ভাবিতে ভাবিতে উদয়তারা একসময় ফিক করিয়া হাসিয়া ফেলিল।
কনেবে চুল বাঁধিতে বাঁধিতে বলিল, ‘কি লা উদি, হাসলি যে?’
‘হাসি পাইল, হাসলাম। আচ্ছা, আমি ত তোর বর হইলাম, আমার মুখের দিকে চাইতে তোর লাজ লাগে নাই?’
‘শুন কথা। সত্যের বিয়ার বরেরেই লাজ করলাম না, তুই ত আমার জালা বিয়ার বর।‘
‘সত্যের বিয়ার বরেরে তোর লাজ করে নাই? ওম কেনে, লাজ করল না কেনে?’
‘সেই-কথা এক পরস্তাবের মত! বর আমার বাপের কাছে মুনী খাট্ত। মা বাপ কেউ আছিল না তার। সুতা পাকাইত আর জাল বুনত। আমার বয়স আট বছর, আর তার বার বছর। সেইন সময়ে বাপে দিল বিয়া। এক সঙ্গে খেলাইছি বেড়াইছি, মাছ ধরছি মাছ কাট্ছি, আমি নি ডরামু তারে!’
‘ও মা! সেই কথা ক।‘
‘একটা মজার কথা কই, শুন। বিয়ার কালে আমি ত ফুল ছিট্লাম তার মাথায়, সে যত ছিট্তে লাগল, কোন ফুলই আমার মাথায় পড়ল না। ডাইনে-বায়ে কাঁধে-পিঠে পড়তে লাগল, কিন্তুক মাথায় পড়ল না। কারোরে আমি ছাইড়া কথা কই না, আর সে ত আমরার বাড়িরই মানুষ —খুব রাগ হইল আমার। তেজ কইরা কইলাম, ভাল কইরা ছিট্তে পার না? মাথায় পড়ে না কেনে ফুল? ডাইনে-বায়ে পড়ে কেনে? কাজের ভাস্সি নাই, খাওনের গোঁসাই!’
‘বরেরে তুই এমুন গালি পাড়লি? তোর মুখ ত কম খরোধরো আছিল না? বর কি করল তখন?’
‘এক মুঠ ফুল রাগ কইরা আমার চোখেমুখে ছুঁইড়া মারল’—
‘খুব আস্পর্দা ত! তুই সইয়া গেলি?’
‘না।’
‘কি করলি তুই?’
‘এক ভেংচি দিলাম।’
‘তুই আমারে তেমুন কইরা একটা ভেংচি দে না!’
‘ধেৎ। তুই কি আমার সত্যের বর? তুই ত মাইয়া মানুষ!’
‘তবে আমি তোরে দেই।’
‘ধেৎ, আমরা কি আর অখন ছোট রইছি?’
কি এমুন বড় হইয়া গেছি। বারোবছর বয়সে বিয়া হইছিল, তারপর ন’বছর –মোটে ত একুশ বছর। এর মধ্যেই বড় হইয়া গেলাম?’
বড় হইয়া গেলি কি গেলি না, বুঝতি যদি কোলে দুই একটা ছাও-বাচ্ছা থাক্ত। জীবনে একটারও গু-মুত কাচাইলি না, তোর মন কাঁচা শরীল কাঁচা, তাই মনে হয় বড় হইলি না; যদি পুলাপান হইত, বয়সও মালুম হইত।
‘সেই কথা ক।’
তারপর চারিদিক আঁধার হইয়া আসিল। শাদা শাদা অজস্র সাপলা ফুলে শোভিত, সর্পাসনা মনসা মূর্তিটি অনন্তর চোখের সামনে ঝাপসা হইয়া আসিল, অন্যান্য পূজাবাড়িগুলিরও গান ধুমধাম ক্রমে অস্পষ্ট হইয়া একসময় থামিয়া গেল।
