বন্দন শেষ করিয়া পুঁথিখানা বাঁধা হইতেছে। এক বৎসরের জন্য উহাকে রাখিয়া দেওয়া হইবে। আবার শ্রাবণ আসিলে খোলা হইবে। একটা লোক ঝড়ি হইতে বাতাস ও খই বিতরণ করিতেছে। লোকে এক একজন করিয়া খষ্ট বাতাসা লইয়া প্রস্থান করিতেছে। যাহাদের তামাকের পিপাসা আছে তাহারা দেরি করিতেছে। এদিকে পূজার ঘরের অবস্থা দেখিলে কান্না পায়। আগের দিন পূজা হইয়াছে। তখন দীপ জ্বলিয়াছিল, ধূপ জ্বলিয়াছিল; দশ বারোটি তেপায়ায় নৈবেদ্য সাজাইয়া রাখা হইয়াছিল। সদ্য রঙদেওয়া মনসামূর্তি যেন জীবন্ত হইয়া হাসিতেছিল; আর তার সাপ দুইটা বুঝিব। গলা বাড়াইয়া আসিয়া অনন্তকে ছোবলই দিয়া বসে—এমনি চকচকে ঝকঝকে ছিল। আজ তাদের রঙ অন্তরকম। অনিপুণ কারিগরের সস্তায় তৈয়ারী একদিনের জৌলুস, রঙচটা হইয় মান হইয়া গিয়াছে। কোন অসাবধান পূজার্থীর কাপড়ের খুটে লাগিয়া একটা সাপের জিব ও আরেকটা সাপের ল্যাজ ভাঙ্গিয়৷ গিয়াছে। এখন তাহাদের দিকে চাহিলে অনুকম্প জাগে। রাশি রাশি সাপলা ছিল মূর্তির দুই পাশে। ছেলেরা আনিয়া এখন খোসা ছাড়াইয়া খাইতেছে আর অটুট খোসাটার মধ্যে ফু দিয়া বোতল বানাইতেছে। কেউ কেউ সাপলা দিয়া মালা বানাইয়া গলায় পরিতেছে। অনন্ত এতক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়াছিল। একটি ছোট মেয়ে তেমনি কয়েক ছড়া মালা বানাইয়া কাহার গলায় পরাইবে ভাবিতেছিল। অনন্তর দিকে চোখ পড়াতে তাহারই গলায় পরাইয়া দিল। অনন্ত চট করিয়া খুলিয়া আবার মেয়েটির খোঁপায় জড়াইয়া থুইল। চক্ষুর নিমিষে এই কাণ্ডটি ঘটিয়া গেল। মেয়েটির দিকে চাহিলে প্রথমেই চোখ পড়িবে এই খোঁপার উপর। ছোট মেয়ের তুলনায় অনেক বড় সে-খোঁপা। সাত মাথার চুল এক মাথায় করিয়া যেন মা বাঁধিয়া দিয়াছে।
খুশি হইয়া মেয়েটি জিজ্ঞাসা করিল, ‘কোনোদিন ত দেখি নাই তোমারে; তোমার নাম কি?’
‘অনন্ত। আমার নাম অনন্ত।‘
‘দূর, তা কেমনে হয়! ঠিক কইরা কও, তোমার নাম কি?’
‘ঠিক কথাই কই। আমার নাম অনন্ত।‘
‘তবে আমার মত তোমার খোঁপা নাই কেনে; আমার মত তুমি এইরকম কইরা শাডি পর না কেনে? তোমার নাক বিন্ধা নাই কেনে, কান বিন্ধাইয়া কাঠি দেয় নাই কেনে; গোধানি কই, হাতের চুড়ি কই তোমার?’
‘আরে, আমি যে পুরুষ। তুমি ত মাইয়া।‘
‘তবে তোমার নাম অনন্ত না?’
‘না! কেনে?’
‘অনন্ত যে আমার নাম। তোমার এই নাম হইতে পারে না।‘
‘পারে না? ওমা, কেনে পারে না?’
‘তুমি পুরুষ। আমার নাম কি তোমার নাম হইতে পারে?’
‘হইতে পারে না যদি, তবে এই নাম আমার রাখল কেনে। আমার মা নিজে এই নাম রাখছে। মাসীও জানে।‘
‘কেবল মাসী জানে? আর কেউ না?’
