সেই খালের পূব পারে একটা পল্লী। নাম আমিনপুর। একদিকে কয়েকটা পাটের অফিস, আরেক দিকে কতকগুলি ঘরবাড়ি গাছ-গাছালি। খালের এপারে হাট বসিতেছে, তার ওপারে গাছ-গাছালির মাথার উপর দিয়া আকাশে উঠিয়াছে একটা রামধন্থ। সূর্য পশ্চিমদিকে ঢলিয়া পড়িয়াছে। পূবের আকাশে কণাকণা বৃষ্টির আভাসে ঝাপসা একটা ঠাণ্ডা ছায়া লাগানো। পশ্চিমের সূর্যের সাত রঙ পূবের আকাশের মেঘলার ফাদে ধরা পড়িয়া গিয়া উঠাইয়াছে এই রামধনু।
মাত্র ঘণ্টা দুই আগে যে বৃষ্টি হইয়াছে তেমন প্রচণ্ড বৃষ্টি খুব কমই দেখা যায়। নৌকাতে থাকিয়া ততটা বোঝা যায় না। বাড়িতে থাকিলে দেখা যাইত ঘরের চালের ঝমাম শব্দে কান ফাটিয়া যাইতেছে; চাল-বাহিয়া-পড়া একটানা বৃষ্টির জলে ছাচে লম্বা এক সারি গত হইয়া গিয়াছে। কোথায় কোন নালা আটকাইয়া গিয়া উঠান জলে ভরিয়া গিয়াছে, তুলসীতলার উঁচু মাটিটুকু বাদে ভিটার নিচের সবটুকু জায়গাডুবিয়া গিয়াছে: উঠানের কোণে অযত্নে যে-সব দূৰ্বাঘাস গজাইয়াছিল, সেগুলি জলে সাঁতার কাটিতেছে।
খালটা শুকনা ছিল। আজিকার ঢলে মাঠময়দান ভাসিয়াছে, হালদেওয়া ক্ষেতগুলির ভাঙ্গা ভাঙ্গ মাটি ঢলে গুলিয়া গিয়া কাদা হইয়াছে। সেই কাদাগোলা জল তাল উপছাইয়া পড়িয়াছে আসিয়া খালে। শতদিক হইতে শত বাহু বাড়াইয়া দিয়া ক্ষেতের খালের দৈন্যদশা প্রাচুর্যে পূর্ণ করিয়া দিয়াছে। খালে তখন উজানের ঠেলা। যে-খাল আগে নদীর জল টানিয়া নিয়া কোনোরকমে শুকনা গলা ভিজাইয়া রাখিত, আজ সে খাল উল্লোলিত, কল্লোলিত, উথলিত হইয়া স্রোত বাকাইয়া ঢেউ খেলাইয়া বুক ফুলাইয়া তার ভরা বুকের উপচানো জল তিতাসের বুকে ঢালিয়া দিয়াছে। বৃষ্টি থামিয় গিয়াছে অনেকক্ষণ, কিন্তু সে দেওয়া এখনও থামে নাই। এখনও ধারায় ছুটিয়া আসিতেছে সেই কাদাগোলা জল।
কাদিরের পিপাসা হইয়াছিল। আজলী ভরিয়া তুলিয়া মুখে দিতে গিয়া দেখে অর্ধেক তার মাটি। বনমালী দেখিতে পাইয়া দয়ার্জ হইয়া উঠিল; ‘থইয়া দেও, খাইতে পারব না। খালের জলে গাঙের জলেরে খাইছে। মালো-পাড়ায় আমার কুটুম আছে। আলু তোলার পর নিয়া যামু তোমারে।‘
‘কি কুটুম? সাদি সম্বন্ধ করচ, না কি?’
