খাওয়ার পর কাঁধের গামছায় মুখ মুছিতে মুছিতে পথে নামিয়া বন্দেআলী বলে, ‘ভাই করমালী নিজে ত খাইলাম্ ঝাগুর মাছের ঝোল । আমার ঘরের মানুষের একমুঠ শাক-ভাত আজ জুটল নি, কি জানি ?’
করমালী বলে, ‘বন্দালী ভাই, কইছ কথা মিছা না । তোমার আমার ঘরের মানুষ! তোমার আমার ঘরই নাই, তার আবার মানুষ। দয়া কইরা রাইতে থাকতে দেয়-থাকি; ফজরে উইঠ্যা মুনিবের বাড়ি গিয়া ঘুমের আলস ভাঙ্গি । ঘরের সাথে এইত সমন্দ। – কি খায়, কি পিন্ধে কোনোদিন নি খোঁজ রাখতে পারছি? তা যখন পারছি না তখন তোমার আমার কিসের ঘর আর কিসের মানুষ।’
বন্দেআলী খানিক ভাবিয়া নিয়া বলে, ‘বেবাকই বুঝি করমালী ভাই। তবু মুনিবের ঘরে পঞ্চ সামিগ্রী দিয়া খাইবার সময় ঘরের কথা মনে হয়; গলায় ভাত আইটকা যায় আর খাইতে পারি না।’
শুনিয়া করমালী বলে, ‘আমার কিন্তু তাও মনে পড়ে না। হ, আগে মাঝে মাঝে পড়ত। এখন দেখি, পড়ে না যে, ইটাই ভাল।’
একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়িয়া বন্দেআলী বলে, ‘সারাদিনের মেহ্ নতে নাস্তানাবুদ হইয়া ঘরে যাই, গিয়া দেখি ছিঁড়া চাটাইয়ে শুইয়া আছে। ঝুপ কইরা তার পাশে শুইয়া পড়ি; জাগাই না। – একদিন তার একখানা হাত আইয়া আমার বুকের উপর পইড়া যায়। হাতখানা হাতে লইয়া দেখি, কি শক্ত! কড়া পড়ছে পরের বাড়ির ধান ভানতে ভানতে।’
করমালীর বউ ধান ভানে না। লোকের বাড়ি-বাড়ি কাঁথা সেলাই করিয়া দেয়। কাঁথা সেলাইয়ের ধুম পড়িয়াছে। তার মোটে অবসর নাই। ডান হাতের সূঁচের ফোঁড় বাঁ হাতের আঙ্গুলের ডগায় তুলিতে তুলিতে আঙ্গুলে হাজার কাটাকাটি দাগ পড়িয়াছে। করমালী প্রায়ই ঘরে গিয়া দেখে বিছানা খালি।
একটু বিমর্ষ হাসি হাসিয়া করমালী বলিল, ‘বন্দালী ভাই, তুমি ত গিয়া দেখ, বউ ঘুমাইয়া রইছে। আমি ছিঁড়া খাঁথায় গাও এলাইয়া দিয়া পথের পানে চাইয়া থাকি। সে তখন পরের বাড়ির খাঁথা সিলাই করে, আর সে সুঁইচের ফোঁড় আমার বুকে আইয়া বিন্ধে। তার আইতে আইতে রাইত গহীন হয় – আগ-আন্ধাইরা রাইত – দেখি আন্ধাইর গিয়া চাঁদ উঠছে- ভাঙ্গা বেড়ার ফাঁকে দিয়া রোশনি ঢুকে, কেডায় যেমুন ফক ফক কইরা হাসে!’
কথা শেষ হইলেও করমালীর মুখের ম্লান হাসিটুকু মিলাইয়া যায় না । বন্ধেআলীর বুক ছাপাইয়া আর একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস বাহির হয়। কোনোরকমে সেটা চাপা দিতে দিতে বলে, ‘করমালী ভাই, আছ ভাল। কামে-কাজে থাক, খাও দাও। তার কথা মনে পড়ে না। মনে পড়ে খালি শুইবার সময়। আমার হইছে বিষম জ্বালা! উঠতে বইতে খালি মনে হয় তারে আমি দুখ দিতাছি। একটু সুখ না, শান্তি না- আমরা কি অভাইগ্যা ভাই করমালী?’
