কিন্তু অনেকক্ষণ ধরিয়া দেখিতে পাওয়া গেল না। পল্লীর গাছপালা ঘরবাড়ির আড়ালে ঢাকা পড়িয়া গেল। ছেলেরা অনন্তকে সান্ত্বনা দিল, গাঁয়ের এই পাশ দিয়া আড়ালে পড়িয়াছে, ঐ-পাশ দিয়া নিশ্চয়ই বাহির হইবে।
কিন্তু আর বাহির হইল না।
কেন বাহির হইল না জিজ্ঞাসা করিতে ছেলেরা জানাইল, হয়ত ঐ-গাঁয়ের ঐ-পাশটিতে ওদের ঘরবাড়ি। নৌকা সাজাইয়া রঙ করাইয়া লোকজন লইয়া তালিম দিতে গিয়াছিল। পাঁচদিন পরেই বড় নৌকা-দৌড় কিনা। নাও কেমন চলে দেখিবার জন্য একপাক ঘুরিয়া আসিয়াছে। এখন ওদের ঘাটে নৌকা বাঁধিয়া যে-যার বাড়ি খাইতে চলিয়া গিয়াছে।
আর নয় তো ঐ-গায়ের আড়াল দিয়া সোজা চলিয়া গিয়াছে দূরের কোন খলায় দৌড়াইবার জন্য।
শেষের কথাটাই অনন্তর নিকট অধিক যুক্তিসঙ্গত মনে হইল। যেরকম সাপের মত হিস্ হিস্ করিয়া চলিয়াছিল, ঐ-গাঁয়ে উহা থামিতেই পারে না। সারাগায়ে লতাপাতা সাপ ময়ূরের ছবি লইয়া রঙিন দেহ তার একের পর এক পল্লীর পাশ কাটাইয়া আর হাজার হাজার ছেলেমেয়ের মন পাগল করিয়া ছুটিয়াই চলিয়াছে। সারাদিন চলিবার পর কোথায় রাত্রি হইবে কে জানে।
৬.১ রাঙা নাও
চৈত্র মাসের খরায় যখন মাঠঘাট তাতিয়া উঠিয়াছিল, তখন বিরামপুর গ্রামের কিনারা হইতে তিতাসের জল ছিল অনেকখানি দূরে। পল্লীর বুক চিরিয়া যে-পথগুলি তিতাসের জলে আসিয়া মিশিয়াছে, তারা এক একটা ছিল এক-দৌড়ের পথ। কাদিরের ছেলে ছাদির তার পাঁচ বছরের ছেলে রমুকে তেল নাখাইয়া রোজ দুপুরে এই পথ দিয়া তিতাসে গিয়া স্নান করিত। ছাদির তাহাকে কোলে করিয়া ঘাটে যাইত আর তার পেটের ও মুখের জবজবে তেল বাপের কাঁকালে ও কাঁধে লাগিত। বাঁ হাতে বাপের কাঁধ ধরিয়া ডান হাতে সেই তেল মাখাইয়া দিতে দিতে মাঝ পথে রমু জেদ ধরিত, ‘বাজান, তুই আমারে নামাইয়া দে।‘ কিন্তু বাপ কিছুতেই নামাইত না। বরং তার নরম তুলতুলে শরীরখানা দিয়া নিজের শক্ত পেশীবহুল শরীরে রগড়াইতে থাকিত, আর মনে মনে বলিত, কি যে ভাল লাগে।
তারপর ঘাটে গিয়া এক খামচা বালি তুলিয়া নিজের দাঁত মাজিত এবং ছেলের দাঁতও মাজিয়া দিত। গামছা দিয়া ছেলের গা, নিজের গা রগড়াইয়া ছেলেকে লইয়া গলা-জলে গিয়া ডুব দিত। কখনও একটু আলগা করিয়া ধরিয়া বলিত, ‘ছাইড়া দেই?’ রামু তার কাঁধ জড়াইয়া ধরিয়া বলিত, ’দে ছাইড়া।‘
পরিষ্কার জল ফট্ ফট্ করে, তাতে মৃদুমন্দ স্রোত। কাটারিমাছ ভাসিয়া ভাসিয়া খেলা করে। বাপ-ব্যাটার গায়ের তেল জলের উপর ভাসিয়া বেড়ায়, তারই নিচে থাকিয়া ছোট ছোট মাছেরা ফুট ছাড়ে; রমু হাত বাড়াইয়া ধরিতে চেষ্টা করে, পারে না।