‘যে-বাড়িতে আছি, তারা দুই ভাই-ভইনেও জানে।’
‘এই! আর কেউ না! ওমা, শুন’ তবে। আমার নাম রাখছে গণক ঠাকুরে। জানে আমার মায় বাবায়, সাত কাকায়, আর পাঁচ কাকীয়ে; আব ছয় দাদা আর তিন দিদিয়ে, চার মাসী দুই পিসিয়ে।‘
‘ও বাব্বা৷ ‘
‘আরো কত লোকে যে জানে। আর কত আদর যে করে। কেউ মারে না আমারে।‘
‘আমারেও কেউ মারে না। এক বুড়ি মারত, মাসী তারে আটকাইত।‘
‘মাসী আটকাইত, ত মা আটকাইত না?’
‘আমার মা নাই।‘
মেয়েটি এইবার বিগলিত হইয়া উঠিল, ‘নাই! হায়গো কপাল! মানুষে কয়, মা নাই যার ছাড় কপাল তার। ‘
অনন্তর নিজেকে বড় ছোট মনে হইল। চট করিয়া বলিল, ‘মাসী তাছে।’
মেয়েটি ভুরু বাকাইয়া একটা নিশ্বাস ছাড়িল, ‘মাসী আছে তোমার, তবু ভালা। মানুষে কয়, তীর্থের মধ্যে কাশী ইষ্টির মধ্যে মাসী, ধানের মধ্যে খামা কুটুমের মধ্যে মামা।‘—বলিয়া হঠাৎ মেয়েটি কোথায় চলিয়া গেল।
অনন্ত মনে মনে ভাবিল, বাব্বা, খুব যে শিলোক ছাড়ে। উদয়তারার কাছে একবার নিয়া গেলে মন্দ হয় না।
একটু পরেই পুজামণ্ডপের সামনে মেয়েটির সহিত আবার দেখা হইল।
‘আচ্ছা, আমারে তোমার মাসীর বাড়ি লইয়া যাইবা?’
‘কেমনে লইয়া যামু। অনেক দূর যে। নাওয়ে গেলে এক দুপুরের পথ।‘
‘মানুষে কি মানুষেরে দূরের দেশে লইয়া যায় না?’
‘যায়। কিন্তু অখন যায় না। বৈশাখ মাসে তিতাসের পারে মেলা হয়। তখন লইয়া যায়। অনেক দূর থাইক্যা অনেক মানুষ তখন অনেক মানুষেরে লইয়া যায়!’
‘তখন আমরেও লইয়া যাইও। কেমুন?’
‘আমারত নাও নাই। আচ্ছা বনমালীরে কইয়া রাখুম। তার নাওয়ে যাইতে পারবা।’
‘পরের নাওয়ে বাবা যাইতে দিলে ত?’
‘খালের টেকের ভাঙ্গা নাওয়ের খোড়ল থাইক্যা সাতদিনের উপাসী মানুষেরে যে-জন বাইর কইরা আনল, তারে কও তুমি পর। কি যে তুমি কও।‘
মেয়েটির চোখমুখ উজ্জ্বল হইয়া উঠিল, ‘খালের টেকে ভাঙ্গা নাওয়ের খোড়লে তুমি থাকতা, ডর করত না তোমার? রাইতে দেও-দৈত্য যদি দেখা দিত। কও না, কি কইরা তুমি থাক্তা এক্লা—‘
‘সে এক পরস্তাবের কথা। কইতে গেলে তিনদিন লাগব!’
‘তোমরার গাঁওয়ে আমারে লইয়া যাইবা? সেই নাওখান দেখাইবা?’
‘আচ্ছা নিয়া যামু।’
‘নিবা যে, তোমার মাসী আমারে আদর করব ত তোমার মত?’
‘হ, তোমারে করব আদর। আমারেই বইক্যা বাইর কইরা দিল।’
‘কও কি! বাইর কইরা দিল, আর ডাইক্য ঘরে নিল না?’
‘না।‘
‘তবে গিয়া কাম নাই। তুমি আম্রার বাড়িতেই চল। কেউ তোমারে বাইর কইরা দিব না। যদি দেয়ও, আমি তোমারে ডাইক্যা ঘরে নিমু।’
কথাগুলি অনন্তর খুব ভাল লাগিল। একঘর ভরতি লোকের মধ্যে থাকিতে খুব ভাল লাগিবে। সেখানে দশটি লোকে দশ রকমের কথা বলিবে, বিশ হাতে কাজ করিবে, দশমুখে গল্প করিবে—একটা কলরবে মুখরিত থাকিবে ঘরখানা। তার মধ্যে এই চঞ্চল মেয়েটি তার সঙ্গে খেলা করিবে, জালবোন মাছধরা খেলা। অনন্ত সত্যিকারের জেলে হইয়া নৌকাতে না উঠা পর্যন্ত তাকে এই খেলার মধ্য দিয়াই জাল ফেলা জাল তোলা আয়ত্ত করিতে হইবে।