ছইয়ের বাহিরে বাঁশের মাচানগুলিতে বৃষ্টির বড় বড় ফোট। পড়িয়া ভাঙ্গিয়া চৌচির—শতচির হইয়া পড়িতেছে। নৌকার বাহিরে যতদূর চোখ যায় সবটাই তিতাস নদী। তার জলের উপর বৃষ্টির লেখা-জোখাহীন ফোটাগুলি পাথরের কুচির মত, তার বুকে গিয়া বিধিতেছে আর তারই আঘাত খাইয়া ফোটার চারিপাশটুকুর জল লাফাইয়া উঠিতেছে। হাওয়া নাই, জলে ঢেউ নাই। তবু নদীর বুকময় আলোড়ন। আর, একটানা ঝ ঝ। ঝিম্ ঝিম শব্দ। ছইয়ের সামনের দিক খোল। এদিক দিয়া বাতাস ঢোকে না। বলিয়া জলের ছাটও ঢোকে না। যে দিক দিয়া ঢুকিবার, সে পিছনের দিক। সেদিক বন্ধ আছে। কাদিরের চক্ষু ছিল নৌকার বাতার বাহিরে, যেখানে কোন সুদূর হইতে তীরের বেগে ছুটিয়া আসা ফোটাগুলি তীরের মতই তিতাসের বুকে বিধিয়া আলোড়ন জাগাইতেছে। বনমালী তার গামছাখানা খানিক বৃষ্টির জলে ধরিয়া রাখিয়া, চিপিয়া জল নিংড়াইয়া কাদিরের হাতে দিয়া বলিল, ‘নেও বেপারী, গতর মোছ। কাদির সস্নেহে তার মুখের দিকে চাহিয়া দেখিল, বনমালীকে নিতান্ত ছেলেমানুষটির মত দেখাইতেছে, অথচ মালোর বেটার দেহের পেশীগুলি কেমন মজবুত।
‘বেপার আমার বংশের কেউ করে নাই বাবা। চরের জমিতে আলু করছি। শনিবারে শনিবারে হাটে গিয়া বেচি। বেপারীর কাছে বেচি না। বড় দরাদরি করে আর বাকি নিলে পয়সা দেয় না।‘
‘মাছ-বেপারীরাও এই রকম। জাল্লার সাথে মুলামুলি কইরা দর দেয় টেকার জাগায় সিকা। শহরে নিয়া বেচে সিকার মাল টেকায়।’
কাদিরের দৃষ্টি সামনের দিকে, যেখানে বৃষ্টির বেড়াজালে সব কিছু ঢাকা পড়িয়া গিয়াছে। খানিক চাহিয়া থাকিয়া বলিল, ‘কি ঢল নামৃছে রে বাবা, গাও-গেরাম মালুম হয় না। তাহার তামাক খাইতে ইচ্ছা করিতে লাগিল। এই সময়েই অন্তর্যামী বনমালী নামক ছেলেটা তামাকের ব্যবস্থায় হাত দিল। বাঁশের চোঙ্গার এক দিকে টিকা, আর এক দিকে তামাক রাখার ব্যবস্থা – কাদিরের ছেলে এইবার ভাবনায় পড়িল। সে যখন আরও ছোট ছিল, তখন বাপের সঙ্গে গ্রাম গ্রামান্তরের কত বামুন কায়েতের বাড়িতে দুধ বেচিতে গিয়াছে।
তারা তার বাপকে আদর করিয়া ডাকিয়া বসায়। নিজের চেয়ারে বসিয়া ছেলেপুলের হাতে একখানা ধূলিধূসর তক্ত আনাইয়া মুখে মিষ্টি ঢালিয়া দিয়া বলে, ‘বও বও, কাদির বও। তামুক খাও। তাদের নিজেদের হাতে তেলকুচ্কুচে মস্থণ ইকী! কাদিরের জন্য বাহির করিয়া দেয় মাচার তলায় হেলান-দিয়া-রাখা সরু খামচাখানেক আকারের থেলে। কাদির আলাপী মানুষ। বলিতে যেমন ভালবাসে শুনিতেও তেমনি ভালবাসে। আলাপে মজিয়া গিয়া লক্ষ্যই করে না কোথায় বসিল