তবে আর তাকে উদয়তারার সাথে গোকনগণ ওয়ে দিয়া কাজ নাই, এখানেই রাখ। সামনে তিন মাস পরেই মুদিন। বনমালী স্বীকৃত হইয়া বাড়ি আসিল। কিন্তু ব্যবস্থাটা উদয়তারার মনঃপূত হইল না।
কয়েক দিন আগে পাড়াতে একটা বিবাহ গিয়াছে। এখন জামাই আসিয়াছে দ্বিৰাগমনে। যুবতীরা এবং অনুকূল সম্পর্কযুক্ত বর্ষীয়সীরা মিলিয়া ঠিক করিল জামাইকে আচ্ছ। ঠকান ঠকাইতে হইবে। জামাই অনেকগুলি খারাপ কাজ করিয়াছে। প্রথমতঃ সে তাদের জন্য পান-বাতাসা, পানের মসলা এ-সব আনে নাই; দুপুরে তার স্নানের আগে মেয়েরা গাহিতে লাগিল; জামাই খাইতে জানে, নিতে জানে, দিতে জানে না, তারে তোমরা ভদ্র বইলো না। জামাই যদি ভদ্র হইত, বাতাসার হাঁড়ি আগে দিত, জামাই খাইতে জানে, নিতে জানে ইত্যাদি। কিন্তু, উহু, তাতেও কুলাইবে না। খুব করিয়া ঠকাইতে হইবে। কিন্তু কি ভাবে জব্দ করা যায় তাকে। একজন সমাধান করিল, ভয় কি জামাই-ঠকানী আছে, বনমালীর বোন জামাই-ঠকানী। সকলেষ্ট যেন সাতারে অবলম্বন পাইল, বলিল, লইয়া আয় জামাইঠকানীরে? সমাগত নারীদের অবাক করিয়া দিয়া উদয়তারা জানাইল যাইতে পারিবে না।
শ্রাবণ মাস শেষ হইয়াছে, পদ্মাপুরাণও পড়া শেষ হইল। ঘরে ঘরে মনসা পূজার আয়োজন করিয়াছে। আর করিয়াছে জালা বিয়া’র আয়োজন। বেহুলাসতী মরা লখিন্দরকে লইয়া পুরীর বাহির হইবার সময় শাশুড়ী ও জা’দিগকে কতকগুলি সিদ্ধ ধান দিয়া বলিয়াছিল, আমার স্বামী যেদিন বাঁচিয়া উঠিবে, এই ধানগুলিতে সেদিন চারা বাহির হইবে। চারা তাতে যথাকলেই বাহির হইয়াছিল। এই ইতিহাস পুরাণরচয়িতার অজানা হইলেও মালোপাড়ার মেয়েদের অজানা নাই। তারা বেহুলার এয়োস্তালির স্মারকচিহ্নরূপে মনসা পূজার দিন এক অভিনব বিবাহের আয়োজন করে। ধানের চারা বা জালা এর প্রধান উপকরণ। তাই এর নাম জালাবিয়া। এক মেয়ে বরের মত সোজা হইয়া চেকিতে দাঁড়ায়, আরেক মেয়ে কনের মত সাতবার তাকে প্রদক্ষিণ করে, দীপদানির মত একখানি পাত্রে ধানের চারাগুলি রাখিয়া বরের মুখের কাছে নিয়া প্রতিবার নিছিয়া-পুছিয়া লয়। এইভাবে জোড়ায় জোড়ায় নারীদের মধ্যে বিবাহ হইতে থাকে আর একদল নারী গীত গাহিয়া চলে।
পূজার দিন এক সমবয়সিনী ধরিল, ‘দুই বছর আগে তুই আমারে বিয়া কইরা রাখছিলি, মনে আছে? এইবছর তোরে আমি বিয়া করি কেমুন লা উদি।‘
‘ন ভইন।‘
‘তবে তুই কর আমারে।‘
‘না ভইন। আমার ভাল লাগে না।’
বিয়ের কথায় অনন্তর আমোদ জাগিল, ‘কর না বিয়া, অত যখন কয়?
