অনন্তর কল্পনার দৌড় দেখিয়া উদয়তার হাসিয়া উঠিল, দেহে প্রাণ থাকিতে কেউ নদীর উপর শোয় না রে; প্রাণপাখী যখন উড়িয়া যায়, দেহখাচা তখন শূন্ত, যার পোড়াইতে পারে না, জলসই করিয়া ভাসাইয়া দেয়। এই জল-বিছানায় শুইবার মানুষ শুধু ত সে, তুই শুইতে যাবি কোন দুঃখে! তুই কি লখাই পণ্ডিত?
‘হ, আমি লখাই পণ্ডিত। মোটে একটা আখর শিখলাম ন, আমি হইলাম পণ্ডিত?
আরে পড়া-লেখার পণ্ডিতের কথা কই না, কই সদাগরের ছেলের কথা। লখাই ছিল চান্দসদাগরের ছেলে। কালনাগের দংশনে মারা গিয়াছিল। তখন একটা কলাগাছের ভেলায় করিয়া তারে জলে ভাসাইয়া দিল, আর উজান ঠেলিয়া সেই ভেলা ভাসিয়া চলিল। তার বৌ ভেলইয়া সুন্দরী ধনুক হাতে লষ্টয়া নদীর তীরে থাকিয়া ভেলার সঙ্গে সঙ্গে চলিল।
‘লখাই পণ্ডিত ত মরা। এক্লা ভেলইয়া সুন্দরী চলল– সদাগরের নাও তারে তুইল্যা লইয়া গেল না?’
ধনাগোদার ভাই মনাগোদা নিতে চাহিয়াছিল; ভেলইয়া তাকে মামাশ্বশুর ডাকাতে ছাড়িয়া দিল। মামাশ্বশুর ডাকিলে সকলেই ছাড়িয়া দেয়।
‘অ, বুঝলাম। ভাসতে ভাসতে তারা গেল কই?’
‘গেল স্বর্গে। সেখানে দেবগণের সভাতে ভেলইয়া সুন্দরী নৃত্য করিল, করিয়া মহাদেব আর চণ্ডীকে খুশি করিল। তাদের আদেশে মনসা তখন লখাই পণ্ডিতেরে জিয়াইয় দিল।‘
‘মর মানুষেরে জিয়াইয়া দিল ত!’
হাঁ, জিয়াইতে গিয়া দেখে পায়ের গোড়ালি নাই। মাছে খাইয়া ফেলিয়াছে।
মরা ছিল বলিয়াই খাইয়াছে। জ্যান্ত থাকিলে লখাই পণ্ডিত মাছদের ধরিয়া ধরিয়া বাজারে নিয়া বেচিত। কিন্তু নদীর উজান ঠেলিতে ঠেলিতে একদম স্বর্গে যাওয়া যায়? যেখানে দেবতারা থাকে?
হা। নদীর ‘সির্জন’ হইয়াছে হিমাইল রাজার দেশে। সেই দেশে স্বর্গে-সংসারে মিলন হইয়াছে। ‘তুধিষ্ঠির মহারাজা সেই দেশে গিয়া, তারপর হাঁটিয়া স্বর্গে গেল।
চাঁদের দেশে তারার দেশে রামধনুকের দেশে তাহা হইলে হাঁটিয়াও যাওয়া যায়। আর একটু বড় হইলে যখন রোজগার করিতে পারিবে তখন হাতে কিছু পয়সা হইবে। সেই সময় অনন্ত একবার নদীর তীর ধরিয়া হিমাইল রাজার দেশে যাইবে, আর সে-দেশ হইতে পায়ে হাঁটিয়া স্বর্গে যাইবে।
অনন্তর সব শ্রদ্ধা প্ৰণতি হইয়া লুটাইয়া পড়ে, তুমি অত জান! তোমারে নমস্কার।
নৌকাটা হঠাৎ কিসে ধাক্কা খাইয়া থামিয়া গেল। কোমরজলে দাড়ানো মোটা মোটা গাছের জলের উপর দিয়া অনেক ডাল মেলিয়াছে, অজস্র পাতা মেলিয়াছে। সেই ডালপাতার গহনারণ্য মাথায় করিয়া নৌকা ঘাটের মাটিতে ঠেকিয়াছে। উদয়তারার তন্দ্র অসিয়াছিল। সচকিত হইল। বনমালী পাছার খুঁটি পুতিতেছে, নৌকার একটানা ঝাকুনিতে টের পাইল উদয়তারা। মুদিনে তার বিবাহ হইয়াছিল, মুদিনে সে এখান হইতে বিদায় হইয়াছে। তখন এসব জায়গা ছিল ডাঙ্গা। জল ছিল অনেক দূরে, গাঙের তলায়। তারপর উদায়তারার কত বর্ষা কাটিয়াছে জামাইবাড়িতে। এখানে কোন বর্ষার মুখ বিবাহের পর থেকে দেখে নাই। তবু পরিচিত গাছগুলি আধারেও তার মনে জ্বলজ্বল করিয়া উঠিল। তার তলার মাটি তখন শুকনা ঠনঠনে, সে মাটিতে বসিত চাঁদের হাট। ছেলেরা খেলিত গোল্লাছুট খেলা, আর মেয়েরা খেলিত পুতুলের ঘরকন্নার খেলা। কত ঠাণ্ডা ছিল এর তলার বাতাস। আর এখন এর তলায় ঠাণ্ডা জল থই থই করে। উদয়তারার বয়সী মেয়েরা চলিয়া গিয়াছে পরের দেশে পরের বাড়িতে, আর ছেলেরা এখন বড় হইয়া এ জলে স্নান করে।
পান সুপারির তিনকোণা থলে, একখানা কাপড় আর টুকিটাকি জিনিসের একটা ছোট পুটলি গুছাইয়া উদয়তার অনন্তর হাত ধরিয়া মাটিতে পা দিল।
‘দিশ কইরা পা বাড়াইবি অনন্ত, না হইলে পইড়া যাইবি। যে পিছলা I’
পদে পদে পতনোন্মুখ অনন্ত শক্ত করিয়া উদয়তারার হাতখানা ধরিয়া বলিল, ‘আমি পইড়া যাই। তুমি ত পড় না?’
‘আমার বাপ-ভাইয়ের দেশ। চিনা-পরিচিত সব। বর্ষায় কত লাই-খেলা খেলাইছি, সুদিনে কত পুতুলখেল খেলাইছি।’
খেলায় বুঝি খুব নিশা আছিল তোমার!’
‘আমার আর কি আছিল। নিশা আছিল আমার বড় ভইন নয়নতারার। ছোট ভইন আসমানতারারও কম আছিল না। এই খেলার লাগি মায়ে বাবায় কত গালি দিছে। পাড়ার লোকে কত সাত কথা পাঁচ কথা শুনাইছে। তিন ভইন একসাথে খেলাইছি বেড়াইছি, কেউরে গেরাহ করছি না। তারপর তিন দেশে তিন ভইনের বিয়া হইয়া গেল।’
‘সেই অবধি দেখা নাই বুঝি?‘
‘না। গাঙে গাঙে দেখা হয়, তবু ভইনে ভইনে দেখা হয় না। বড় ভালমানুষ আমার বড় ভইন নয়নতারা আর ছোট ভইন আসমানতারা।‘
তারার মেলা। অনন্ত নামগুলি একবার মনে মনে আওড়াইয়া লইল।
বনমালীর একার সংসার। বাহির হইতে দরজা বন্ধ করিয়া গিয়াছিল। ফিরিয়া আসিয়া দেখে অত রাতে ঘরের ভিতর আলো জ্বলিতেছে। আশচার্য হইবার কথা। সাড়াশব্দ না করিয়া উদয়তার হাঁটুর সাহায্যে দরজায় ধাক্কা দিলে দরজা মেলিয়া গেল এবং আশ্চর্যের সহিত দেখা গেল নয়নতারা আসমানতারা তুইজনে ঘরে বসিয়া গল্প করিতেছে–মেঝে৷ বোন উদয়তারারই গল্প। অতদিন পরে দুই বোনেরে একসঙ্গে পাইয়া উদয়তারা কি বলিবে ভাবিয়া পাইল না। কিন্তু আনন্দে চোখ দিয়া জল আসিয়া পড়িল। কি করিয়া আসিল তারা এ দারুণ বর্ষাকালে?
আসার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস : বিদেশে মাছ ধরিতে গিয়৷ ছুইজনের বরের দেখা হয়। তারা ঠিক করিয়া ফেলে, অমুক মাসের অমুক তারিখে পরিবার নিয়া এখানে মিলিত হইবে। সেকথার কেহই খেলাপ করে নাই।