‘তুমি ত তার মনের মানুষ মিলাইয়া দিতে পার না।’
‘তা পারি না। তবে চেষ্টা কইরা দেখতে পারি, আমি নিজে তার মনের মানুষ হইতে পারি কিনা?’
‘বসন্তে তোমার মন উতালা করছে দিদি। তোমার অখন একজন পুরুষ মানুষ দরকার।’
অনন্তর-মা কথাটা মানিয়া নিয়া চুপ করিয়া রহিল। প্রতিবাদ করিয়া কথা বাড়াইল না। মার আঁচল ধরিয়া অনন্ত চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া ছিল। তার দিকে ইশারা করিয়া চাপাগলায় বলিল, ‘যা-তা কইও না ভইন। পুলা রইছে, দেখ না?’
অনন্ত আমোদ পাইতেছে। রূপকথার রাজ্যের লোকের ‘মত পাগলটার চেহারা। আর তার মা ওটাকে আবির মাখাইতেছে। পাগলটা আবিরের থালা ফেলিয়া দিয়াছে। মার আতগুলি আবির নষ্ট হইয়াছে। অনন্ত নত হইয়া মাটি হইতে আবির তুলিতেছিল। সুবলার বউ তার একখানা হাতে ধরিয়া জোরে সোজা করিয়া বলিল, ছত্তোরি, যামুন রাধামাধবেরে আবির দিতে। তারে আবির দিয়া লাভ কি। আয়রে অনন্ত।’
ঘরে গিয়া সে অনন্তকে আবির মাখাইল, চুমা খাইল, বুকে চাপিয়া ধরিল, ছাড়িয়া দিয়া আবার বুকে চাপিয়া ধরিল। অনন্তর মুখখান সুন্দর, চোখ দুটি সুন্দর, শরীরখানা সুন্দর। যখন কথা বলে কথাগুলি সুন্দর। যখন কোনদিকে চাহিয়া থাকে তখন তাকে অনেক অনেক বড় মনে হয়।
‘না দিদি, মন ঠাণ্ডা কর। পুরুষ মানুষ দিয়া কি হইব। তারা বৃষ্টির পানি-ফোটা, ঝরলেই শেষ। তারা জোয়ারের জল। তিলেক মাত্র মুখ দিয়া নদীর বুক শুইন্যা নেয়। এই অনন্তই আমরার আশা ভরসা। দুইজনে এরেই মানুষ কইরা তুলি চল। এ-ই একদিন আমরার দুঃখ ঘুচাইব।‘
অনন্তর মা যখন সূতা কাটিতে বসে, বৈশাখের উদাস হাওয়া তখন সামনের গাছগাছালি হইতে শুকনা পাতা ঝরাইয়া লইয়া তার ঘরে আসিয়া ঢোকে। এই সময়ের দমকা হাওয়া অনেককেই চমকাইয়া দেয়। অনন্তর মার বুকের শূন্যতাটুকু তখন বেশি করিয়া তার নিজের কাছে প্রকাশ হইয়া পড়ে। কিন্তু হাওয়া উদাস হইলে কি হইবে। বড় দুরন্ত। খামক কতকগুলি ঝরাপাতা রাখিয়া দিয়া তার ঘরখানাকে নোংরা করিয়া যায়। ঝাঁটাইয়া দূর করিয়া দিয়াও উপায় নাই, সে সে করিয়া সেগুলি আবার ঘরেই ঢুকিয় পড়ে। ‘তুত্তোর মরার পাতার জালায় গেলাম।’—নিরুপায় হইয়া সে দরজা বন্ধ করিয়া দেয়। এমন সময় এক ঝাপট দমকা হাওয়ার মতই অনন্ত আসিয়া উপস্থিত হয়। আম কুড়াইতে গিয়াছিল। এ হাওয়াতে গাছের পাতা যেমন ঝরে, তেমনি আমও ঝরে। তুই হাতে যাহা পারিয়াছে, বুকের সঙ্গে চাপিয়া ধরিয়া তাহাই নিয়া আসিয়াছে। দরজা বন্ধ দেখিয়া ডাক দেয়, মা, ছুয়ার ঘুচা, দেখ, কত আম। এই ডাকে সাড়া না দিয়া পারে না। দরজা খুলিয়া তাকে ঘরে নেয়। দেখি! কত আম। তোর মাসিরে ডাক দিয়া আন। অনন্ত একদৌড়ে ছুটিয়া যায়। সে ডাকে সুবলার বৌও সাড়া না দিয়া পারে না।
বর্ষায় খুব কষ্টে পড়িল। অনন্তর মা খায় কি। এই সময়ে মাছ খুব পড়ে। কিন্তু তার আগেই সকলের জাল বোনা শেষ হইয়া যায়। তারপর আর কেউ সূতা কিনিতে আসে না।