ধরিত্রীর সারাটি গ৷ ভীষণ গরম। একমাত্র ঠাণ্ডা এই তিতাসের তলা। জল তার বহিরবয়বে ধরিত্রীর উত্তেজনা ঠেলিয়া নিজের বুকের ভিতরটা সুশীতল রাখিয়াছে এই দুষ্ট বাপ-ব্যাটার জন্য। অনেকক্ষণ ঝাপাইয়া বুপাইয়াও তৃপ্তি হয় না, জল হইতে ডাঙ্গায় উঠিলেই আবার সেই গরম। ছাদির শেষে ছেলেকে বলিল, ‘তুই কান্ধে উঠ, তরে লইয়া পাতাল যামু।‘ রমু কার কাছে যেন গল্প শুনিয়াছে, জলের তলে পাতাল-নাগিনী সাপ থাকে। বলিল, ‘না বা’জান, পাতাল গিয়া কাম নাই, শেষে তরে সাপে খাইলে আমি কি করুম ক’।‘
ছেলেপিলের ভয়-ডর ভাঙ্গাইতে হয়। তাই ধমক দিয়া বলিল, ‘সাপের গুষ্টিরে নিপাত করি, তুই কান্ধে উঠ্। বাপের দুই হাতের আঙ্গুলে শক্ত করিয়া ধরিয়া রমু তার কাঁধে পা রাখিয়া এবং কাঁপিয়া কাঁপিয়া শরীরের ভারসাম্য রাখিতে রাখিতে অবশেষে সটান স্থির হইয়া দাঁড়াইতে পারিল। শেষে খুশির চোটে হাততালি দিতে দিতে বলিল, ‘বাজান, তুই আমারে লইয়া এইবার পাতাল যা।‘
ছেলের খুশিতে তারও খুশি উপ্চাইয়া উঠিল, সেও হাত দুইটা জলের উপর তুলিয়া তালি বাজাইতে বাজাইতে বলিল, ‘দম্ব দম্ব তাই তাই, ঠাকুর লইয়া পুবে যাই।’
ঘাটে নানা বয়সের স্ত্রীলোকেরা নাইতে ধুইতে আসিয়াছিল, কেউ কেউ বলিল—’কি রকম কুয়ারা করে দেখ্।‘
—‘হইব না? কম বয়সে পুলা পাইছে, পেটে থুইব না পিঠে থুইব দিশ্ করতে পারে না।‘
জল হইতে উঠিয়া ছেলের গা মুছাইয়া ছোট দুই-হাতি লুঙ্গিখানা পরাইয়া বলিল, ‘এইবার হাইট্যা যা।’
কয়েক পা আগাইয়া শক্ত মাটিতে পা দিয়া দেখে আগুনের মত গরম। পা ছোয়াইলে পুড়িয়া যাইতে চায়। করুণ চোখে বাপের মুখের দিকে চাহিয়া বলে, ‘বাপ, আমারে কোলে নে, হাঁটতে পারি না।‘
বাপের কোলে চড়িয়া তার বুকের লোমগুলির মধ্যে কচি গালটুকু ঘষিতে ঘষিতে রমু বলিল, ‘বাপ, তুই আমারে খড়ম কিন্যা দে। এমুন ছোট্ট ছোট্ট দুইখান খড়ম, তা হইলে আর ত’র কোলে উঠতে চামু না।‘
‘পাওয়ে গরম লাগে! ওরে আমার মুনশীর পুত্ রে! পাওয়ে গরম লাগলে জমিনে কাম করবি কেমনে?’
উঠানে পা দিবার আরেকটু বাকি আছে। তিতাস হইতে এক চিলতা খাল গ্রামখানাকে পাশ কাটাইয়া সোজা উত্তর দিকে গিয়াছে। মেটে হাঁড়ি-কলসী বোঝাই একটা নৌকা জোয়ারের সময় খালে ঢুকিয়া পড়িয়াছিল, ভাঁটায় আটকা পড়িয়াছে। লাল-কালো হাঁড়িগুলি খালের পাড় ছাড়াইয়া উঁচু হইয়া উঠিয়াছে। এখান হইতে দেখা যায়, রোদে সেগুলি চিক্ চিক্ করিতেছে। সেদিকে আঙ্গুল বাড়াইয়া রমু বলিল, জমিনে কাজ করিবে না, পাতিল বেপার করিবে।