বিন্দার মা কিছু বলিল না।
ভিতরে ভিতরে কি ষড়যন্ত্র হইতেছিল, সুবলার বউকে কেউ কিছু জানিতে দিল না। একদিন দেখা গেল, লবচন্দ্রর বৌর ভাই আসিয়াছে, নাম নাকি তার বনমালী। যে-রহস্য কেউ ভেদ করিতে পারে নাই, সে-রহস্য ভেদ করিয়া ফেলিয়াছে; খালের মুখের এক গেরাপী-দেওয়া ভাঙ্গা নৌকার খোপ হইতে টানিয়া বাহির করিয়া আনিয়াছে অনন্তকে। তারপরের দিন দেখা গেল তারা তিনজনে মিলিয়া নৌকায় গিয়া উঠিয়াছে।
সব কথা শুনিয়া সুবলার বৌর যাইতে প্রবৃত্তি হইতেছিল না। বিন্দার মা জানে তার ব্যথাটা কোথায়; বলিল, ‘এদিন পাললি-লাললি, খাওয়াইলি ধোঁয়াইলি, আইজ পরে লইয়া যায়, কোনদিন দেখ বি কি দেখ বি না, শেষ দেখা একবার দেইখ্যা দে।‘
হাঁ, শেষ দেখা একবার দেখিতে হইবে! সুবলার বউ উঠিয়া পড়িল।
ঘাটের কাছে অনেক নারী গিয়া জমিয়াছে। সাহা পাড়া এক নারি ঝাকুনি মারিয়া কলসী কাকালের উপরে তুলিতে তুলিতে মালো পাড়ার এক নারীকে বলিল, ‘কারে কে লইয় যাইতাছে গো দিদি!’
—লবচন্দ্রর বউ উদয়তারাকে তার দাদা বনমালী নিতে আসিয়াছিল, নিতেছে। আমার বাপের বাড়ি আর তার ‘ বাপের বাড়ি এক গায়ে, পাশাপাশি ঘর।
‘বুঝলাম।‘
নারীদের দলে গিয়া সুবলার বউও দাঁড়াইল। দেখিল, দুই জনেই মহা খুশি। উদয়তার মাঝে মাঝে ছড়া কাটিয়া রঙ্গ করিতেছে আর অকৃতজ্ঞ কুকুরটা খুশি মনে এদিক ওদিক চাহিয়া দেখিতেছে।
উদয়তারা এখন আর লবচন্দ্রের বউ নহে; এখন সে বনমালীর বোন। গর্বিত দৃষ্টিতে ঘাটের নারীদের দিকে চাহিল সে। একটি বৌ মান মুখে তাকাইয়াছিল উদয়তারার দিকে, তারও বাপের বাড়ি নবীনগর গ্রামে। তাকে খুশি করিবার জন্য উদয়তারা ডাকিয়া বলিল, ‘কিগো নবীনগরের ছবি না, বহু দিন ধইরা যে দেখি না?
উদয়তারাকে যারা জানে তারা সকলেই হাসিয়া উঠিল। সে বৌও অমনি ফিক করিয়া হাসিয়া বলিল, ‘জামাইঠকানী, কি কয় লা?’
এই কয়জনার হাসি-তামাসার মধ্যে বনমালীর নৌকা তিতাসের জলে ভাসিয়া পড়িল।
আকাশটা বেজায় ভারী। মেঘে মেঘে ছাইয়া গিয়াছে। সারাদিন সূর্যের দেখা নাই। মাথার উপর যেন চাপিয়া ধরিয়াছে বাদলার এই মুইয়া-পড়া আকাশটা ৷ মানুষের অবাধে নিশ্বাস ফেলার অনেকখানি অধিকার আত্মসাৎ করিয়া ময়লা একখানা র্কাথা দিয়া বুঝি কেউ ঢাকিয়া ফেলিয়াছে মালোপাড়াটাকে।
হু হু করিয়া বাতাস বহিতেছে। মাথার কাপড়টুকু বুকে পিঠে দুই তিন পরতা জড়াইয়া সুবলার বউ একটা মেটে কলসী লইয়া নদীতে গেল।
