পলকে গান থামিয়া গেল। বাধা পাইয়া গায়কের মুখ বেদনায় মলিন হইয়া গেল। কোন উত্তর না দিয়া সে মাথ৷ নিচু করিল।
ছাদিরের মনে বড় কষ্ট হইল। তাই তো, ওতো কেবল গানই গাহিয়াছে, গানের কথার ভিতর কি আছে না আছে সেদিকে তো তার লক্ষ্য ছিল না। আপন সুরে আপনি মাতোয়ারা হইয়া সে তো কেবল কোন বিস্মৃত যুগের কোন বিরহিণী নারীর কথাগুলি বৈকালী-হাওয়ায় মাঠের বুকে ঢালিয়া দিয়াছে মাত্র। তার দোষ কোথায়? হাঁটুজলে খাল পার হইয়া ছাদির এপারে আসিল, তারপর ছেলের হাত ধরিয়া ফিরিতে ফিরিতে ঘাড় বাঁকাইয়া বলিল, ‘গান থামাইলা কেনে, গুন্গুনাইয়া গাও, গুন্গুনাইয়া গাও।’
উঠানের বুকটা চিতানে। জল জমিতে পারে না, সব সময় শুক্না, ঠন্ঠনে। বিকালে একপাল হাঁসমুরগী সেখানে ঝি-পুত লইয়া চরিয়া বেড়াইয়াছে এবং সারাটা উঠান নোংরা করিয়াছে। গোলায় অজস্র ধান। সারা বছর খাইয়া বিলাইয়া, হাঁড়ি-পাতিল খইয়ের-মোয়া রাখিয়াও সে-ধান কমে না, এমনি অজস্র। ঢেঁকিঘরে সাপের গর্ত ধরা পড়িয়াছে। মাটি খুঁড়িয়া নিঃসন্দেহ না হওয়া পর্যন্ত সেখানে গিয়া ধান ভানা চলে না। জ্যোৎস্না রাতের সাঁঝ। সেই উঠানেরই একদিকে ননদদের লইয়া ধান ভানিতে হইবে। মস্তবড় ঝাটাখানা দুই হাতে ধরিয়া কোমর বাঁকাইয়া অতবড় উঠানখানা ঝাড় দিয়া শেষ করিতে করিতে বেলাটুকু ফুরাইল; নবমী তিথির ঝাপসা চাঁদের আলোয় সেই উঠান চক্চক্ করিয়া উঠিল। এমন সময় দেখা গেল খালের কিনারা হইতে গোপাটের পথ ধরিয়া একটা লোক আগাইয়া আসিতে আসিতে একেবারে উঠানের কোণে আসিয়া পা দিল। চার ভিটায় চারখানা বড় ঘর। কোণাখামচিতে আরো ছোট ছোট ঘর কয়েকখানা আছে। উঠানের পূর্ব-দক্ষিণ কোণ দিয়া তুষ্টঘরের ছায়ায় আসিয়া লোকটা থমকিয়া দাঁড়াইল, চাপা গলায় ডাক দিল—‘পেশ্কারের মা, অ, খুশী!’
খুশী ঝাঁটা নামাইয়া আগাইয়া আসিল, ‘বা’জান তুমি?’
‘হ, আমি।’
‘ঘরে আইঅ।’
‘হাঁ, ঘরেই আসিব, এবার আর বাহিরে থাকিব না। পিঠে ‘গাতি’ বাঁধিয়া আসিয়াছি; গালাগালি করিলে আমিও করিব; মারামারি করিলে আমি ও মারিব। আমি তৈয়ার।‘
খুশী অপমানে মাথা নিচু করিল। গহনার দেন মিটাইতে পারে নাই বলিয়া তার বাপ এমন চোরের মত আসে।
‘তোর পেশ্কার কই?’
‘উত্তরের ঘরে বাপের সাথে কিচ্ছা শুনিতেছে।‘
‘ও, বড় পেশ কার কই?’
