ওরা কারা ? ওরা মালোদের ছেলেরা । আর মালোদের মেয়েরা । ওরা তারা নয় যাদের দেয়াল-ঘেরা বাড়ি, সামনে আছে পুষ্করিণী , পাশে আছে কুয়া, যাদের আঙ্গিনার পাড় থেকেই শুরু হইয়াছে পথ – সে পথ গিয়াছে শহরের দিকে, পাশের গাঁগুলিতে এক একটা শাখাপথ ঢুকাইয়া দিয়া । সে পথে ঘোড়ার গাড়ি চলে ।
আর মালোদের ঘরের আঙ্গিনা থেকে শুরু হইয়াছে যত পথ সে-সবই গিয়া মিশিয়াছে তিতাসের জলে । সে-সব পথ ছোট ছোট । পথের এধার থেকে বুকের শিশু কাঁদিয়া উঠিলে ওধার থেকে মা টের পায় । এধারের তরুণীর বুকের ধুক্ ধুকানি ওপারের নৌকার মাচানে বসিয়া মালোদের তরুণরা শুনিতে পায় । এপথ অতি খর্ব । দীর্ঘপথ গিয়াছে মাঝ-তিতাসের বুক চিরিয়া । সেপথে চলে কেবল নৌকা ।
তিতাস সাধারণ একটা নদী মাত্র । কোনো ইতিহাসের কেতাবে, কোনো রাষ্ট্রবিপ্লবের ধারাবাহিক বিবরণীতে এ নদীর নাম কেউ খুঁজিয়া পাইবে না । কেননা, তার বুকে যুযুধান দুই দলের বুকের শোণিত মিশিয়া ইহাকে কলঙ্কিত করে নাই । কিন্তু তাই বলিয়া তার কি সত্যি কোনো ইতিহাস নাই ?
পুঁথির পাতা পড়িয়া গর্বে ফুলিবার উপাদান এর ইতিহাসে নাই সত্য, কিন্তু মায়ের স্নেহ, ভাইয়ের প্রেম, বৌ-ঝিয়েদের দরদের অনেক ইতিহাস এর তীরে তীরে আঁকা রহিয়াছে । সেই ইতিহাস হয়ত কেউ জানে, হয়ত কেউ জানে না । তবু সে ইতিহাস সত্য । এর পারে পারে খাঁটি রক্তমাংসের মানুষের মানবিকতা আর অমানুষিকতার অনেক চিত্র আঁকা হইয়াছে । হয়ত সেগুলি মুছিয়া গিয়াছে । হয়ত তিতাসই সেগুলি মুছিয়া নিয়াছে ! কিন্তু মুছিয়া নিয়া সবই নিজের বুকের ভিতর লুকাইয়া রাখিয়াছে । হয়ত কোনোদিন কাহাকেও সেগুলি দেখাইবে না, জানাইবে না কারো সেগুলি জানিবার প্রয়োজনও হইবে না । তবু সেগুলি আছে । যে-আখর কলার পাতায় বা কাগজের পিঠে লিখিয়া অভ্যাস করা যায় না, সে-আখরে সে-সব কথা লেখা হইয়া আছে । সেগুলি অঙ্গদের মতো অমর । কিন্তু সত্যের মতো গোপন হইয়াও বাতাসের মতো স্পর্শপ্রবণ । কে বলে তিতাসের তীরে ইতিহাস নাই !
আর সত্য তিতাস-তীরের লোকেরা ! তারা শীতের রাতে কতক কতক কাঁথার তলাতে ঘুমায় । কতক জলের উপর কাঠের নৌকায় ভাসে ।। মায়েরা, বোনেরা আর ভাই-বৌয়েরা তাদের কাঁথার তলা থেকে জাগাইয়া দেয় । তারা এক ছুটে আসে তিতাসের তীরে । দেখে, ফরসা হইয়াছে; তবে রোদ আসিতে আরও দেরি আছে । নিস্তরঙ্গ স্বচ্ছ জলের উপর মাঘের মৃদু বাতাস ঢেউ তুলিতে পারে না । জলের উপরিভাগে বাষ্প ভাসে – দেখা যায়, বুঝি অনেক ধোঁয়া । তারা সে ধোঁয়ার নিচে হাত ডোবায়, পা ডোবায় । অত শীতেও তার জল একটু উষ্ণ মনে হয় । কাঁথার নিচের মায়ের বুকের উষ্ণতার দোসর এই মৃদু উষ্ণতাটুকু না পাইলে তারা যে কি করিত ।
শরতে আকাশের মেঘগুলিতে জল থাকে না । কিন্তু তিতাসের বুকে থাকে ভরা-জল । তার তীরের ডুবো মাঠময়দানে সাপলা সালুকের ফুল নিয়া, লম্বা লতানে ঘাস নিয়া, আর বাড়ন্ত বর্ষাল ধান নিয়া থাকে অনেক জল । ধানগাছ আর সাপলা সালুকের লতাগুলির অনেক রহস্য নিবিড় করিয়া রাখিয়া এ জল আরও কিছুকাল স্তব্ধ হইয়া থাকে । তারপর শরৎ শেষ হইয়া আসে । কে বুঝি বৃহৎ চুমুকে জল শুষিতে থাকে । বাড়তি জল শুকাইয়া গিয়া তিতাস নিচে থাকিয়া মাখনের মত নরম হইয়া গিয়াছিল, সে মাটি আবার কঠিন হয় । আসে হেমন্ত ।