পারের উঠানের মত ঢালা জায়গা এতদিন অবারিত ভাবে পড়িয়া থাকিত। জেলেরা জাল ছড়াইত, জেলের ছেলেরা লম্বা করি। মেলিয়া সূতা পাকাইত। ছেলেরা শিশুরা বয়স্ক বিধবারা রোদের জন্য সকালে গিয়া বসিত; বিকালে ছেলেরা খেলা করিত। ছুটিয়া-আশী দুটি একটি গরু ছাগল ঘাস থাইত। রাক্ষুসী তিতাস ধাপে ধাপে বাড়িয়া আসিতে আসিতে তার অনেকখানি জায়গা গ্রাস করিয়া ফেলিয়াছে। অবাধে কেউ এখানে নড়াচড়া করিবে সে উপায় নাই। মুদিনে কোথায় কোন সুদূরে ছিল জল, ভরা কলসী লইয়া আসিতে পথ ফুরাইতে চাহিত না। এখন এত কাছে আসিয়াছে; বাড়ি হইতে নামিয়া পাড়ার বাহিরে পা দিলেই জল। তবু যা একটু জায়গা খালি আছে, আর দুইদিন পরে তাও জলে ভরিয়া যাইবে।—আগে যেখানে নামিয়া স্নান করিতাম, সেখানে আজ গাঙের তলা। বড়জালের বড় বাঁশ ডুবাইয়াও সেখানকার মাটি ছোঁয়া যাইবে না। মাথার উপর কালে আকাশ ঝুলিয়া পড়িয়াছে। পাড়ার বাহিরে তিতাসের কালাপানি সাঁ সাঁ করিয়া আগাইয়া আসিতেছে। দুইদিক হইতেই চাপিয়া ধরার মতলব।।
দক্ষিণ দিকে চাহিলে নির্ভরসায় বুক কাঁপিয়া উঠে! আষাঢ় শেষ হইয়া গিয়াছে। মাঠ ঘাট যতদিন ডাঙ্গা ছিল, বৃষ্টির জল তাহাদের ধুইয়া মুছিয়া সাদা গেরুয়া অনেক মাটি লইয়া গিয়া নদীতে পড়িত। এখন সেসব মাঠ ময়দান জলের তলায় চাপা পড়িয়াছে। তাহাদের উপর এখন বুক জল সাঁতার জল। সব পলিমাটি জলের তলে থিতাইয়া রহিয়াছে, উপরে ভাসিয়া রহিয়াছে নির্মল জল। তিতাসের জল তাই সাদাও নয়, গৈরিকও নয়, একেবারে নির্মল; আর নির্মল বলিয়াই কালো। সেই কালো জলের উপর দিয়া ঢেউয়ের পর ঢেউ আসিয়া এখানে আছাড় খাইতেছে। ঢেউয়ে ঢেউয়ে জল কেবল আগাইয়া আসিতেছে।
জেলেদের হইয়াছে ঝকমারি। ঘন ঘন নাও-বাঁধা খুঁটি বদলাইতে হয়। একদিন হাঁটুজলে গলুই রাখিয়া খোঁটা ছিল পাছার খোঁটা ছিল বুক জলে। তিনদিনের দিন গলুইখোটায় হইয়াছে কোমর জল আর পাছার খোটায় সাঁতার পানি। নৌকায় উঠিতে কাপড় ভিজাইতে হইতেছে। তোল আবার খুঁটি, আগাইয়া আনো নাও আরও মাটির কাছে এইভাবে খুঁটি তোলাতুলি করিতে করিতে শেষে নাওয়ে গলুই পল্লীর গায়ে আসিয়া ঠেকিল।
নতুন জল মালোপাড়ার গায়ে ধাক্কা দিয়া তার পূর্ণতা ঘোষণা করিয়াছে। ঘরবাড়ির কিনারায় বেতঝোপ, বনজমানী, ছিট্কির গাছগাছালি ছিল—নুতন জলের তলায় এখন সেগুলির কোমর অবধি ডুবিয়া গিয়াছে। তার আশেপাশে ঢেউ ঢোকে না, স্রোত চলে, সেই স্রোতে নিরিবিলিতে উজাইয়া চলে ছোট ছোট মাছ। পুটি চাঁদ খলসে ডিম ছাড়িয়াছে, বাচ্চা হইয়াছে, সাঁতার কাটিতে আর দল বাঁধিয়া স্রোত ঠেলিয়া উজাইতে শিখিয়াছে সে-সব মাছের। থালা ধুইতে গেলে এত কাছ দিয়া চলে, যেন আঁচল পাতিয়াই ধরা যাইবে। অনন্ত এখানে একটা ছোট জাল পাতিলে বেশ ধরিতে পারিত! হাটে নিয়া বেচিতেও পারিত। এই সময় মাছের দর বাড়ে। উজনিয়া-জলে অঢেল মাছ ধরা দেয় না; কমিবার মুখে মরা জলে যত মাছ মারা পড়ে, তখন মাছের দর থাকে কম। এখন দর খুব বেশি।