কেন আমি কি দোকানের গামছা না সাবান! কোন সাহসে আমাকে কিনিয়া নিতে চায় —অনন্ত এই কথা কয়টি মনে মনেই ভাবিল। প্রকাশ করিয়া বলিল না।
অনন্ত ও অন্যান্য পুরুষ মানুষদের খাওয়া হইয়া গেলে তিন বোনে এক পাতে বসিয়া অনেকক্ষণ ধরিয়া খাইল। তারপর পাশের ঘরে তিন পুরুষের বিছানা করিয়া দিয়া, অনন্তকে এ ঘরে শোয়াইয়া, তিন বোনে পিঠা বানাইতে বসিল।
রাত অনেক হইয়াছে। প্রদীপের শিখা তিন বোনের মুখে হাতে কাপড়ে আলো দিয়াছে। পিছনের বড় বড় ছায় দেওয়ালে গিয়া পড়িয়াছে। ভাবে বোঝা গেল, তারা আজ সারারাত না ঘুমাইয়া কাটাইবে।
‘ঘুম আইলে কি করুম? ছোট বোন জিজ্ঞাসা করিল।
‘উদয়তারা শিলোকের রাজা। শিলোক দেউক, তার আমরা মানতি করি—ঘুম তা হইলে পলাইব। বলিল বড় বোন।
উদয়তারা একদল কাই হাতের তালুতে দলিতে দলিতে বলিল, ‘হিজল গাছে বিজল ধরে, সন্ধ্যা হইলে ভাইঙ্গা পড়ে —কও, এই কথার মান্তি কি?’
‘এই কথার মাস্তি হাট।‘ বলিল আসমানতারা।
‘আচ্ছা,—পানির তলে বিন্দাজী গাছ ঝিকিমিকি করে, ইলস মাছে ঠোকর দিলে ঝরঝরাইয়া পড়ে?’
বড় বোন মানে বলিয়া দিল—‘কুয়াসা।‘
এইভাবে অনেকক্ষণ চলিল। অনন্তর খুব আমোদ লাগিতেছিল, কিন্তু ঘুমের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়া পারিল না। শুনিতে শুনিতে সে এক সময় ঘুমাইয়া পড়িল।
নিশুতি রাতে আপনা-থেকে ঘুম ভাঙ্গিয়া গেল। তিন বোন তখনও অক্লাস্ত ভাবে হেঁয়ালী বলিতেছে আর হাত চালাইতেছে। তন্দ্রাচ্ছন্ন চোখ মুদিয়া অনন্ত তখনও কানে শুনিতেছে —‘আদা চাক্চাক দুধের বর্ণ, এ শিলোক না ভাঙ্গাইলে বৃথা জন্ম।’
এর মাস্তি—টাকা, বলিয়া এক বোন পাল্টা তীর ছাড়ে—
ভোরের আঁধার ফিক হইবার সঙ্গে সঙ্গে অনন্তর ঘুম পাতলা হইয়া আসিল। উঠান দিয়া কে মন্দিরা বাজাইয়া গাহিয়া চলিয়াছে,—
রাই জাগো গো, আমার ধনী জাগো গো,
বৃন্দাবন বিলাসিনী রাই জাগো গো।
অনন্ত উঠিয়া পড়িল। পিঠা বানাইতে বানাইতে তিন বান কখন এক সময় শুইয়া পড়িয়াছিল। অর্ধসমাপ্ত পিঠাগুলি অগোছালো পড়িয়া আছে, আর তিন বোনে জড়াজড়ি করিয়া অঘোরে ঘুমাইতেছে। প্রদীপটা এখনও জ্বলিতেছে, তবে উস্কাইয়া দেওয়ার লোকের অভাবে আর জ্বলিতে পারিবে না, এ স্বাক্ষর তার শিখায় স্পষ্ট হইয়া উঠিতেছে।
অনন্ত বাহিরে আসিল। ও-ঘরে তিনজন ঘুমাইয়াছিল, তারা নাই। শেষরাতে বনমালী জালে গিয়াছে, অতিথি &জনও সঙ্গে গিয়াছে, এখানকার মাছধরা সম্বন্ধে জানিবার বুঝিবার।
পূবের আকাশ ধীরে ধীরে খুলিতেছে। স্নিগ্ধ নীলাভ মৃদু আলো ফুটিতেছে। চারিদিকে একটানা ঝিঁঝির ডাক। গাছে গাছে পাখির কলরব। মন্দিরা বাজাইয়া লোকটা এ-পাড় হইতে ও-পাড়ায় চলিয়া গিয়াছে! তার গানের শেষ কলি মন্দিরার টুনটুনটুন আওয়াজের সঙ্গে অনন্তর কানে আসি৷ বাজে,—