সূতাকাটাতে আর হাত চলে না। বিক্রি হয় না, কাটিয়া কি লাভ! তার সংসার অচল হইয়া পড়িতেছে। পেট ভরিয়া খাইতে না পারিয়া অনন্ত দিনদিন শুখাইয়া যাইতেছে।
সুবলার বৌ মা-বাপের চোখ এড়াইয়া এক আধ ‘টুরি’ চাউল আনিয়া দেয়, দুই একটা তরিতরকারি, এক-আধটা মাছ, একটু মুন, তেল, কয়েকটা হলুদ। তাতেই বা কত চলিবে। তাও বেশি দিন দিতে পারিল না। একদিন হাতেনাতে ধরা পড়িয়া গেল। মা-বাপের সংসারে পড়িয়া আছে সে। জলের উপরে ভাসিতেছে। পা বাড়াইয়া মাটির কঠিনতা সে কোনোকালে পাইল না। সে আর কি করিবে। মা বকিল, বাপে বকিল। সকল গালমন্দ সে মুখ বুজিয়া সহিয়া লইল। তারা তাকে অনন্তর মার বাড়ি আসিতে নিষেধ করিল। সে নিষেধ মানিয়া নেওয়া ছাড়া তারও কোনো উপায় রহিল না।
অনন্তর মা কোনোদিকে চাহিয়া ভরসা দেখে না। খড়ের চাল ফুটা হইয়া গিয়াছে। রাতদিন জল ঝরে। বেড়া এখানে ওখানে ভাঙ্গিয়া গিয়াছে। হু হু করিয়া ঠাণ্ডা বাতাস ঢোকে। পরণের কাপড়খানাতে ভাল করিয়া কোমর ঢাকিতে গেলে বুক ঢাকা পড়ে না, বুক ঢাকিতে গেলে উরুদুইটির খানে খানে ফরসা চামড়া বাহির হইয়া পড়ে। যেখানটাতে জল পড়ে না, তেমন একটু জায়গা দেখিয়া অনন্তকে লইয়া চুপ করিয়া বসিয়া থাকে। কাঁথা বালিস ভিজিতেছে লক্ষ্য করিয়া সেগুলিকে কাছে নিয়া আগলাইয়া বসে। এভাবে অনন্তর মার দিন আর কাটিতে চায় না।
সুবলার বৌর মতিগতি খারাপ হইয়া যাইতেছে। একদিন তার মা ইহা আবিষ্কার করিল। পশ্চিম পাড়াতে থাকে, বাঁশের ধনু মাটির গুলি লইয়া পাখি মারিয়া বেড়ায়, মাথায় বাবরি চুল, নাম তার ময়না। আঁস্তাকুড়ের পাশের ছিটুকি গাছের জঙ্গল। ময়না সেখানে একটা পাখিকে তাক করিয়াছিল। লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়াতে গুন গুন করিয়া গান ধরিয়াছিল, ‘টিয়া পাললাম, শালিখ পাললাম, আরও পাললাম ময়না রে। সোনামুখী দোয়েল পাললাম, আমার কথা কয় না রে।‘ সুবলার বউ আঁস্তাকুড়ে জঞ্জাল ফেলিতে গিয়া তার সঙ্গে হাসিয়া কথা কহিয়াছে। আর তার মা নিজের চোখে দেখিতে পাইয়াছে। দেখিয়া, রাগে গরগর করিতে করিতে, বুড়া বাড়ি আসিলে তাহাকে বলিয়া দিয়াছে।
দুইজনের ঝগড়া বকুনির পর সুবলার-বেয়েরও মুখ খুলিয়া গেল, ‘আমি ময়নার সাথে কথা কমু, তার সাথে পুরীর বাইর হইয়া যামু। তোমরা কি করতে পার আমার। খাইতে দিব না, খামু না, পরতে দিব না, পরুম না। কিন্তুক আমি বাইর হইয়া যামুই। তোমরার মুখে চুনকালি পড়ব, আমার কি। আমার তিন কুলে কারুর লাগি ভাবনা নাই। একলা গতর আমি লুটাইয়া দেমু, বিলাইয়া দেমু, নষ্ট কইরা দেমু, যা মনে লয় তাই করুম, তোমরা কথা কইতে পারব না। মনে কইরা দেখ কোন শিশুকালে বিয়া দিছল। মইরা গেছে। জানলাম না কিছু, বুঝলাম না কিছু। সেই অবুঝকালে ধর্মে কাঁচারাড়ি বানাইয়া থুইছে। সেই অবধি পোড়া কপাল লইয়া বনেবনে কাইন্দা ফিরি। তোমরা ত সুখে আছে। তোমরা কি বুঝ বা আমার দুঃখের গাঙ, কত গহীন। আমার বুঝি সাধ আহ্নাদ নাই। আমার বুঝি কিছুর দরকার লাগে না।‘