‘ঠুন্কা জিনিস লইয়া তারা গাঙে গাঙে চলা-ফিরা করে, নাওয়ে নাওয়ে ঠেস-টাক্কুর লাগলে, মাইট্যা জিনিস ভাইঙ্গা চুরমুচুর হইয়া যায়। তুই যে রকম উটমুইখ্যা, তুই নি পারবি পাতিলের বেপার করতে?’
‘–তা আইলে আম-কাঠালের বেপার করুম।‘
‘নাওয়ে আম-কাঠাল বড় পচে। কোনো গতিকে দুই একটাতে পচন লাগলে, এক ডাকে সবগুলিতে পচন লাগে, তখন নাও ভরতি আম-কাঠাল জলে ফালাইতে হয়। লাভে-মূলে বিনাশ। তুই যে রকম হুঁস-দিশা ছাড়া মানুষ, পচা লাগলে টের নি পাইবি; শেষে আমার বাপের পুঁজি মজাইয়া বাপেরে আমার ফকির বানাইবি।‘
‘–তা হইলে বেপার কইরা কাম নাই।’
‘—হ বাজি। বেপারীরা বড় মিছা কথা কয়। সাত পাঁচ বারো কথা কইয়া লোকেরে ঠকায়; কিনবার সময় বাকি, আর বেচবার সময় নগদ। আর যে পাল্লা দিয়া জিনিস মাপে, তারে কিনবার সময় রাখে কাইত কইরা, আর বেচবার সময় ধরে চিত কইরা। এর লাগি ত’র নানা বেপারীরে দুই চক্ষে দেখতে পারে না। তুই যদি বড় হইয়া ময়-মুরুব্বির হাল্-গিরস্তি ছাইড়া দিয়া বেপারী হইয়া যাস তা হইলে ত’র নানা ত’রেও চোর ডাকব, আর—’
‘আর কি—’
‘শালা ডাকব।’ রমু একটু হাসিয়া ফেলিল; অপমানাহত হইয়া বলিল, ‘অখন আমারে নামাইয়া দে।’ মুখে তার কৃত্রিম ক্ষোভের চিহ্ন।
ক্ষেতে কাজের ধুম পড়িয়াছে। ছাদিরের মোটে অবসর নাই। ছেলের দিকে চাহিবার সময় নাই। ছেলের মার হাতেও এত কাজ যে, দুই হাতের দশগাছ বাঙ্রীর মধ্যে দুইখানা ভাঙ্গিয়া ফেলিল। ছেলের মা হওয়ার পর হইতে সংসারে তার গৌরব বাড়িয়াছে, কিন্তু শ্বশুর কাদির মিয়া তাহাকে ছাড়িয়া কথা কহিলেও তার বাপকে ছাড়িয়া কথা কহিবে না। কোন একবার খাইতে বসিয়া যদি দেখে বেটার বৌর হাতের অতগুলি বাঙ্রীর মধ্যে কয়েকটা কম দেখা যাইতেছে, তবে নিশ্চয়ই শালার বেটি বলিয়া গালি দিবে, কেহ আট্কাইতে পারিবে না। সন্ধ্যায় বেদেনী আসিলে তাহার নিকট হইতে দুই পয়সার দুইটি বাঙ্রী কিনিয়া পুরাইয়া রাখা যাইতে পারে, কিন্তু পয়সা ছাদির দিলে ত! নিজেকে তাহার যেন বড়ই অসহায় মনে হইতে লাগিল। এই রকম মাঝে মাঝে হয়; তখন সে পুত্র রমুর দিকে তাকায়, তাকে আদর করে, কোলে নেয়, ভাবে, সে বড় হইয়া যখন সংসারের দায়িত্বের অংশ লইবে তখন কি তার মীর কিছু কিছু স্বাধীনতা এ সংসারে বর্তাইবে না? এখনও রমুর দিকে চাহিবার জন্য তাহার চোখ দুইটি সতৃষ্ণ হইয়া উঠিল, কিন্তু কোথায় রমু?
