বনমালীর নৌকা তখন পল্লীর কোল ঘেঁষিয়া চলিয়াছে। বর্ষাকালের বাড়তি জল কেবল পল্লীকে ছোয় নাই, চুপে চুপে ভরাইয়া দিয়াছে। পল্লীর কিনারায় প্রহরীর মত দাড়ানো কত বড় বড় গাছের গোড়ায় জল শুধু পৌঁছায় নাই, গাছের কোমর অবধি ডুবাইয়া দিয়াছে। সে গাছে ডালপালার লতায় পাতায় ভরভরস্ত হইয়া জলের উপর কাত হইয়া মেলিয়া রহিয়াছে। বনমালীর নৌকা এখন চলিয়াছে তাদের তলা দিয়া, তাদেরই ছায়া মাথায় করিয়া। এখন তারায়ভরা আকাশটাও দূরে, আকাশের আর্শির মত নদীর বুকখানাও তেমনি দূরে।
অনন্ত অত মনোযোগ দিয়া কি দেখিতেছে? না, আকাশের তারা দেখিতেছে। উদয়তারার একটা ছড়া মনে পড়িয়া গেল। এতক্ষণ বিশ্রী নীরবতার মধ্যে তার ভাল লাগিতেছিল না। আর এক ফোঁটা একটা ছেলের সঙ্গে কিই বা কথা বলিবে। আলাপ জমিবে কেন? পাড়া গুলজার করাই যার কাজ, নির্জন নদীর বুক গুলজার করিবে সে কাকে লইয়া? শ্রোতা কই, সমজদার কই? কিন্তু অনন্ত আর সব ছেলেদের মত অত বোকা নিরেট নয়। আর সব ছেলেরা যখন চোখ বুজিয়া ঘুমায় অনন্ত তখন অজানাকে জানিবার জন্য আকাশের তারার মতই চোখ দুটি জাগাইয়া রাখিয়াছে। আর উদয় তারার ছড়াটিও তারারই সম্বন্ধে, ‘স্ব-ফুল ছিটা রইছে, তুলবার লোক নাই; স্ব-শয্যা পইড়া রইছে, শুইবার লোক নাই,—ক দেখি অনন্ত এ-কথার মান্তি কি?
এ-কথার মানে অনন্ত জানে না; কিন্তু জানিবার জন্য তার চোখ দুইটি চক্চক্ করিয়া উঠিল।
‘সুফুল ছিট্যা রইছে—এই কথার মানতি আসমানের তারা। আসমানে ছিটা রইছে, তুলবার লোক নাই।‘
অনন্ত ভাবে ছিটিয়া থাকে বটে। মানুষের হাত অত দূরে নাগাল পাইবে না। কিন্তু স্বর্গে যে দেবতারা থাকে। রাম, লক্ষ্মণ, কৃষ্ণ, তুর্গা, কালী, শিবঠাকুর, তারাও কি তুলিতে পারে না?
তারা ইচ্ছা করিলে তুলিতে পারে, কিন্তু তোলে না। তারাই ছিটাইয়া দিয়াছে, তারাই তুলিবে? রোজ রাতে ছিটাইয়া দিয়া তারা মানুষেরে ডাকিয়া বলিয়া দেয়, দিলাম ছিটাইয়া কেউ যদি পার তুলিয়া নাও। কিন্তু তুলিবার লোক নাই। এখন দেবতার পূজা হইবে কি দিয়া! শেষে তারা মাটিতে নকল ফুল ফুটাইয়া দিল। সে-ফুল রোজ ফুটে, লোকে রোজ তুলিয়া নিয়া পূজা করে। যে-সব ফুল তোলা হয় না, তার ঝরিয়া পড়িয়া যায়। বাসি হইয়া থাকে না। বাসি ফুলে ত পূজা হইতে পারে না।
দেবতারা ডাকিয়া বলে, কিন্তু শুনিতে পাই না ত?
