এতবড় টাকাওয়ালা একটা মানুষ তেলিপাড়া হইতে গুম হইয়া গেল, কিন্তু সাক্ষী প্রমাণের অভাবে তার কোন হদিস পাওয়া গেল না। না হইল মামলা-মোকদ্দমা, না হইল আচার-বিচার। কিন্তু তামসীর বাপের মারফতে তেলির জানিতে পারিল, এ কাজ মালোদেরই। কিন্তু এমন সূত্রহীন জানার দ্বারা মামলা করা যায় না। কাজেই তেলিরা কি করিবে ভাবিয়া স্থির করিতে পারিল না। শেষে বামুন সাহা, তেলি, নাপিত, সব জাত মিলিয়া গোপনীয় এক বৈঠক করিল। কেউ প্রস্তাব করিল; মালোদের নৌকাণ্ডলি একরাতে দড়ি কাটিয়া ভাসাইয়া নিয়া তলা ফাড়িয়া ডুবাইয়া দেওয়া যাক; আর টাকা দিয়া লোক লাগাও, জালগুলি সব চুরি করিয়া আনিয়া আগুনে পোড়াইয়া ফেলুক।
কিন্তু এ প্রস্তাব সকলের মনঃপূত হইল না; গুরুপাপে লঘুদণ্ড হইবে। কাজেই দ্বিতীয় প্রস্তাব উঠিল। সারা তেলিপাড়াতে রজনী পালের মাথা খুব সাফ! কূটনীতি তার বেশ খুলে। এসব ভোতা প্রস্তাবের অসারতা বুঝিতে তার বিলম্ব হইল না। সে প্রস্তাব করিল; বিষ্ণুপুরের বিধুভুষণ পাল আমার মামা। সমবায় ঋণদান সমিতির ফিসারী শাখার ম্যানেজার। ফিসারীর টাকা নিয়া সব মালোরা গিলিয়াছে। মাছে যেমন টোপ গিলে তেমনিভাবে গিলিয়াছে, আর উগ – লাইয়া দিতে পারিতেছে না। সুদ কম বলিয়া, লোভে লোভে ধার করিয়াছিল। এখন চক্রবৃদ্ধি হারে সুদে আসলে বাড়িতেছে। জানইত সমবায় সমিতির টাকা কত অত্যাচার করিয়া আদায় করা হয়। মামাকে গিয়া জানাইয়া দেই, প্রত্যেক মালোকে যেন ব্যাঙ নাচনী নাচাইয়া ছাড়ে।
কিন্তু এ প্রস্তাবও কারো মনঃপূত হইল না। মামা কখন আসিবে কে জানে। বড় সুদূর-প্রসার প্রস্তাব। গরম গরম কিছুই করা হইল না। শেষে একটা প্রস্তাব তুলিল রজনী পালের ভাই; যে-মাগী তাকে ডাকিয়া ঘরে নিয়াছিল, তাকে ধরিয়া নিয়া অভ্যাস, কয়েক পাইট মদ কিন, তারপর নিয়া চল ভাঙ্গা কালীবাড়ীর নাটমন্দিরে। কিন্তু ব্যাপার আপাততঃ এর বেশি আর গড়াইল না। তেলিপাড়াও মালোপাড়া উভয় পাড়ার প্রস্তাবই প্রস্তাবে পর্যবসিত হইল। তবে মালোপাড়ার সঙ্গে আর সব পাড়ার একটা মিলিত বিরোধের যে-গোড়াপত্তন সেইদিন হইয়া থাকিল, তাহা আর উৎপাটিত হইল না।
পথে রাত হইয়া গেল। বর্ষার প্রশস্ত নদীর উপর মেঘভরা আকাশের ছায়া দৈত্যের মত নামিয়া পড়িয়াছে। অনন্ত বসিয়া বসিয়া তাহাই দেখিতেছিল। পরে এক সময় চারিদিক গাঢ় আঁধারে ঢাকিয়া গেলে, আর কিছু দেখা গেল না।
উদয়তারা দুইদিক খোলা ছইয়ের ভিতর হইতে ডাকিয়৷ বলিল, ‘আয় রে অনন্ত, ভিতরে আয়।’
