বর্ষাকাল আগাইয়া চলে।
আকাশ ভাঙ্গিয়া বর্ষণ সুরু হয়। সে বর্ষণ আর থামে না। তিতাসের জল বাড়িতে শুরু করে। নিরবধি কেবল বাড়িয়া চলে।
হু হু করিয়া ঠাণ্ডা বাতাস বহে। নদীর ঘোলা জলে ঢেউ তোলে। সে-ঢেউ জেলেদের নৌকাণ্ডলিকে বড় দোলায়। তার চাইতে বেশি দোলায় আলুর নৌকাণ্ডলিকে।
সকরকন্দ আলু বেচিতে রওয়ানা হইয়াছিল একটি নৌকা। পথে নামিয়াছে ঢল। ছোট নৌকা। তাতে কানায় কানায় বোঝাই। বড় বড় আলু। আধসের থেকে একসের এক একটার ওজন। নৌকার বাত ডুবে-ডুবে। তার উপর বৃষ্টির জল। এখনি না সেচিতে পারিলে হয়ত কোনো এক সময় টুপ করিয়া ডুবিয়া যাইবে। বোঝাই নাও, সেউতি ঢুকে না। কাদির মিয়া হতবুদ্ধি হইয়া যায়। শুকনো বাঁশপাতার মাথালটা চিবুক বেড়াইয়া মাথায় আঁটা। তাতে কেবল মাথাটাই বাঁচে। সমস্ত শরীরে লাগে বৃষ্টির অবারণ ছাট। মাথাল শুদ্ধ মাথা বাকাইয়া কাদির তাকায় আকাশের দিকে আর কাদিরের ছেলে চায় বাপের মুখের দিকে। চার দিক একেবারেশূন্যদেখা যায়, মাথায় কোন বুদ্ধি জোগায় না। বাপ বলিতে থাকে, ‘অত মে’ন্নতের সাগরগঞ্জ আলু, বেবাক বুঝি যায় রসাতলে।‘ ছেলে বলে, ‘বা-জান তুমি সাঁতার দিয়৷ পারে যাও। গরীবুল্লার গাছের তলায় গিয়া জান বাঁচাও, আমার যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ। যখন দেখুম নাও ডুবতাছে, দিমু সব আলু ঢাইল্যা তিতাসের পানিত। তারপর ডুবা নাও পারে লাগাইয়া তোমারে ডাক দিমু।’
এমন সময় দেখা গেল পরিচিত জেলেনৌকা, সন্ধ্যায় ঘরেফের সাপের মত তিতাসের দীঘল বুকে সাঁতার দিয়াছে। দুই দাঁড় এক কোরা মচ মচ ঝুপ ঝাপ, করিয়া চলিয়াছে, জল কাটিয়া, ঢেউ তুলিয়। তার ঢেউ লাগিয়াই বুঝিবা ছোট আলুর নৌকা ডুবিয়া যায়। কাদির ডাকিয়া বলে, ‘কার নাও!’
পাছার কোরা হইতে ধনঞ্জয় ডাকিয়া বলে, ’অ বনমালী, সেওতখান তাড়াতাড়ি বাইর কর। একটা অলুর নাও ডুব তাছে।’
চট্পট দু’খানা দাঁড় উঠিয়া গেলে ধনঞ্জয় হাতের কোরা চিত করিয়া চাপিয়া ধরিল। সাপের ফণার মত নৌকাখানা বা দিকে চির খাইয়া কাদিরের নৌকা বরাবর রুদ্ধগতি হইয়া গেল।
ধনঞ্জয়ের বুদ্ধি অপরূপ। তার বুদ্ধি খেলিয়া গেল একান্তই ঠিক সময়ে। একটু দেরি হইলে সর্বনাশ হইয়া যাইত।
তারপর জেলে নৌকার তিনজন, আলুর নৌকার দুইজন, পাঁচ জনের হাত চলিল সেলাইকলের সূচের মত ফর ফর করিয়া। দেখিতে দেখিতে জেলে নৌকার প্রশস্ত ডরা এক বোঝাই আলুতে ভরিয়া গেল। আর আলুর নৌকা খালি হইয়া ভাসিয়া উঠিল।
কাদিরের মাথার টোকা তখনও অবিশ্রান্ত বৃষ্টি হইতে তার মাথা বাঁচাইয়া চলিয়াছে। বিপদমুক্তির পরের অবসন্নতা তাকে কাবু করিল। মাচনের উপর বসিয়া পড়িয়া বলিল, ‘মালোর পুত, বড় বাঁচানটাই আজ বাঁচাইলা।‘