দেবতাদের ডাক সকলে বোঝে না। সাধুমহাজনের বোঝে। তারা তপ করে, ধেয়ান করে, পূজা করে। তার দেবতার কথা বোঝে, দেবতারে খাওয়াইতে ধোঁয়াইতে পারে। তারা দেবতার কথা শুনে, দেবতা তাদের কথা শুনে।
আমার মার কথাও দেবতা শুনিত। একদিন – কালীপূজার দিন দেবতার একেবারে কাছে গিয়া মা কি যেন বলিয়াছিল। আমাকে কাছে যাইতে দেয় নাই লোকে। দূরে দাঁড়াইয়া দেখিয়াছি, কিছু শুনিতে পাই নাই।
আরে, এমন পূজাত আমরাও করি। আমি এই কথা বলি না! আমি বলি সাধুমহাজনদের কথা, তারা কিভাবে দেবতার কথা বুঝে। দেবতার মূর্তি যখন চোখের সামনে থাকে, দেবতা তখন চুপ করিয়া থাকে। দেবতা যখন চোখের সামনে থাকে না, তখন দেবতার মনে আর সাধুমহাজনদের মনে কথাবার্তা চলে। আমি বলি সেই কথা। চোখে দেখিয়া কথা শুনি, সে ত মানুষের কথা; চোখে না দেখিয়া কথা শুনি, সেই হইল দেবতার কথা।
সে কথা যারা, যে-সব সাধুমহাজনেরা শুনিতে পায় তারা সেই সু-ফুল তোলে বুঝি।
তোলে। তবে এই জনমে তোলে না। মাটির দেহ মাটিতে রাখিয়া তারা যখন দেবতাদের রাজ্যে চলিয়া যায়, তখন তোলে। স্বর্গে রোজ কাঁসিঘণ্টা বাজে, আর একটিমাত্র ফুল তুলিয়া তারা পূজা করে। সে-ফুলটি আবার আসিয়া ছিটিয়া থাকে! o
অনন্তর মনে শেষ প্রশ্ন এই জাগে : গাছ দেখি না পাতা দেখি না, খালি ফুল ধরিতে দেখি। সে-সব ফুল কি তবে বিন গাছের ফুল!
শীতলপাটীর মত স্থির, নিশ্চল তিতাসের বুকের উপর একবার চোখ বুলাইয়া উদয়তারা বলিল, আর মুশয্যা পইড়া আছে, শুইবার লোক নাই—এর মানতি কই শুন। সুশয্যা এই গাঙ। কেমন স্ব-বিছ না। ধূলা নাই, ময়লা নাই, উচ নাই নিচা নাই—পাটীর মত শীতল। শুইলে শরীর জুড়ায়, কিন্তু শুইবার মানুষ নাই?
আছে, আছে, একজন আছে। সে অনন্ত। জলের উপর কঠিন একটুখানি আবরণ পাইলে সে হাত পা ছড়াইয়া চিৎ হইয়া কাত হইয়া উপুড় হইয়া শুইয়া থাকিতে পারে। নদীর স্রোত তাহাকে দেশদেশান্তরে ভাসাইয়া নিবে, ঢেউ তাহাকে দোলা দিবে। চারিদিকের আঁধারে কেউ জাগা থাকিবে না। জাগিয়া থাকিবে সে আর তার চারিদিকের আঁধার আর উপর আকাশের তারাগুলি। আর জাগিয়া থাকিবে জলের মাছগুলি। সে ঘুমাইয়াছে মনে করিয়া তারাও তার চারিধারে দল বাঁধিয়া ভাসিয়া চলিবে। জাগিতে জাগিতে ক্লান্ত হইয়া এক সময় তার ঘুম আসিবে; রাত কুরাইবে, কিন্তু ঘুম ভাঙ্গিবে না, সকাল হইবে, সূর্য উঠিবে, এ-পার ও-পার দুই পারের ছেলেমেয়ে নারী-পুরুষ কাতারে কাতারে দাঁড়াইয়া দেখিবে আর ভাবিবে অনন্ত বুঝি জলে পড়িয়া গিয়াছে। হায় হায় কি হইবে, অনন্ত জলে পড়িয়া গিয়াছে। আমার তখন ঘুম ভাঙ্গিবে, তাহদের দিকে চাতিয়া চোখ কচলাইয়া মৃত্যু হাসিয়া আমি তখন জলের উপর উঠিয়া বসিব, তারপর আস্তে আস্তে হাঁটিয়া তাহাদের পাশ কাটাইয়া দিনের কাজে চলিয়া যাইব।