কতক্ষণ পরে রামধনু মিলাইয়া গেল আকাশে। কিন্তু রাখিয়া গেল অনন্তর মনে একটা স্থায়ী ছাপ। কোনোদিন দেখে নাই। মায়ের কাছে গল্প শুনিয়াছিল; মানুষের অগম্য এক দ্বীপ-চরে এক জাহাজ নোঙর করিয়াছিল। খাইয়া দাইয়া লোকগুলি ঘুমাইয়াছে, অমনি চারিদিক কাঁপাইয়া ধপাস ধপাস শব্দ হইতে লাগিল। আকাশ হইতে পড়িল কয়েকটা দেওদৈত্য। এরা ছাড়াও আরও কত কিছু আছে, যারা মানুষ নয়; মামুষের মধ্যে, মানুষের বাসের এই দুনিয়ার মধ্যে যাদের দেখিতে পাওয়া যায় না। দেও-দৈত্য তো ভয়ের জিনিস। কত ভালো জিনিসও আছে তাদের মধ্যে। সকলেই তারা এই আকাশেই থাকে। এই চন্দ্র, সূর্য, তারা। তাহারাও আকাশেই থাকে; নিত্য উঠে নিত্য নামে, দেখিতে দেখিতে চোখে প্রায় পুরানো হইয়া গিয়াছে। কিন্তু এদেরই রহস্য ভেদ এখনও করা হয় নাই। অলৌকিক রহস্যভর অনন্তর আকাশ-ভুবন। আজও তাদেরই একটা অদেখা রহস্যজনক বস্তু তার চোখের সামনে নামিয়া আসিয়াছিল পিছনের অনেক দূরের আকাশ হইতে, অদেখার কোল হইতে একেবারে নিকটে, আমিনপুরের জামগাছটার প্রায় মাথার কাছাকাছি।
বনমালীর মন হইতেও কল্পনার রামধনু মুছিয়া গেল; কেউ বুঝি নামাইয়া দিল তাকে বাস্তবের মুখে। ছেলেটার গায়ের রঙ ফস। কিন্তু খড়ি জমিয়া বর্ণলালিত্য নষ্ট করিয়া দিয়াছে। এক চিলত সাদা মাঠ-কাপড় কটিতে জড়ানো। আর এক চিলত কাঁধে। বিঘৎ পরিমাণ একখানা কুশাসন ডানহাতের মুঠায় ধরা। নৌকা গড়িবার সময় তক্তায়-তক্তায় জোড়া দেয় যে দুইমুখ সরু চ্যাপ্ট লোহা দিয়া, তারই একটা দুইমুখ এক করিয়া কাপাস সূতায় গলায় ঝুলানো। পিতামাতা মারা যাওয়ার পর মাসাবধি হবিষ্য করার সন্তানের এই সমস্ত প্রতীক।
বনমালী দরদী হইয়া বলে, ‘তোর নাম কি রে।‘
‘অনন্ত? ‘
‘অনন্ত কি? যুগী, না পাটনী, না সাউ, না পোদ্দার?’
অনন্ত এ প্রশ্নের কোন উত্তর দিতে পারিল না।
‘তোর মা মরছে না বাপ মরছে?’
‘মা।‘
‘কোন হাটি বাড়ি তোর?’
আঙ্গুল দিয়া মালোপাড়া দেখাইয়া দিল।‘
‘জাতে তুই মালো? আমরার স্বজাতি?’
অনন্ত ভালে করিয়া কথাটা বুঝিল না। আবছাভাবে বুঝিল, তার মাসীর মত, এও তারই একটা কেউ হইবে। তা না হইলে অত কথা জিজ্ঞাসা করিতেছে কেন?
‘তোর বাড়িত লইয়া যাইবি আমারে?’
গলার ধড়ার সূতাটা দাঁতে কামড়াইতে কামড়াইতে ঘাড় কাৎ করিয়া অনন্ত জানাইল, হাঁ, নিয়া যাইবে।
‘বাজার জমছে। চল্ তোরে লইয়া বাজারটা একবার ঘুইরা দেখি।‘
বাজারের তখন পরিপূর্ণ অবস্থা। কাদিরের দোকানের চারিপাশে অনেক আলুর দোকান বসিয়াছে। গণিয়। শেষ করা যায় না। ক্রেতাও ঘুরিতেছে অগণন। হাতে খালি বস্ত লইয়া তাহারা দরদস্তুর করিতেছে আর কিনিয়া বস্তাবন্দী আলু মাথায় তুলিয়। ভিড় ঠেলিয়া বাজারের বাহির হইতেছে। একটানা একটা কলরব শুরু হইয়া গিয়াছে। কাছের মানুষকে কথা বলিতে হইলেও জোরগলায় বলিতে হয়, কানের কাছে মুখ নিয়া।
কাদির বড় এক পাইকার পাইয়াছে। খুচরা বিক্রিতে ঝামেলা। অবশ্য দর তুই চারি পয়সা করিয়া মণেতে বেশি পাওয়া যায়। কিন্তু মণামণি হিসাবের বিক্রি তার চাইতে অনেক ভাল। আগেভাগে শেষ করিয়া উঠিয়া পড়া যায়। বয়স্কদের ভিড়ে আর ঠেলাঠেলিতে তিষ্ঠিতে না পারিয়া অনন্তর সঙ্গীরা হাট ঘন হইয়া জমার মুখেই সরিয়া পড়িয়াছে। অনন্ত চাহিয়া দেখে সচল চঞ্চল এক জনসমুদ্রের মধ্যে সে একা। বালক অনন্তর ইচ্ছা করে বনমালীর একখানা হাত ধরিতে।
কাদির শক্তহাতে দাড়িপাল্লা তুলিয়া ধরিল, একদিকে চাপাইল দশসের বাটখারা, আর একদিকে ডুবাইয়া তুলিল আলু। আর মুখে তুলিল কারবারীদের একটা হিসাবের গৎ : আয়, লাভে রে লাভে রে লাভে রে লাভে, আরে লাভে! আয়, হয়ে রে দুয়ে রে দুয়ে রে দুয়ে, আরে দুয়ে! আয়, তিনে রে তিনে রে তিনে রে তিনে, আরে তিনে—
বেচাবিক্রি চুকাইয়া কাদির বলিল, ‘বাবা বনমালী, যাইও একবার বিরামপুরে, কাদির মিয়ার নাম জিগাইলে হালের গরুতে অবধি বাড়ি চিনাইয়া দিব। যাইও।
গুণ-টানা নৌকার মতন বনমালী অনন্তর হাত ধরিয়া টানিয়া চলিয়াছে। এই বাজারের ভিতর দিয়া অনন্ত রোজ দুই চারিবার করিয়া হাটে। কিন্তু ভরা হাটের বেলা সে কোনদিন এখানে ঢোকে নাই। আজ দেখিয়া মুগ্ধ হইয়া গেল। একজায়গায় বসিয়াছে পানের দোকান। দোকানের পর দোকান। বড় বড় পান গোছায় গোছায় ডালার উপর সাজানো। কাছে একটা হাঁড়িতে জল; দোকানীরা বার বার হাত ডুবাইয়া জল পানের উপর ছিটাইয়া দিতেছে, আর যত বেচিতেছে পয়সা সেই হাঁড়িটার ভিতর ডুবাইয়া রাখিতেছে। বনমালী খুব বড় দেখিয়া এক বিড়া পান কিনিয়া অনন্তর হাতে দিল। হাতে লইয়া অনন্তর চোখ জলে ভরিয়া আসিতে থাকে। বনমালীকে বুক খুলিয়া শুনাইতে চায় : হাটের দিন দুপুরের আগে এই দোকানীটা নৌকা হইতে পান তুলিয়া ভাজ করিতে বসে। একখানা চৌকির উপর বসিয়া পানের গোছা হাতে করিয়া তার মধ্য হইতে পচা আধ-পচা পানগুলি ফেলিয়া দেয়। সঙ্গীদের লইয়া সে কতদিন এই ছেঁড়াকোড়া পচা পানগুলি কুড়াইয়া নিয়াছে। মা কোনদিন পয়সা দিয়৷ পান কিনিয়া খাইতে পারে নাই। তার হাতের কুড়ানো পচা-পান পাইয়া মা কত খুশি হইয়াছে। একদিন অনন্ত তিতাস হইতে সেই লোকটাকে এক হাঁড়ি জল তুলিয়৷ দিয়াছিল। দোকানী সেদিন পচা-পান তো দিলই, সামান্য একটু দাগী হইয়াছে, একটু ছিঁড়িয়া ভাল পানের সঙ্গে মিশাইয়া দিলে কেহ ধরিতে পারিবে না, এমন পানও তার দিকে ছুড়িয়া ফেলিয়াছে। সেও অভ্যাসবশে ধরিয়াছে, কিন্তু তখন আর তাহার মা নাই। এই রকম ভাল ভাল পান ফেলিয়া দিবার কিছুদিন আগেই একদিন মা মরিয়া গেল। মাসী পান বড় একটা খায় না। দিলেও খুশি হয় না, না দিলেও রাগ করে না। মাসীর মা খায়—দিলে খুশি হয় না, না দিলে মারে।