রমু ততক্ষণে খালের পাড়ে। হাঁড়ি-বোঝাই নৌকাটির জন্য সারাক্ষণ তার মন কৌতুহলী হইয়া থাকিত। বিকাল পড়িতে বাপকে অনুপস্থিত ও মাকে কাজে ব্যস্ত দেখিয়া সে একবার হাঁড়ির নৌকাখানা দেখিতে আসিয়াছে।
হাঁড়ির একটা পাহাড় যেন ঠেলিয়া মাথা উঁচু করিয়াছে। নৌকাখানা বড়। চারিদিকে খুঁটি গাড়িয়া খোয়াড় বানাইয়া হাঁড়ির কাড়ি পরতে পরতে বড় করিয়াছে। সকালে ঝুড়ি-ঝুড়ি হাঁড়ি বিক্রয় করিতে গায়ে গিয়াছিল। ধান-কড়ি লইয়া ফিরিয়া আসিয়া রাঁধিয়াছে, খাইয়াছে,—এখন উহারা বিশ্রামে ব্যস্ত।
বিরাট একটা দৈত্যের মত নৌকাখান। এখানে আটক পড়িয়াছে। জল শুক্না। নড়িবার চড়িবার ক্ষমতা নাই। কিন্তু লোকগুলির মনে সেজন্য কোনই দুশ্চিন্তা দেখা যাইতেছে না। তারা যেন দিনের পর দিন এইভাবে ঝুড়ি ঝুড়ি হাঁড়ি লইয়া গাঁওয়াল করিতে যাইবে। তারপর সব হাঁড়ি কলসী বিক্রয় হইয়া গেলে একদিন জোয়ার আসিবে, তিতাসের জল ঠেলিয়া খালে আসিয়া ঢুকিবে, এবং বহুদিন পর এই বিরাট দৈত্য গাঁ নাড়া দিয়া উঠিবে। ইহার পর আর তাহাদিগকে কোন দিন দেখা যাইবে না। প্রতি বারে নূতন নূতন গায়ে গিয়া ইহারা পাড়ি জমাইবে। তাই কি তাহাদের মনে স্ফূর্তি? ঠাণ্ডা হাওয়া দিয়াছে, একজন বারমাসী গান তুলিয়াছে— ‘হায় হায়রে, এহিত চৈত্রি না মাসে গিরস্তে বুনে বীজ। আন গো কটোরা ভরি খাইয়া মরি বিষ ॥ বিষ খাইয়া মইরা যামু কানবে বাপ মায়। আর ত না দিবে বিয়া পরবাসীর ঠাঁই ॥‘
রমু তীরে দাঁড়াইয়া মুগ্ধ হইয়া শুনিতেছিল। খালের ওপারে কাঁচি হাতে দাঁড়াইয়া আরও একজন শুনিতেছিল সেই গান। সে ছাদির। কি একটা কাজের কথা মনে পড়ায় সকাল সকাল কাজ সারিয়া বাড়ি ফিরিতেছিল সে।
গান চলিতে লাগিল স্তবকের পর স্তবক—পদের পর পদ। বিরহ-বেদনাচ্ছন্ন করুণ সুরের গানখান বৈকালিক ঠাণ্ডা হাওয়াকে বিষাদে ভারী করিয়া তুলিতেছিল। এক বিচ্ছেদকুলা নারীর এক বুক-সেঁচা ফরিয়াদ পাতিল-ব্যাপারীর কণ্ঠস্বরে যেন ধরা দিয়াছে। সে-নারী মাসের পর মাস প্রিয়-বিচ্ছেদের দুঃখভার গানের তানে হালকা করিয়া দিতেছে।
‘আসিল আষাঢ় মাস হায় হায়রে, এহিত আষাঢ় মাসে গাঙে নয়া পানি। যেহ সাধু পাছে গেছে সেহ আইল আগে। হাম নারীর প্রাণের সাধু খাইছে লঙ্কার বাঘে।।‘
অবশেষে আসিল পৌষ মাস —‘হায় হায়রে, এহিত পৌষ না মাসে পুষ্প অন্ধকারী। এমন সাধের যৈবন রাখিতে না পারি। কেহ চায় রে আড়ে আড়ে কেহ চায় রে রইয়া। কতকাল রাখিব যৈবন লোকের বৈরী হইয়া ॥‘
একটু পরে সন্ধ্যা নামিবে। বৌ-ঝির ওপারের ওই পথ দিয়া নদীতে যাইতেছে, কেহ কেহ ফিরিয়া আসিতেছে। গানের কথাগুলি শুনিয়া ছাদির ব্যথিত হইল। ডাকিয়া বলিল, ‘অ পাতিলের নাইয়া, এই গান তোমরা ইখানে গলা ছাইড়া গাইও না, মানা করলাম।’