কিন্তু এ সকল কথা এ লোকটাকে কি বলা যায়! মোটে একদিনের দেখা। আর দোকানীটা নিশ্চয়ই আমাকে মনে রাখিয়াছে। তারপাশে কত ঘুরিয়াছি আধ-পচা পানের জন্য। মনে কি আর রাখে নাই? সব সময়ই তো মনে ভাবিয়াছে এ ছেলেটা খালি আধ-পচা পানই নিবে। ফেলিয়া দেওয়া পান। কোনদিন পয়সা দিয়া কিনিতে পারিবে না। আজ সে দেখুক তার ডালার সব চাইতে দামী পানের বড় একটা গোছা তার হাতে। পয়সা দিয়া কেন।
সুপারির গলি হইতে বনমালী কিছু কাটা-সুপারিও কিনিল।
আরেক জায়গাতে কতকগুলি গেঞ্জির দোকান। মলাটের বাক্স খুলিয়া মাটির উপর বিছানো চটে সাজাইয়া রাখিয়াছে। বুকে ফুলকাটা একটা গেঞ্জি কিনিল বনমালী। গলা হইতে বুক পর্যন্ত বোতামের এলাকায় লম্বা একটা সবুজ লতা, তাতে লালফুল ধরিয়াছে। এতক্ষণ খালি গাঁ ছিল। এবার নূতন গেঞ্জিতে বনমালীকে রাজপুত্রের মত মানাইয়াছে বলিয়া অনন্ত মনে মনে আন্দাজ করিল। লতাটাও কত সুন্দর।
আরও সুন্দর বাজারের এদিকটা। মাঝখানে পায়ে চলার জায়গা খালি রাখিয়া দুইপাশে তারা পসরা সাজাইয়াছে। চলতি কথায় ইহাদিগকে বেদে বলে, কিন্তু সাপুড়ে নয়। অত্যন্ত লোভনীয় তাদের দোকানগুলি। একধারে অনেকগুলি কোমরের তাগা। পোষমানা সাপের মত শোয়াইয়া রাখিয়াছে। কতক কালো, আর কতক হলদে লালে মিশানো। মাথায় এক একটা জগজগার টোপর। একদিকে এলাইয়া রাখিয়াছে কতকগুলি আরসি। একদিকে নানা রঙের ও নানা আকারের সাবান। আর একখানে পুতির মালা, রেশমী ও কাচের চুড়ি। আরও অনেক কিছু। এক একটা দোকানে এত সামগ্রী। বনমালী পাশে বসিয়া দুই তিনটা সাবানের গন্ধ শুকিয়া বলিল, জলেভাসা সাবান আছে? আছে শুনিয়া গন্ধ শুকিয়া দর করিয়া রাখিয়া দিল। র্কাচের চুড়ির মধ্যে তিন আঙ্গুল ঢুকাইয়া মাপ আন্দাজ করিল, তারপর রাখিয়া দিল। কিনিল না। কিনিল খালি কয়েকটা বড়শি। এক কোণে কতকগুলি বাল্যশিক্ষা, নব-ধারাপাত বই। অনন্ত ইত্যবসরে বসিয়া পাতা উল্টাইতে শুরু করিয়া দিল। দুইটা গরু নিয়া এক কৃষক চাষ করিতেছে ছবিটাতে চোখ পড়িতে না পড়িতে দোকানী ঝঙ্কার দিয়া উঠিল। অনন্তর আর দেখা হইল না।
বনমালী অনন্তর হাত ধরিয়া টানিতে টানিতে ধনঞ্জয়কে বলিল, গাওয়ের নাপিতে চুল ছাটেন, যেমুন কচু কাটে। আর হাটের নাপিতে চুল কাটেন, যেমুন রান্দা দিয়া পালিশ করে। নাওয়ে গিয়া থাইক্য, চুল কাটাইতে গেলাম।
নাপিতের উঁচু ভিটিখানাতে গিয়া দেখা গেল কতক নাপিতের হাতের কাঁচি, চিরুণির উপর দিয়া কাচুম কাচুম করিয়া বেদম চলিয়াছে, আর কতক নাপিত ক্ষুর কাঁচি চিরুণি এবং নরুণ লইয়া চুপ করিয়া বসিয়া আছে। মাথায় অগোছাল লম্ব চুল দেখিয়া বনমালীর উদ্দেশ্ব তারা বুঝিল। বুঝিয়া নানা জনে নানা দিক হইতে তাহাকে ডাকিতে লাগিল। অনন্তর মাথার চুলও বেশ লম্বা হইয়াছে, কিন্তু তাহার গলায় ধড়া দেখিয়া কেহ তাহাকে ডাকিল না।
চুলকাটা শেষ করিয়া দেখে বেলা ডুবিয়া গিয়াছে। নাপিত একখানা ছোট আয়না বনমালীর হাতে তুলিয়া দিল, কিন্তু তার ভিতর দিয়া তখন কিছুই দেখা যায় না। অপ্রসন্ন মনে উঠিয়া পড়িল বনমালী। আবার অনন্তকে হাতে ধরিয়া বাজারসমুদ্র পার করিয়া ঘাটের কিনারায় আনিল। হাট তখন ভাঙ্গিয়া পড়িতেছে। ধনঞ্জয় একছালা গাব, দুইটা বাঁশ, সপ্তাহের মত হলুদ লঙ্কা লবণ জিরা মরিচ কিনিয়া তৈরী হইয়া আছে।
বনমালী মনে মনে বলিল, আজ আর ও-পাড়ায় যাইব না। রাত হইয়া গিয়াছে, আর একদিন আসিলে যাইব। প্রকাশ্যে বলিল, হেই পুল, তুই আমার নাওয়ে যাইবি? আমি খালেবিলে জাল লইয়া ঘুরি, মাছ ধরি মাছ বেচি, নাওয়ে রান্ধি নাওয়ে খাই। সাত দিনে একদিন বাড়িত যাই। যাইবি তুই আমার নাওয়ে?
অনন্ত ঘাড় কাত করিয়া জানাইল, হাঁ। যাইবে।
‘চল তা হইলে।‘
অনন্ত নৌকায় উঠিবার জন্য জলে নামিল।
‘আরে না না, অখনই তোরে নেমু না। তোর বাড়ির মানুষেরে না জিগাইয়া নিলে, তারা মারামারি করতে পারে।’
অনন্ত ঘাড় তুলাইয়া বলিতে চাহিল, না কেহ মারামারি করিবে না।
‘না না, তুই বাড়ি যা।‘
অনন্ত জোর করিয়া নৌকার গলুই আঁকড়াইয়া ধরিল। ধমঞ্জয়ের ধমক খাইয়া বনমালী নৌকায় গিয়া উঠিল, কিন্তু ছেলেটার জন্য তার বড় মায়া লাগিল। তাকে বাড়িতে আগাইয়া দিয়া আসা উচিত। এতক্ষণ সঙ্গে করিয়া ঘুরাইয়াছে।
ধনঞ্জয় লগি ফেলিয়া ঠেলা মারিলে, অনন্তর ছোট দুইখান। হাতের বাঁধন ছিন্ন করিয়া গলুই ডানদিকে ঘুরপাক খাইল এবং দেখিতে দেখিতে নৌকা অন্ধকারের মাঝে কোথায় চলিয়া গেল, আর দেখা গেল না। বুকভরা একটা দীর্ঘশ্বাস মোচন করিয়া অনন্ত ডাঙ্গায় উঠিয়া দাঁড়াইয়া রহিল।
চারিদিক অন্ধকার। কিছুই দেখা যায় না। কিন্তু বাড়ির পথ তার চেনা। ভয়-ডরেরও কিছু নাই। তবু সে যেন দেহে মনে নিরুৎসাহ হইয়া গিয়াছে। পা যেন তার বাড়ির দিকে চলিতে চায় না। বনমালীর শেষ কথা কয়টি রহিয়া রহিয়া তার কানে বার বার বাজিয়া উঠিতে লাগিল। তুই এখন বাড়ি যা। তোদের পাড়া আমি চিনি। আমার বোন বিয়া দিয়াছি তোদের পাড়াতে। আবার আমি আসিব। কোন ভাবনা করিস না তুই। আবার আমি আসিব।
তুমি বলিয়াছিলে আবার আসিবে, কিন্তু কখন আসিবে! আমার যে আর বাড়িতে যাইতে পা চলিতেছে না। কখন তুমি আসিবে —ভাবিতে ভাবিতে অনন্ত বাড়ির উঠানে পা দিল।