শ্রাবণ মাসের শেষ তারিখটিতে মালোদের ঘরে ঘরে এই মনসা পূজা হয়। অন্যান্য পুজার চাইতে এই পূজার খরচ কম, আনন্দ বেশি। মালোর ছেলেরা ডিঙ্গি নৌকায় চড়িয়া জলভরা বিলে লগি ঠেলিয়া আলোড়ন তোলে। সেখানে পাতাল ফুঁড়িয়া ভাসিয়া উঠে সাপের মতো লিক্লিকে সাপলা। শাদ শাদা ফুল ফুটিয়া বিল জুড়িয়া ছত্রাইয়া থাকে। যতদূর চোখ যায় কেবল ফুল আর ফুল—শাদা মাণিকের মেলা যেন। ঘাড়ে ধরিয়া টান দিলে কোন এক জায়গায় সাপলাটা ছিঁড়িয়া যায়, তারপর টানিয়া তোল—খালি টানো আর টানো, শেষ হইবে না শীঘ্র। এইভাবে তারা এক বোঝাই সাপলা তুলিয়া আনে। মাছের ঘুরিয়া ফিরিয়া দেখে —মালোর ছেলের কেমন সাপলা তুলিতেছে। সাপলা তোলার ফাঁকে ফাঁকে মালোর ছেলেরাও চাহিয়া দেখে। জল শুকাইবে, বিলে বাধ পড়িবে, তখন বেঘোরে প্রাণ হারাইতে হইবে—এসব জানিয়া শুনিয়াও বোকা মাছেরা, কিসের মায়ায় যেন বিলের নিষ্কম্প জলে তিষ্ঠাইয়া আছে। তিতাসের স্রোতাল জলে নামিয়। পড়িলে, অত শীঘ্র ধরা পড়িবার ভয় থাকিবে না, ধরা যদি পড়েও, পড়িবে মালোদের জালে; সেখান থেকে লাফাইয়াও পালানো যায়। কিন্তু নমশূদ্রের বাঁধে পড়িলে হাজারবার লাফাইলেও নিস্তার নাই।
মনসার পুষ্পসজ্জা শেষ হইলে পুরোহিত আসে! মালোদের পুরোহিত ডুমুরের ফুলের মত দুর্লভ। একজন পুরোহিতকে দশবারো গাঁয়ে এক একদিনে মনসা পূজা করিয়া বেড়াইতে হয়। গলায় একখানা চাঁদর ঝুলাইয়া ও হাতে একখানা পুরোহিত দর্পণ লইয়া আসিয়া অমনি তাড়া দেয়—শীঘ্গির। তারপর বারকয়েক নম নম করিয়া এক এক বাড়ির পূজা শেষ করে, দক্ষিণা আদায় করে। এবং আধঘণ্টার মধ্যে সারা গায়ের পূজা শেষ করিয়া তেমনি ব্যস্ততার সহিত কোনো মালোকে ডাকিয়া বলে, ‘অ বিন্দাবন, তোর নাওখান্ দিয়া আমারে ভাটি-সাদকপুরে লইয়া যা।‘
৫.৬ রামধনু
শ্রাবণের শেষ দিন পর্যন্ত পদ্মাপুরাণ পড়া হয়, কিন্তু পুঁথি সমাপ্ত করা হয় না। লখিন্দরের পুনর্মিলন ও মনসা-বন্দনা বলিয়া শেষ দুইটি পরিচ্ছেদ রাখিয়া দেওয়া হয় এবং তাহা পড়া হয় মনসা পূজার পরের দিন সকালে, সেদিন মালোর জাল বাহিতে যায় না। খুব করিয়া পদ্মাপুরাণ গায় আর খোল করতাল বাজায়।
শেষ দিন বনমালীর গলাটা ভাঙ্গিয়া গেল। এক হাতে গলি চাপিয়া ধরিয়া, চোখ দুইটা বড় করিয়া, গলায় যথাসম্ভব জোর দিয়া শেষ দিশা তুলিল, ‘বিউনি হাতে লৈয়া বিপুলায়ে বলে, কে নিবি বিউনি লক্ষটেকার মূলে।‘ কিন্তু স্বরে আর জোর বাঁধিল না; ভাঙ্গা বাঁশের বাঁশীর মতো বেসুরে বাজিল। অন্যান্য যারা দোহার ধরিবে তাদের গলা অনেকের আগেই ভঙ্গিয়া গিয়াছে তারাও চেষ্টা করিয়া দেখিল স্বর বাহির হয় না। তারা পদ্মাপুরাণ পড়া শেষ করিল। বেহুলা বিজনী বেচিতে আসিয়াছে, জায়েদের নিকটে গোপনে ডোমনীর বেশ ধরিয়া। শেষে পরিচয় হইল এবং চাঁদসদাগরের পরাজয় হইল; সে মনসা পূজা করিয়া ঘরে ঘরে মনসার পূজা খাওয়ার পথ করিয়া দিল।