কাদির টাকা দিবার পর একদিন প্রশ্ন করিয়াছিল।
ছাদিরও জবাব দিয়াছিল, ‘জিনিসগুলি খুব থোরা দেখলা, না? কিন্তুক, জিত্লে খালি তোমার আমার গৈরব না, সারা বিরামপুর গাঁওয়ের গৈরব।’
‘একদিন হৈ-হাঙ্গামা করবি, জিতবি, পিতল। কলস পাইবি, মানলাম। তারপর এই-নাও দিয়া তুই করবি কি? কি কামে লাগব এই দেড়শ-হাতি লিক্লিকা পাতাম নাও?’
—কেন, অনেক কাজে লাগিবে। বর্ষার যে-কয়মাস ক্ষেতে-খামারে পানি থাকিবে, এ নৌকা লইয়া বিলে গিয়া বোঝাই-ভরতি ঘাস কাটিয়া আনা যাইবে গাই-গরুর জন্য।
—সে কাজ তো একটা ঘাস কাটা পাতাম দিয়াই চলে?
—চলে, কিন্তু ঘাস কাটা পাতাম দিয়া তো আর নাওদৌড়ানি চলে না। আর এই নাও দিয়া দৌড়ানিও চলে ঘাস কাটাও চলে।
—বিলের পানি শুকাইয়া গেলে তো এ নাও অচল, তখন তারে দিয়া কি করিবি? রোদে তখন সেত খালি ফাটিবে।
–ফাটিবে কেন? গেরাপি দিয়া তারে তিতাসের পানিতে ডুবাইয়া রাখিব, তার পেটে কতগুলি ডালপালা রাখিয়া দিব, আশ্রয় পাইয়া মাছের আসিয়া জমিবে; তখন সময়-সময় জল সেঁচিয়া সে-মাছ ডোলা ভরিয়া বাড়িতে আনিব।