শুক বলে ওগো সারী কত নিদ্রা যাও,
আপনে জাগিয়া আগে বন্ধুরে জাগাও;
আমার রাই জাগো গো, আমার ধনী জাগো গো,
বৃন্দাবন বিলাসিনী, রাই জাগো গো।
অনন্ত উঠানের পর উঠান পার হইয়া চলিল। যুবকরা সব নদীতে গিয়াছে। বাড়িতে আছে বুড়ার আর বৌ ঝি মায়ের। বুড়ার সকালে উঠিয়া তুলসীতলায় প্রণাম করিতেছে। প্রত্যেক বাড়িতে তুলসী গাছ, উঁচু একটা ছোট বেদীর উপর। দুই পাশে দুই চারিট ফুলের গাছ। মিষ্টি গন্ধ। বৌর উঠানগুলি ঝাড় দিয়াছে, এখন গোবরছড়া দিতেছে। হাঁটিতে হাঁটিতে এক উঠানে গিয়া দেখে, আর পথ নাই, মালোপাড় এখানে শেষ হইয়া গিয়াছে। এরপর গভীর খাদ, তারপর থেকে কেবল পাটের জমি। পুরুষপ্রমাণ পাটগাছ কোমবজলে দাঁড়াইয়া বাতাসে মাথা তুলাইতেছে। ক্ষেতের পর ক্ষেত, তারপর ক্ষেত, শেষে আকাশের নীলিমার সঙ্গে মিশিয়া এক হইয়া গিয়াছে। সীমার মাঝে অসীমের এই ভোরের আলোতে ধরা দেওয়ার দৃশ্য দেখিতে দেখিতে বিস্ময়ে তাহার চক্ষু দুইটি আপনি আনত হইয়া আসিল। প্রকৃতির সঙ্গে তাহার এত নিবিড় অন্তরঙ্গতার মাধুর্য কিন্তু একজনের দৃষ্টি এড়াইল না। তুলসীতলায় প্রণাম সারিয়া সে গুনগুন করিয়া নরোত্তম দাসের প্রার্থনা গাহিতেছিল, কাছে আসিয়া তাহার মনে হইল, অসীম অনন্ত সংসার পারাবারের ও-পারে আপনা থেকে জন্মিয়াছে যে বৃন্দাজী গাছ, প্রকৃতির একটি ছোট্ট সন্তান তাহার দিকে চোখ মেলিয়া নিজের প্রণতি পাঠাইয়া দিতেছে। কাঁধে হাত দিয়া আবেগের সহিত বলিল, ‘নিতাই, ওরে আমার নিতাই, কঙালেরে ফাকি দিয়া এতদিন লুকাইয়া কোথায় ছিলি বাপ। আয় আমার কোলে আয়।‘
তার বাহুর বাঁধন দুই হাতে ঠেলিতে ঠেলিতে অনন্ত বলিল, ‘আমি অনন্ত!’
‘জানি বাবা জানি, তুই আমার অনন্ত! অনন্ত রাখিল নাম অস্ত না পাইয়া; আমি দান জানি না, ধ্যান জানি না, সাধন জানি না, ভজন জানি না;—কেবল তোমারেই জানি। ধরা যখন দিছ, আর ছাড়মু না তোমায়।’
অনন্ত বিস্ময়ে অবাক। লোকটা সহসা সম্বিং পাইয়া বলিল, ‘হরি হে, একি তোমার খেলা। বারবার মায়াজাল ছিড়িতে চাই, তুমি কেন ছি ভূতে দাও না? যশোদা তোমারে পুত্ররূপে পাইয়া কাদছিল, শচীরাণী তোমারে পুত্ররূপে পাইয়া কাদছিল, রাজা দশরথ তোমারে পুত্ররূপে পাইয়া কাদতে কঁদিতে প্রাণ দিল। তবু তোমারে পুত্ররূপে পাওয়ার মধ্যে কত তৃপ্তি, কত আনন্দ। পুত্ররূপে একবার আইছিল, চইলা গেল। ধইরা রাখতে স্ত পারলাম না। আইজ আবার কেনে সেই স্মৃতি মনে জাগাইয়া তুললা। ভুলতে দাও হরি, ভুলতে দাও! যা বাবা, কার ছেলে তুই জানি না, মায়ের ছেলে মায়ের কোলে ফিরা যা। আমার অখন অনেক কাজ। গোষ্ঠের সময় হইয়া অইল, যাই বাছারে তামার গোষ্ঠে পাঠাই গিয়া।’