আর কি হাতে লইল। ফু দিয়া ধূলা উড়াইয়া ইকার মুখে মুখ লাগায়। তার বাপ মাটির মানুষ, তাই অমন পারে। ওরা বড় লোক। তেলে জলে যেমন মিশে না, তাদের সঙ্গেও তেমনি কোনোদিন মেশার সম্ভাবনা নাই। কিন্তু এরা জেলে। চাষার জীবনের মতই এদের জীবন। উঁচু বলিয়া মানের ধুলি নিক্ষেপ করা যায় না এদের উপর; বরং সমান বলিয়া গলা জড়াইয়া ধরিতেই ভাল লাগে। কাটিলে কাটা যাইবে না, মুছিলে মুছা যাইবে না, এমনি যেন একট সম্পর্ক আছে জেলেদের সঙ্গে চাষীদের। বনমালী তামাক সাজার আয়োজন করিতেছে। নিজের হুকায় স্থখের টান দিয়া, সে যদি কলকেখানা খুলিয়া তার বাপের দিকে হাত বাড়ায়, সে তখন কি করিবে; বড়লোকের হাতের অপমানে চটা যায়, কিন্তু সমান লোকের হাতের অপমানে চটা যায় না, খালি ব্যথার ছুরিতে কলিজা কাটে।
এই ঘনঘোর বাদলের মাঝখানে বসিয়া মাথা বাঁচাইতে বাঁচাইতে কাদির হয়ত বনমালীর হুকা-বিচ্যুত কলিকাখান খুশি মনে হাতে লইত। কিন্তু বনমালী মালসায় হাত দিয় দেখে জলের ছাট লাগিয়া আগুনটুকু নিবিয়া গিয়াছে।
নদীর মোড় ঘুরিতে বাজার দেখা গেল। একটু আগে বৃষ্টি হইয়া গিয়াছে। এখন চারিদিক ফর্সা। কিন্তু রোদ উঠে নাই। আকাশের কোন কোন দিক গুমোটে আচ্ছন্ন। মনে হয় কোথায় কোথায় যেন এখনও বৃষ্টি হইতেছে। এক একবার দমকা হাওয়া আসে। ঠাণ্ডা লাগে শরীরে। মেহনতের সময় এই বাতাস গায়ে বড় মিঠা লাগে। নৌকা একেবারে তাঁর ঘেঁষিয়া না চলিলেও, তীরের গাছ-গাছড়ার সবুজ ছায়া কাদিরের নৌকার ধমকে জলের ভিতর কাঁপিয়া মরিতেছে। ছায়াগুলি এত কাছে থাকিয়া কাঁপিতেছে, আর কাদিরের ছেলের বৈঠার আঘাত খাইয়া ভাঙ্গিয়া শতটুকরা হইয়া যাইতেছে।
নদীর এ বাম তীর। দক্ষিণ তীর ফাঁকা। গ্রাম নাই, ঘর বাড়ি নাই, গাছ-গাছড়া নাই। খালি একটা তীর। তীর ছাড়াষ্টয়া কেবল জমি আর জমি। অনেক দূর গিয়া ঠেকিয়াছে ধোঁয়াটে কতকগুলি পল্লীর আবছায়ায়। যে সব খোলা মাঠ বাহিয়া বাতাস আসে, নদী পার হইয়া লাগে আসিয়া এ পারের গাছগুলির মাথায়।
ছোটবড় দুইটি নৌকাই একসঙ্গে গিয়া হাটের মাটিতে ধাক্কা খাইল।
পশ্চিম ইষ্টতে সোজা পূবদিকে আসিয়া এইখানটায় নদী একটা কোণ তুলিয়া দক্ষিণ দিকে বাকিয়া গিয়াছে। সেই কোণের মাটিই বাজারের ‘টেক’। তারই পূবদিক দিয়া একটা খাল গিয়াছে সোজা উত্তর দিকে সরল রেখার মত। নদীর বাক থেকে খালটা গিয়াছে, দেখিয়া মনে হয় নদী চলিতে চলিতে এখানে দক্ষিণদিকে মুখ ঘুরাইয়াছে আর উত্তরদিকে কোথায় অদৃশ্য হইয়া গিয়াছে তার মাথার লম্বা বেণীটা।