‘না। ভইন বিয়া দিছি।’
বনমালীর সাহায্য পাইয়া কাদিরের সব আলু একদণ্ডের মধ্য হাটে গিয়া উঠিল। চারিদিকে ছড়াইয়া না পড়ে এইজন্য কাদিরের ছেলে জলো-ঘাসের ন্যাড়া বানাইয়া আলুর গাদার চারিপাশে গোল করিয়া বাধ দিল। সেই বাধ ডিঙ্গাইয়া দুই চারিট ছোট ছোট আলু এ-পাশে ও-পাশে ছিটকাইয়া পড়িতে লাগিল। আর সেগুলি মালিকের অধিকারের বাইরে মনে করিয়া ঝাপাইয়া পড়িয়া ধরিতেছিল কতকগুলি ছোট ছোট ছেলেমেয়ে। ভিখারীর ছেলে নয়, কিন্তু দেহের আকারে, বসনের অপরিচ্ছন্নতায় ও অপ্রাচুর্যে এবং অস্বাভাবিক কাঙ্গালপনায় সেগুলিকে মনে হইল যেন ভিখারীর বাড়া। ইহার সবখানেই আছে, সব দেশে সব গায়ে আর সব গায়ের বাজারে। কাদিরের যারা আলু বেচিতে আসে তারা অমন দুই চারিট আলুর জন্য ইহাদিগকে ধমক দেয় না, কিছু বলেও না। তাদের কত আলু, নিক না তুইচারিটা এই সব দুঃখীর ছেলেপিলে। পয়সা দিয়া ত কিনিতে পারে না। কিন্তু ধমক দেয় বেপারীরা। আলুতে হাত দিলে চড়-চাপড় মারে, আলু কাড়িয়া নেয়; শুধু তাদের থেকে নেওয়া আলু নয়, অপর জায়গা থেকে সংগ্রহ করা আলুও কাড়িয়া নেয় বেপারীরা। আর ছোট ছোট কচি গালগুলিতে মারে ঠাস করিয়া চড়। চড় খাইয়া উহারা চীৎকার করিয়া কাঁদে না, গাল-মুখ চাপিয়া ধরিয়া এখান হইতে সরিয়া পড়ে আরও মার খাওয়ার ভয়ে। কেবল যখন তাদের নিজের সঞ্চয় সুদ্ধ কাড়িয়া নেয়, কাকুতি করিয়া ফল হয় না, অনুরোধ করিলে উল্টা গাল খায় মা-বাপ সম্পর্কিত অশ্রাব্য ভাষায়, তখন কেবল অনুচ্চকণ্ঠে ফুপাইয় ফুপাষ্টয়া কাঁদে। কাদির এ হাটে অনেক আলু বেচিয়াছে আর অনেক দিন হইতে ইহাদিগকে দেখিয়া আসিতেছে। বছরের পর বছর ইহারা আলু কুড়াইয়া চলিয়াছে, কতক মরিয়াছে, কতক বড় হইয়া সংসারে ঢুকিয়াছে, না হয়ত পুঁজিদার কারবারী নয়তো জমি-মালিক মজুরখাটানেওয়ালা বড়-চাষীর গোলামি করিয়া জানপ্রণ খুয়াইতেছে। কাদিরকে ইহারা আর চিনিতে পরিবে না, কাদির ও ইহাদের কাউকে সামনে দেখিলে ঠাহর করিতে পারিবে না। কিন্তু তার বেশ মনে পড়ে, হাটের মাটিতে আলু ঢালিতে গিয়া ইচ্ছা করিয়া দশটা-বিশট। আলু এইসব কৃপা-প্রার্থীর দিকে ঠেলিয়া দিয়াছে। এখনও দিতে কৃপণত। করে না। হাটে এই প্রথম আলু উঠিয়াছে দেখিয়া এই খুদে ডাকাতের দল সবগুলি জোট পাকাইয়া আসিয়া এইখানে মিলিয়াছে। কারে হাতে স্যাকুড়ার একখানা ছোট থলে; পুরানো কাপড়ের লাল নীল পাড়ের সূতা দিয়া অপটু হাতের সূচের ফোড়ে তৈয়ারী। কারে হাতে মালসা কারো বা র্কোচড়মাত্র সম্বল।
কি ভাবিয়া সহসা কাদির কল্পতরু হইয়া উঠিল। তাহার হয়ত ইচ্ছা হইয়াছিল ওদের হাতে হাতে অনেকগুলি আলু সে বিলাইয়া দেয়। কিন্তু সাবালক বড় ছেলে সামনে। কি মনে করিবে। বিক্ৰী করিতে হাটে আসিয়াছে, খয়রাত করিবার কোন অর্থ হয় না। ইচ্ছা করিয়া খুশি মনে নড়াচাড়া করিতে করিতে ঘাসের বাধ উপচাইয়া কতকগুলি আলু চারিপাশে ছড়াইয়া দিল ওদের জন্য। ছেলের দৃষ্টি এড়াইলন, ‘না করলাম বোয়ানি, না করলাম সাইত; তুমি বাপ অখনই এইভাবে দিতে লাগছে!’