বনমালী পাছায় থাকিয়া প্রচণ্ড শক্তিতে হাল চালাইতেছে। তার দাপটে হালের বাধন-দড়ি ক্যাচ কোচ করিয়া কাঁদিয়া উঠিতেছে, আর সারা না’খানা একটানা হেলিয়া তুলিয়া কাঁপিয়া চলিয়াছে। সেই দোলায়মান নৌকার বাঁশের পাতনির উপর দিয়া পা টিপিয়া টিপিয়া অনন্ত ছইয়ের ভিতরে আসিল। উদয়তারাকে দেখা যাইতেছে না। আন্দাজ করিয়া তার কাছে গিয়া বসিল। কিছু বলিল না। ঘুম পাইতেছিল। পাটাতনের উপর ছোট শরীরখানা এলাইয়া দিয়া শুইয়া পড়িল। মশার কামড়ে আর নৌকার দোলানিতে একবার তার ঘুম খুব পাতলা হইয়া আসিল। মাথাটা যেন নরম কি একটা জিনিসের উপর পড়িয়া আছে। তুলার মত নরম আর চাঁদের মত শীতল। আর রাশি রাশি ফুলঝুরি নামাইয়া-রাখা একপাট আকাশ কে বুঝি অনন্তর গায়ের উপর চাপাইয়া ধরিয়া রাখিয়াছে। ঐ যে আকাশের উপর দিয়া এদিক হইতে ওদিকে চলিয়া গিয়াছে কি-একটা যেন উজ্জ্বল সাকো—কিছুদিন আগের দেখা সেই রামধনুটারই যেন ছিল এটা। সাতরঙ ধনুটি গা-ঢাকা দিয়া আছে আর তার ছিলাটি অনন্তর জন্য বাড়াইয়া দিয়াছে। উজ্জ্বল কাচা সোনার রঙ তার থেকে ঠিকরাইয়া পড়িতেছে। আর তার চারিপাশে ভিড় করিয়া আছে লাখ লাখ তারা। হাত বাড়াইলেই ধরা যাইবে। আর তারই উপর ঝুলিয়া অনন্ত আকাশের এমন এক রহস্যলোকে যাত্রা করিবে যেখানে থাকিয়া সে কেবল অজানা জিনিস দেখিবে। তাহার দেখা আর কোনকালে ফুরাইবে না।
উদয়তারা মশার কামড় হইতে বাঁচাইবার জন্য অনন্তর গাটুকু শাড়ির আঁচলে ঢাকিয়া দিয়াছিল আর শক্ত পাটাতনে কষ্ট পাইবে বুঝিয় মাথাটা কোলের উপর তুলিয়া নিয়াছিল। আর বুকের উপর দিয়া বাঁ হাতখানা বাড়াইয়া শাড়ির কিনারাটা পাটাতনের সঙ্গে চাপিয়া রাখিয়াছিল, যেন অনন্তর গাঁ থেকে শাড়িটুকু সরিয়া না যায়। সেই হাতখান ছেলেটা খাপছাড়া ভাবে হাতড়াইতেছে মনে করিয়া সে শাড়িটুকু গুটাইয়া কোল হইতে অনন্তর মাথাটা নামাইয়া দিল। ডাকিয়া বলিল, ‘অনন্ত উঠ্।‘
অনন্ত জাগিয়া উঠিয়া দেখে দুনিয়ায় আর এক রূপ। তারায় ভরা আকাশের তলায় অদূরে নদী অসাড় হইয়া পড়িয়া আছে। অনেক দূরের আকাশের তারায় তারায় যেন সড়ক বাঁধিয়াছে। না জানি কত সুন্দর সে পথ, আর সে পথে চলিতে না জানি কত আনন্দ! পায়ের নিচে কত তারার ফুল মাড়াইয়া চলিতে হয়, আশেপাশে, মাথার উপরে, খালি তারার ফুল আর তারার ফুল। সে-পথ কত উপরে। অনন্ত কোনদিন তার নাগাল পাইবে না। কিন্তু দেবতারা প্রসন্ন। তিতাসের স্থির জলে তা’রা তারই একটা প্রতিরূপ ফেলিয়া রাখিয়াছে। সেটা খুব কাছে। বনমালী একটু বার-গাঙ দিয়া নৌকা বাহিলেই সে পথে অনন্ত নৌকা হইতেই পা বাড়াইয়া দিতে পারিবে। কিন্তু জলের ভিতরে সে পথ। কেবল মাছেরাই সে-পথে চলাফেরা করিতে পারে। অনন্ত তো মাছ নয়। তারার স্বল্প আলোয় নদীর বুক ঝাপসা, সাদা। তারই উপর দুই একটি মাছ ফুট দিতেছে আর তারাগুলি কাঁপিয়া কাঁপিয়া উঠিতেছে। অনন্তর বিস্ময় জাগে। উপরে তো ওরা এক এক জায়গায় আঁটিয়া লাগিয়া আছে; জলে কি তবে তারা আলগা? মাছের কেমন তাদের কাঁপাইতেছে, নাচাইতেছে; তাদের লইয়া ভাইবোনের মত খেলা করিতেছে। কি মজা! অনন্তর মন মাছ হইয়া জলের ভিতরে ডুব দেয়।