খুশী ফিক্ করিয়া একটু হাসিল, ‘হউরের কথা কও! বাজারে গেছে।’
কাদির বাজার হইতে আসিলে তিনজনে তাহার নিকট তিন রকমের তিনপ্রস্ত নালিশ জানাইবে, স্থির হইয়া রহিল। খুশীর পেটে রমুর কোন ভাই-বোন আসিতেছে। এই বিরাট সংসার হইতে সে কিছুদিনের জন্য ছুটি নিয়া বাপের বাড়িতে যাইতে চায়। বাপ মুহুরী। তার বাড়িতে হাল নাই গিরস্তি নাই, সারাদিন কাজের ঝামেলা নাই। এই হাজার কাজের ঝামেলা হইতে দিন কয়েকের ছুটি নিয়া সেখানে একটু নিশ্বাস ফেলিতে চায় সে। বাপ এ কথাই জানাইতে আসিয়াছে কাদিরকে। কিন্তু তাহার নিজে বলার সাহস নাই। এতো আর আদালত নয় যে ধমক দিয়া মক্কেল দাবকাইবে। এ কাদির মিয়ার সংসার, এখানে তারই একচ্ছত্র অধিকার। বাপের অসহায়তা দেখিয়া খুশী নিজেই বিদ্রোহী হইয়া উঠিল। সে নিজেই বলিবে শ্বশুরকে, যে-কথা বাপ বলিতে আসিয়াও বলিতে পারিতেছে না, চোরের মত এক কোণে লুকাইয়া আছে।
আর এক আবেদন ছাদিরের। গত বছরের পাট বিক্রির চারশ টাকা তার চাই, দৌড়ের নৌকা গড়াইবে। শৈশব হইতে বাপের সঙ্গে খাটিতে খাটিতে সে জান কালি করিতেছে। কোনদিন কোন সাধ-আহ্লাদ পুরণের জন্য বাপের কাছে নালিশ জানায় নাই। আজ সে এ নালিশটুকু জানাইবেই। তাতে বাপ রাগিয়া উঠুক আর যাই করুক।
তৃতীয় নালিশ রমুর। নানা তাহাকে শালা বলিবে, একথা শুনাইয়া তার বাপ প্রায়ই তাহাকে অপমান করে। আজ এর একটা হেস্তনেস্ত সে করিবে।
ছোট একটা ঝড়ই বুঝি-বা আসিল। কাদির মিয়া ঘরে ঢুকিলে তেমনি সকলে সন্ত্রস্ত হইয়া উঠিল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তিনজন নালিশকারীই তাহার নিকট আসিয়া উপস্থিত হইল। প্রথমতঃ কাহারও মুখে কোন কথাই জোয়াইল না। একটু দম নিয়া ছাদিরই কথা বলিতে আগাইয়া আসিল। নতুবা স্ত্রী ও পুত্রের নিকট তাহার মর্যাদা থাকে না।
‘বা’জী তোমার হাতে কি?’
‘হাতে খাইয়া-নাচুনী।‘
—পরিষ্কার রাগের কথা। ছাদির নিঃশব্দে বাহির হইয়া গেল। খুশী ঘোমটা টানিয়া ঘরের এক কোণে সরিয়া গেল। রমু নিকটে বসিয়া প্রদীপের আলোয় নানার চক্চকে দাড়িগুলোর ফাঁকে রাগেকম্পিত ঠোঁট দুইটি লক্ষ্য করিতে লাগিল। খড়ম পায়ে দিয়া হাত মুখ ধুইয়া আসিয়া তামাক টানিতে টানিতে কাদির মিয়া ডাকিল, ‘অ ছাদির, অ ছাদির মিয়া!’
ছাদির উঠানে স্ত্রীর নিকট এক ঝুড়ি ধান নামাইয়া দিয়া ছুটিয়া আসিয়া বলিল, ‘বা’জি আমারে ডাক্ছ?’
‘হ, এক বিপদের কথা কই। উজানচরের মাগন সরকার মিছা মামলা লাগাইছে।’
‘মামলা লাগাইছে?’
‘হ, মিছা মামলা। বাপ দাদার আমলের জমি-জিরাত। নেয্য মতে চইয়া খাই! দরকার হইলে ধারকর্জ করি, পাট বিক্রির পর শোধ করি। কারে ফসলের ক্ষেতে পাড়া দেই না, আমারো ফসলের ক্ষেতে কেউ পাড়া দেয় না। তার মধ্যে এমুন গজব!’
‘কি বইলা লাগাইল মামলা?’
‘তিসরা সনের তুফানে বড় ঘর কাইত হইয়া পড়ে, তখন দুই শ টাকা ধার করি। পরের বছর পাট বেচি বার টাকা মণে। কাঁচা টাকা হাতে। আমার বাড়ির গোপাট দিয়া মাইয়ার বাড়ি যাইবার সময় ডাক দিয়া আইন্যা সুদে আসলে দিয়া দিলাম। টাকা নিয়া যাইতে যাইতে কইয়া গেল, গিয়াই তমসুকের কাগজ ছিঁড়া ফালামু, কোন ভাবনা কইর না। এতদিন পরে সেই কাগজ লইয়া আমার নামে নালিশ করছে।‘