‘তুই কস্? আচ্ছা তা হইলে করতে পারি।’
কি মজা। উদয়তারা নিজে মেয়ে হইয়া আরেকজন মেয়েকে বিবাহ করিতেছে! দুইজনেরই মাথায় ঘোমটা, কি মজা। কিন্তু অনন্তর কাছে তার চাইতে ও মজার জিনিস মেয়েদের গান গাওয়াটা। তারা গাহিতেছে এই মর্মের এক গান : অবিবাহিতা বালিকার মাথায় লখাই ছাতা ধরিয়াছে; কিন্তু বালিকা লখাইকে একটাও পয়স। কড়ি দিতেছে না; ওরে লখাই, তুই বালিকার মাথায় ছাত। ধরা ছাড়িয়া দে, কড়ি আমি দিব। তারপরের গান : ‘সেই দোকানে যায় গো বালা ঘট কিনিবারে।‘ সেই ঘটে মনসা পূজা হইল, কিন্তু মনসা নদী পার হইবে কেমন করিয়া। এক জেলে, নৌকা নিয়া জাল পাতিয়াছিল। মনসা তাকে ডাকিয়া বলিল, তোর না খান দে আমি পার হই, তোকে ধনে পুত্রে বড় করিয়া দিব। উদয়তারার এক ননাসের নাম ছিল মনসা। তাই মনসাপূজা বলিতে পারে না। স্বামী যেমন মান্ত, স্বামীর বড় বোনও তেমনি মান্য। সে কনে-বোটিকে লক্ষ্য করিয়া বলিল, ‘শাওনাই পূজা ত হইয়া গেল ভইন, সামনে আছে আর নাও-দোঁড়ানি। বড় ভাল লাগে এইসব পূজা-পালি হুড় ম-হড়ম নিয়া থাকতে।’
কনে-বৌ মাথার ঘোমটা ফেলিয়া দিয়া কাসেব থালায় ধানদূর্ব পঞ্চপ্রদীপ ইত্যাদি তুলিতে তুলিতে বলিল, তারপর কত পূজাই ত আছে—দুর্গাপূজা, লক্ষ্মীপূজা, কালীপূজা, কার্তিকপূজা, ভাইফোঁটা’—
‘কিন্তু তা ত কত পরের কথা। শাওন মাস, ভাদর মাস, তারপরে ত আইব বড় ঠাকরাইন পূজা।‘
কিন্তু দুই মাস ত মোটে—তেমন কি বেশি। ক্ষেতপাথারের জল কমিতে লাগিবে পনর দিন। তিতাসের জল কমিয়া তার পাড়ে পাড়ে পথ পড়িতে লাগিবে আরও পনর দিন। তখন বর্ষা শেষ হইয়া যাইবে। গাঙ-বিলের দিকে চাও, দেখিবে পরিষ্কার—দিনের দিকে চাও, পরিষ্কার। কিন্তু ঘর বাড়ির দিকে চাও– পরিষ্কার দেখ কি! দেখ না। পরিস্কার না করিলে পরিষ্কার দেখিবে কি করিয়া! চারিদিকে পুজা-পূজা ভাব। লাগিয়া যাও ঘরবাড়ি পরিষ্কার করার কাজে! কিন্তু কি ঘরবাড়ি পরিষ্কার করিবে তুমি? ভাঙ্গা ঘরবাড়ি? না, পুরুষ আছে কোন দিনের তরে? বর্ষাকালে একটানা বৃষ্টির জলে ধা’র ভাঙ্গিয়াছে, পিড়া ভাঙ্গিয়াছে, কি খুব সুন্দর দেখাইয়াছিল না সেদিন। তিন চারি জনে ধরিয়া তাহাকে চুল আঁচড়ানো, তেল-সিন্দুর পরানো, চন্দনতিলক লাগানো প্রভৃতি প্রসাধন কর্ম করিয়াছিল। একটা কলার ডিগা সে মানুষটার গালে বুলাইয়াছিল—সে তখন ছোট বালিকা মাত্র, বুকটা তার ভয়ে তুরু হুরু করিতেছিল। চাহিতে পারিতেছিল না লোকটার চোখের দিকে, অথচ চারি দিক হইতে লোকজনে চীৎকার করিয়া কহিতেছিল, চাও, চাও, চাও, দেখ, এই সময়ে ভাল করিয়া চাহিয়া দেখ—চারিজনে পি’ড়ির চারিটা কোণা ধরিয়া তাহাকে উঁচু করিয়া তুলিয়াছিল –এই সময়ে সে একটুখানি চাহিয়া দেখিয়াছিল—মাত্র একটুখানি, আর চাহিতে পারে নাই, অমনি চোখ নত করিয়াছিল। সেদিন মোটে চাওয়া যায় নাই, তার দিকে। কিন্তু আজ! কতবার চাওয়া যায়, কোন কষ্ট হয় না, কিন্তু সেইদিনের একটুখানি চাওয়ার মত তেমন আর লাগে কি; সে চাওয়ার মধ্যে যে স্বাদ ছিল, সে-স্বাদ কোথায় গেল!