হেমন্তের মুমূর্ষু অবস্থায় কখন ধানকাটার মরসুম শুরু হইয়া গিয়াছিল । পারে সব খানেই গ্রাম নাই । এক গ্রাম ছাড়াইয়া আরেক গ্রামে যাইতে মাঝে পড়ে অনেক ধানজমি । জমির চাষীরা ধানকাতা শেষ করিয়া ভারে ভারে ধান এদিক ওদিকের গ্রামগুলিতে বহিয়া নিয়া চলে । তারা তিতাসের ঠিক পাড়ে থাকে না । থাকে একটু দূরে । একটু ভিতরের দিকে । সেখান হইতে মাঘের গোড়ায় আবার তারা তীরে তীরে সর্ষে বেগুনের চারা লাগায় । তীরের যেখানে যেখানে বালিমাটির চর, সেখানে তারা আলুর চাষ করে । এ মাটিতে সকরকন্দ আলু ফলায় অজস্র ।
জোবেদ আলীর জোয়ান ছেলেরা ওপারে আলু লাগাইয়া তিন ভাইয়ে এক-সমানে আলী আলী আলী বলিয়া তাদের লম্বা ডিঙ্গিখানা ভাসাইয়া তাতে উঠিয়া পড়িল । বেলা পড়িয়া আসিয়াছে । হালের চারিজোড়া বলদ ও দুইজোড়া ষাঁড় পার করাইতে হইবে । সে কাজ করিবে তাদের মুনীস-দুইজন । সাঁরা বছর তারা জোবেদ আলীর বাড়িতে জন খাটে । খায় দায়, মাহিনা পায় । সারাদিন – ভোর হইতে রাত-অবধি খাটে, রাতের খানিকটা সময় নিয়া নিজেদের বাড়িতে পরিবারের সান্নিধ্য লাভ করিয়া আসে । দিনমানে আর দেখা হয় না । পরিবারেরাও এর বাড়ি ওর বাড়ি ধান ভানিয়া পাট গুটাইয়া কিছু-কিঞ্চিৎ উপায় করে । এইভাবে দিন গুজরায় তারা । কাজেই জোবেদ আলীর ছেলেরা যখন আলী আলী আলী বলিয়া নৌকায় নদী পার হইতে থাকে, মুনীস-দুইজন তখন চারিজোড়া বলদ ও দুইজোড়া ষাঁড়ের অনিচ্ছুক দেহমন শীতের জলে নামাইয়া মাথায় পাগড়ি বাঁধিয়া গরুদের ল্যাজে ধরিয়া আল্লা আল্লা মোমিন বলিয়া সাঁতার দেয় । সকালে এপার হইতে ওপার যাইবার বেলা লাঙ্গল কাঁধে করিয়া সর্ষে ক্ষেত-গুলির আলের উপর দিয়া গিয়াছে । তীর-অবধি সর্ষেফুলের হলদে জৌলুষে হাসিয়া উঠিয়াছিল । মনে হইয়াছিল কে বুঝি তিতাসের কাঁধে নক্সা-করা উড়ানি পরাইয়া রাখিয়াছে । অর্বাচীন গরুগুলি পাছে তাতে মুখ দেয়, তার জন্য কত না ছিল সতর্কতা । এখন এ-পারে উঠিয়া গায়ের জল মুছিতে মুছিতে চারিদিক আঁধার হইয়া আসে । আঁধারে সব একাকার, গরু কোথায় মুখ দিবে ! দিনের শ্রমে শ্রান্ত গরু । আর শ্রান্ত আ দুইজন মানুষ সারাদিন অসুরের বল নিয়া ক্ষেতে খাটিয়াছে । এবার বাড়িতে যাইবে । তাই এত ব্যস্ততা । কিন্তু কার বাড়িতে যাইবে ! তাদের প্রভু জোবেদ আলীর বাড়িতে । নিজের বাড়িতে নয় । পাখিরাও এ সময় নিজের বাসায় যায় । তারা যাইবে মুনিবের বাড়িতে । গিয়া গোয়ালে গরু বাঁধিবে । ঘাস কাটিবে । মাড় দিবে, খইল ভুষি দিবে । জোতদার চাষীর বাড়িতে কত কাজ । এটা সেটা টুকিটাকি কাজ করিতে করিতে হাজারগণ্ডা কাজ হইয়া যায় । প্রকাণ্ড চওড়া উঠান । চার ভিটায় বড় বড় চারিটা ঘর । বাহিরের দিকে গোয়ালসুদ্ধ আরো তিন-চারিটা ঘর । দড়ি পাকানো হইতে বেড়াবাঁধা পর্যন্ত এই এতবড় বাড়িতে কত কাজ যে এই দুইজনের জন্য অপেক্ষা করিয়া থাকে । কাজ করিতে করিতে রাত বাড়িয়া চলে । এক দময় ডাক আসে – ‘অ করমালী অ বন্দালী খাইয়া যাও !’