করমালী প্রায় দার্শনিক নির্লিপ্ততার সঙ্গে বলিল, ‘আমার ভাই অত কথায় কথায় শ্বাস পড়ে না! তুমি আমি বড় মুনিবের কাম করি, ভাল খাই! বউরা ছোট মুনিবের কাম করে, ভাল খাইতে পারে না। – আমরার জমি নাই, জিরাত নাই, পরের জমি চইয়া জান কাবার করি। যদি জমি থাকত তা’ অইলে বৌরা নিজেরার ঘরে খাটত, তোমারে আমারে মুনিবের মতো দেখত।’
বন্দেআলীর মন এই ধরণের চিন্তায় সায় দেয় না! সে ভাবে, করমালীর প্রেমিক মন বড় নিষ্ঠাহীন। তার মোটে স্ত্রীর প্রতি প্রেম ভালবাসা এসবের বুঝি কোনো দাম নাই। হাঁ দাম নাই-ই তো। তার মতো ভূমিহীন চাষীর কাছে এসবের কোনো দাম নাই। জীবনে যদি বসন্ত আসে তবেই এসবের দাম চোখে ধরা পড়ে। তাদের জীবনে বসন্ত আসে কই!
আসে বসন্ত। টি সময় মাঠের উপর রঙ্ থাকে না। তিতাসের তীর ছুঁইয়া যাদের বাড়িঘর তারা জেলে। তিতাসে মাছ ধরিয়া তারা বেচে, খায়। তাদের বাড়িপিছু একটা করিয়া নৌকা ঘাটে বাঁধা থাকে। বসন্ত তাদের মনে রঙের মাতন জাগায়।
বসন্ত এমনি ঋতু- এই সময় বুঝি সকলের মনেই প্রেম জাগে। জাগে রঙের নেশা। জেলেরা নিজে রঙ্ মাখিয়া সাজে – তাতেই তৃপ্তি পায় না। যাদের তারা প্রিয় বলিয়া মনে করে, তাদেরও সাজাইতে চায়। তাতেও তৃপ্তি নাই। যাদের প্রিয় বলিয়া মনে করে তারাও তাদের এমনি করিয়া রঙ্ মাখাইয়া সাজাক তাই তারা চায়। তখন আকাশে রঙ, ফুলে ফুলে রঙ্, পাতায় পাতায় রঙ্ । রঙ্ মানুষের মনে মনে। তারা তাদের নৌকাগুলিকেও সাজায়। বৌ-ঝিরা ছোট থালিতে আবির নেয়, আর নেয় ধানদূর্বা। জলে পায়ের পাতা ডুবাইয়া থালিখানা আগাইয়া দেয়। নৌকাতে যে পুরুষ থাকে সে থালির আবির নৌকার মাঝের গুরায় আর গলুইয়ে নিষ্ঠার সহিত মাখিয়া দেয়। ধানদূর্বাগুলি দুই অঙ্গুলি তুলিয়া ভক্তিভরে আবির-মাখানো জায়গাটুকুর উপর রাখে। এই সময়ে বৌ জোকার দেয়। সে-আবিরের রাগে তিতাসের বুকেও রঙের খেলা জাগে। তখন সন্ধ্যা হইবার বেশি বাকি নাই। তখনো আকাশ বড় রঙিন। – তিতাসের বুকের আরসিতে যে-আকাশ নিজের মুখ দেখে, সেই আকাশ।
চৈত্রের খরার বুকে বৈশাখের বাউল বাতাস বহে। সেই বাতাসে বৃষ্টি ডাকিয়া আনে। আকাশে কালো মেঘ গর্জায়। লাঙ্গল চাষা মাঠ-ময়দানে যে ঢল হয়, ক্ষেত উপচাইয়া তার জল ধারা-স্রোতে বহিয়া তিতাসের উপর আসিয়া পড়ে। মাঠের মাটি মিশিয়া সে-জলের রঙ্ হয় গেরুয়া। সেই জল তিতাসের জলকে দুইএক দিনের মধ্যেই গৈরিক করিয়া দেয়। সেই কাদামাখা ঠাণ্ডা জল দেখিয়া মালোদের কত আনন্দ। মালোদের ছোট ছোট ছেলেদেরও কত আনন্দ। মাছগুলি অন্ধ হইয়া জালে সহজে আসিয়া ধরা দেয়। ছেলেরা মায়ের শাসন না মানিয়া কাদাজলে দাপাদাপি করে। এই শাসন-না-মানা দাপাদাপিতে কত সুখ! খরার পর শীতলের মাঝে গা ডুবাইতে কত আরাম।
প্রবাস খণ্ড
তিতাস নদীর তীরে মালোদের বাস। ঘাটে-বাঁধা নৌকা,মাটিতে ছড়ানো জাল, উঠানের কোণে গাবের মটকি, ঘরে ঘরে চরকি, তেক,তকলি – সুতা কাটার, জাল বোনার সরঞ্জাম। এই সব নিয়াই মালোদের সংসার।