এ ঘরে সুবলার বউ কাহিনী শেষ করিয়া আনিয়াছে। আর এ ঘর হইতেই শোনা যাইতেছে বারান্দাতে পাগল ফোঁপাইতেছে তার শব্দ। অনন্তর মা অনেক করিয়াও মনের বেদন চাপিতে পারিতেছে না। বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়া উঠিতেছে। বুঝি এখনই কান্নায় ফাটিয়া পড়িবে। কিন্তু সব কিছু চাপিতে চাপিতে এমনই অভ্যাস হইয়া গিয়াছে যে, মনের জোরে সে পাথরের মতই শক্ত হইয়া যাইতে পারে।
কেরোসিনের আলোতে তার পাণ্ডুর মুখের দিকে চাহিয়া সুবলার বৌ শিহরিয়া উঠিল। নিশীথ রাত্রির স্তব্ধতার মাঝে মুখখান একেবারে অপার্থিব আকার ধারণ করিয়াছে। ক্ষণেকের জন্য তার মনে একটা সন্দেহ উঁকি দিয়া গেল, এ কি সেই, নয়া গাঙ্গের বুকে যাহাকে ডাকাতে লইয়া গিয়াছিল!
দিনের আলোতে যাকে সত্য ও বাস্তব মনে করা যাইত, রাতের গহনে তাকেই অবাস্তব রহস্তে রূপায়িত করিয়া দেয়। সুবলার বৌর বাস্তববুদ্ধি লোপ পাইল। নিশার গহনত তার কল্পনার দূরত্বকে অস্পষ্ট করিয়া দিল। তার মনে হইল, হাঁ সে-ই। তবে রক্তমাংসের মানুষ সে নয়। তার প্রেতাত্মা।
মঙ্গলার-বৌ কাছে না থাকিলে সুবলার বৌ চিৎকার করিয়া উঠিত।
মঙ্গলার বৌ তার ভাবান্তর লক্ষ্য করিয়া মনে করিল, ছেমড়ির ঘুম পাইয়াছে। বলিল, ‘যা লা সুবলার বৌ, অনন্তর পাশে গিয়া শুইয়া থাক?’
শুইয়া, ঘুমন্ত অনন্তকে বুকে চাপিয়া ধরিয়া সুবলার বৌ বুঝিতে পারিল এতক্ষণে সে বাস্তবের মৃত্তিক-স্পর্শ পাইয়াছে।
৪.৩ জন্ম মৃত্যু বিবাহ
সকালে পাগল আবার যা ছিল তাই হইয়া গেল।
অনন্তর মা রাতে চোখ বুজে নাই। সুবলার বউ, মঙ্গলার বউ, অনন্ত অকাতরে ঘুমাইতেছে। আর ঘুমাইতেছে বুড়ি। বুড়া রাতের জালে গিয়াছে, আসিতে অনেক দেরি হইবে। বেলা হইয়াছে। কিন্তু অনন্তর মার দিকে কেহই চাহিয়া থাকে নাই। তার বুক ধড়াস ধড়াস করিতে লাগিল। একখানি ধুচনিতে কয়েক খানি পিঠা তুলিয়া পরিপাটি করিয়া সাজাইল। মনে চিন্তার ঢেউ। পাগলের চোখে সারারাত ঘুম ছিল না। বারান্দায় বেড়া-দেওয়া খুপড়িতে সে ছিল। দা দিয়া মেঝের মাটি চষিয়া ফেলিয়াছে। অনন্তর মা তার সামনে গিয়া দাঁড়াইল। সে ঘাড় তুলিয়া চাহিল, দা উচাইয়া কোপ মারিতে আসিল। অনন্তর মা নড়িল না। এক হাতে ধুচনি আগাইয়া দিল আরেক হাতে তার পিঠে মাথায় স্পর্শ করিতে লাগিল। কোনো সুন্দরী যেন বনের এক জানোয়ারকে বশ করিতে যাইতেছে। পাগল তার দায়ের উদ্যত কোপ থামাইল, কিন্তু শান্ত হইল না। দায়ের ঘাড়ের দিকটা দিয়া অনন্তর মার পিঠে আঘাত করিল। অনন্তর মা ভ্ৰক্ষেপ করিল না। একটু হাসিবার চেষ্টা করিয়া একখানা পিঠা তার মুখে তুলিয়া দিল। পাগল মুখ ফিরাইয়া উঠানে নামিল, নামিয়া একদিকে দৌড় দিল।
অনন্তর মার বুক আশায় ভরিয়া উঠিল। তার পাগল হয়ত একদিন ভাল হইয়া যাইবে।
সেদিন সুবলার বৌর গলা জড়াইয়া অনন্তর মা অনেকক্ষণ কাঁদিল। কিন্তু সুবলার বৌ এ কান্নার কোনো অর্থ খুঁজিয়া পাইল না।
মাঘের শীত গিয়া ফাল্গুনের বসন্ত আসিল। পাগলের বাড়ির মন্দার গাছে প্রায়ই একটা কোকিল ডাকে। অনন্তর মা সুযোগ পাইলেই গিয়া দাঁড়ায়। তাকে এক নজর দেখিয়া আসে। কিন্তু দেখা দেয় না, চোরের মত যায়, পাছে পাগলের নিকট নিজে ধরা পড়ে। চৈত্রের শেষে বসন্ত যাই যাই করিতেছে। এমন সময় আসিল দোল পূর্ণিমা। উত্তরের শুকদেবপুরের মত এ গায়ের মালোরাও দোল করিল, হোলি-গান গাহিল। সুবলার বