কাদির অজুহাত পাইল সঙ্গে সঙ্গেই, ‘কাট-আলু খরিদারে নেয় না, বাছাবাছি কইরা থুইয়া রাখে। দিয়া দিলাম।’
ছেলে খুঁতখুঁত করিতে লাগিল, কিন্তু সাইত করলাম না।’ কাদির দিল খোলা ভাবে হাসিয়া বলিল, ‘করলাম এই এতিম ছাইলা-মাইয়ার হাতেই পরথম সাইত। খাইয়া দোয়৷ করব। আল্লা বড় বাচন বাঁচাইছে আইজ।’
কাদিরের এই কাজকর্ম বনমালীর খুব ভাল লাগিতেছিল। বিস্ময়ের সহিত সে কাদিরের মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। কাদির বনমালীর দিকে চাহিয়া তার ছেলেকে লক্ষ্য করিয়া বলিল, বড় আভাগ্য। এরা। কেউর মা নাই, বাপ নাই, লাথি ঝাটা খায়; কেউর মা আছে, কিন্তু দানা দিতে পারে না। কেউর বাপ আছে মা নাই। লোকে কয়, মা মরলে বাপ তালই, ভাই বনের পশু।‘
তামাক জ্বালাইয়া আনিয়াছিল। টিকায় ফু দিতে দিতে বনমালী বলিল, ‘একজনের যে মা মরছে, চোখের সামনেই দেখ তাছি।’
কাদিরের দৃষ্টি পড়িল ছেলেটার দিকে। লম্বা, কৃশ, হাড় জিরজির করিতেছে। শিশুমুখে ও মলিনতার ছাপ বেয়াড় রকমের স্পষ্ট। দলের বাহিরে দাঁড়াইয়া বড় বড় চোখ দুইটি মেলিয়া রাখিয়াছে কাদিরের মুখের উপর। ছেলের কাড়াকড়ি করিয়া হরির লুটের বাতাসার মত আলু ধরিতেছিল, আর সে নীরবে দাঁড়াইয়া আশাপূর্ণ মনে কামনা করিতেছিল কাদির বুড়ার মনের একটুখানি ছোয়া। যেন তাকে দেখিতে পাইলে অন্যান্য ছেলেদের থেকে আলাদা করিয়া শুধু তার একার জন্য বুড়া করুণার ধারা বহাইয়া দিবে। এ যেন তার দাবি। চিরদিনের নির্ভরতা মাখানে এই দাবি দুনিয়া যদি পূর্ণ করে তবে ভালো কাজ করা হইবে, যদি না করে তো না করিবে, সে শুধু একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া এখান থেকে চলিয়া যাইবে।
কাদির দুই মুঠ আলু তুলিয়া তার চোখের দিকে চাহিয়া একদিকে সরিয়া আসার ইঙ্গিত করিল। তার মুখে হাসি ফুটিয়া উঠিল। স্বচ্ছ আবদেরে হাসি; কিন্তু বড় মান। সর্বাঙ্গে মাতৃরিষ্টির ধ্বজ ধারণ করিয়া সে ছিল নীরবে দণ্ডায়মান। কাদিরের ডাকে সহসা সে আগাইয়া আসিল না।
দান প্রত্যাখ্যানের ভব্যতা। ‘আরে নে, আগাইয়া ধর; না তাইলে তারা নিয়া যাইব।’
ছেলেটা আদরে গলিয়া গিয়া ঘাড় নিচু করিল, তারপর ঘাড় ঘুরাইয়া অর্থহীন ভাবে এদিক ওদিক চাহিল, আর চাহিল মাথা তুলিয়া একবার সামনের, খাল পারের, আমিনপুর গ্রামের উপরের পূব আকাশের দিকে। কাদিরের অযাচিত দানের ধনগুলি তখন তার পায়ের কাছে মাটিতে লুটাইতেছে। আর সেই যে সে আকাশের দিকে চাহিল, একভাবে চাহিয়াই রহিল, মাথা আর নামাইতে পারিল না। কাদির তার চাওয়ার বস্তুর খোজে তাকাইল, কিছু বুঝিতে পারিল না। বনমালী তার চোখের দৃষ্টি অনুসরণ করিয়া দেখিল, আমিনপুরের গাছগাছালির মাথার উপর দিয়া আকাশে রামধনু উঠিয়াছে। ছেলেটা তারই দিকে চাহিয়া আছে।
‘অ, ধেনু উঠছে। তাই দেখ তাছে। বলিল বনমালী। জেলে সে। জেলেরা আর চাষীরা জল আর মাটি চষিয়া বেড়ায় মুক্ত আকাশের নিচে। উদয়ের মাধুরী আর অস্তের বিধুরতা কোনোদিন গোপন থাকে না তাদের কাছে। কিন্তু তারা কি সে সব কখনো চাহিয়া দেখিয়াছে? দেখিয়াছে কেবল দুপুরের খরাটাকে, যখন মাথার উপর আগুনের মত আসিয়া পড়িয়াছে তখন। শীতে শরতে সকালে বিকালে আকাশের গায়ে খামচা খামচা কত রঙীন মেঘ ভাসিয়া বেড়াইয়াছে। বৃষ্টির ফাঁকে ফাঁকে সূর্য চোখ মেলিলে তার বিপরীত দিকের আকাশে জাগিয়াছে কতদিন কত রামধনু। তারা কি কোনোদিন তাহা চাহিয়া দেখিয়াছে? হয়ত দেখিয়াছে। কিন্তু নূতন কিছু লাগে নাই চোখে। উঠে, মিলাইয়া যায়। চাহিয়া থাকিয়া দেখিবার কিছু নাই রামধনুতে। শিশুরা মায়ের কোলে থাকিয়া আকাশে চাঁদ দেখিয়া হাসে, হাততালি দেয়। কই বনমালীরা তো কোনোদিন চাঁদের দিকে চাহিয়া হাসেও নাই হাততালিও দেয় নাই। কাদির মিয়াদের ঈদের চাঁদ দেখিবার কত আগ্রহ। কত আনন্দ আর পুণ্যের বাণী লইয়া আকাশের এক কোণে উঁকি দেয় রমজানের চাঁদ। একফালি তুর্বল, প্রভাহীন চাঁদ—চাঁদের কণা বলিলেই চলে। কিন্তু সে চাঁদ যখন বড় হইয়া আকাশে সাঁতার কাটে তখন তো কই তারা চাহিয়াও দেখে না। তেমনি রামধনু দেখিবে বালকে, দেখিবে এই বোকা অর্বাচীন ভিখারী ছেলেট। দেখুক সে রামধনু; আর এদিকে তার পায়ের কাছে থেকে ছড়ানো আলুগুলি আর আর ছেলেরা কুড়াইয়া নিয়া যাক। বনমালীর ইচ্ছা হইল আলুগুলি কুড়াইয়া দেয়। কিন্তু নাবালকের দেখাদেখি রামধনুর দিকে চাহিয়া সেও নাবালক হইয়া গেল। সত্যই ত, রামধনু দেখিতে অত সুন্দর। তার বোনটি যখন ছোট ছিল, সেও একদিন তেমনি করিয়া রামধন্থর দিকে চাহিয়াছিল। কিন্তু সে আমন বোকার মত সব ভুলিয়া চাহিয়া থাকে নাই। হাতে নূতন ছগাছ। কাচের চুড়ি কিনিয়া দেওয়া হইয়াছিল। তাহাই বাজাইয়া হাততালি দিতেছিল আর একটা ছড়া কাটিতেছিল, ‘রামের হাতের ধেনু, লক্ষ্মণের হাতের ছিল, যেইখানের ধেনু সেইখানে গিয়া মিলা।’ মেয়েদের ধারণা, এই মন্ত্র পড়িলে রামধনু মিলাইয়া যাইবে। বোনটিকে কতদিন ধরিয়া দেখিতে যাওয়া হয় নাই। এই গায়েই তার বিবাহ হইয়াছে। এই হাটের অল্প দূরেই তার স্বামীর বাড়ি।
\
৫.২ রামধনু
বিরাট আকাশের ধনু। আকাশের দুই কোণ ছুঁইয়া বাকিয়া উঠিয়াছে। মোটা তুলির যেন সাত রঙের সাতটি পোঁচ। রঙগুলি সব আলাদা আলাদা, আর কি স্পষ্ট! পিছনের আকাশ হঠতে খসিয়া যেন আগাইয়া আসিয়াছে। যত অস্পষ্টতা যত আবছায়া অনেক পিছনে পড়িয়া রহিয়াছে, দিক উজ্জ্বল করিয়া বঁকা হইয়া উঠিয়াছে এই রামধনুট। কি উজ্জ্বল বর্ণ। কি স্নিগ্ধ আর সামঞ্জস্যপূর্ণ তার রঙের ভাজ। কোন কারিগর না জানি এই রঙের ভাজ করিয়াছে! চোখে কি ভালো লাগে; কি ঠাণ্ডা লাগে। কোথায় ছিল এতক্ষণ লুকাইয়া! কোথাও তো ছিল না। এখন কোথা হইতে কেমন করিয়া আসিল। চাঁদস্থরুজের দেশ এটা। তারা নিত্য উঠে, নিত্য অস্ত যায়। পশ্চিমে ডুবিয়া ঘুমাইয়া থাকে, আবার সকালে পূবে উদয় হয়। কিন্তু রামধনু থাকে কোথায়। বড় একটা ত দেখা যায় না। অনেকদিন পর দেখা যায় একদিন উঠিয়াছে। কতদিন ঘুমায় এ! কুম্ভকর্ণের মত! উঠিবারও তাল-বেতাল নাই। ইচ্ছা হইলে একদিন উঠিলেই হইল। কিন্তু, কি বড়! বোন ঠিকই বলিয়াছিল তার ছড়াতে—রামের হাতেরই ধনু এট। যে-ধনু অমন যে রাক্ষস, দশমাথা কুড়ি হাতের রাক্ষস,—জোর করিয়া সে ধনু তুলিতে গিয়া তারও মুখে রক্ত উঠিয়াছিল। রামায়ণের বইয়ের সে কথা বনমালী শুনিয়াছে সীতার বিবাহের পালা গানে ছুট-কীৰ্তনিয়ার মুখে। শেষে রাম তাকে হাতে তুলিয়া নেয়। হরধনু না কি বলিয়াছিল—তাই রামের হাতের ধনু। কিন্তু সীতা সে ধনু রোজই বাঁ হাতে তুলিয়া লইয়া ডানহাতে তলাকার জায়গাটুকু লেপিয়া পুছিয়া শুদ্ধ করিয়া দিত। তারপর সীতার বিবাহ হইয়া গেল। রাম তাকে নিয়া অযোধ্যাতে আসিল। তারপর সীতা আর বাপের বাড়ি ফিরিয়া আসে নাই। নাঃ, বোনটাকে দেখিতে যাইতেই হইবে। কতদিন তাকে নেওয়া হয় নাই।