এতক্ষণ বৃষ্টি ছিল রিমঝিমে, ছন্দমধুর। সহসা সে-বৃষ্টি ক্ষেপিয়া গেল। মার মার কাট্ কার্টু শব্দে বৃষ্টি আকাশ ফাড়িয়া পড়িতে লাগিল। সাঁ সাঁ ঝম্ ঝম্ সাঁ সাঁ ঝম্ ঝম্ শব্দে কানে বুঝি তালা লাগিয়া যায়। তীর-ভূমি, তীরের মাঠ-ময়দান, ‘গাঁ-গেরাম’ আর চোখে দেখা যায় না। ধোঁয়াটে শাদা আবছায়ায় চারিদিক ঝাপসা হইয়া গিয়াছে।
বনমালী মনে করিয়াছিল তারা তীরে নাও ঠেকাইয়া বসিয়া থাকিবে। কিন্তু তীর কোথায়। কাছেই তীর; তবু চোখে দেখা যায় না। ধনঞ্জয় ছইয়ের পেছনের মুখ ধাপর দিয়া ঢাকিতে ঢাকিতে বলিল, ‘বনমালী ভাই, গাঙ দীঘালে নাও চালাইয়া কোনো লাভ নাই। ইখানেই পাড়া দে।’
ভারী মোট একটা বাঁশ জলে নামাইয়া নদীর মাঝখানেই দুই জনে পাড় দিতে দিতে পুতিয়া ফেলিল। তার সঙ্গে শক্ত দড়ি দিয়া নৌকাখানা বাঁধিয়া ধনঞ্জয় বলিল, থাউক, নাও অখন বাতাসের সাথে সাথে ঘুরুক। কই অ মিয়ার পুত, ছইয়ের তলে গিয়া বও। ’
কাদির মাথা ঢুকাইতে ঢুকাইতে থামিয়া গেল দেখিয়া বনমালী বলিল, ‘ছইয়ের তলে কিছু নাই, ভাত ব্যানুন সব খাওয়া হইয়া গেছে।’
পাঁচজনেরই ভিজা গা। সঙ্গে একাধিক কাপড় নাই যে বদলায়। ছোট ছইখানার ভিতরে তারা গা-ঠেকাঠেকি করিয়া বসিয়া রহিল। কাদিরের ভিজা চুল এলোমেলো হইয়া গিয়াছে। তার শাদা দাড়ি হইতে বিন্দু বিন্দু জল ঝরিয়া পড়িতেছে বনমালীর কাঁধের উপর। কাদির এক সময় টের পাইয়া হাতের তালুতে বনমালীর কাঁধের জলবিন্দুগুলি মুছিয়া দিল। বনমালী ফিরিয়া চাহিল কাদিরের মুখের দিকে। বড় ভাল লাগিল তাকে দেখিতে। লোকটার চেহারায় যেন একটা সাদৃশ্ব আছে যাত্রাবাড়ির রামপ্রসাদের সঙ্গে। তারও মুখময় এমনি শাদ সোণালি দাড়ি। এমনি শান্ত অথচ কর্মময় মুখভাব। রামায়ণ মহাভারতে পড়া বাল্মীকি ও অন্যান্য মুনিঋষিদের যেন রামপ্রসাদ একজন উত্তরাধিকারী। আর এই কাদির মিয়া? হা, তার মনে পড়িতেছে। সেবার গোকনঘাটের বাজারে মহরমের লাঠিখেলা হয়। বনমালী দেখিতে গিয়াছিল। ফিরিবার সময় তাদেরই গায়ের একজন মুসলমানের সঙ্গে পথে তার দেখা হয়। তারই মুখে কারবালার মর্মবিদারক কাহিনী শুনিতে শুনিতে বনমালী প্রায় র্কাদিয়াই ফেলিয়ছিল। এর সঙ্গে আরও শুনিল তাদের প্রিয় পয়গম্বরের কাহিনী। সজন বীরত্বে ছিল বিশাল, কিন্তু তবু তার আপন জনকে বড় ভালবাসিত। কাদির যেন সেই বিরাটেরই একটুখানি আলোর রেখা লইয়া বনমালীর কাঁধে দাড়ি ঠেকাইয়া চুপচাপ বসিয়া আছে। বনমালীর বড় ভাল লাগিতেছে। বাস্তবিক, যাত্রাবাড়ির রামপ্রসাদ, বিরামপুর গায়ের এই কাদির মিয়া—এরা এমনি মানুষ, যার সামনে হোচট খাইলে হাত ধরিয়া তুলিয়৷ অনেক কাটাঘেরা পথ পার করাইয়া দিবে; আবার দাড়ির নিচে প্রশান্ত বুকটায় মুখ গুঁজিয়া, দুই হাতে কোমর জড়াইয়া ধরিয়া ফু পাইয়া কাদিলেও ধমক দিবে না, কেবল অসহায়ের মত পিঠে হাত বুলাইবে। বনমালীর চোখ সজল হইয় উঠে। তার বাপও ছিল এমনি একজন। কিন্তু সে আজ নাই। একদিন রাতের মাছধরা শেষে ভিজা জাল কাঁধে করিয়া বাড়ীফিরিতেছিল। পথের মাঝে তুফানে গাছ-চাপা পড়িয়া মারা গিয়াছে।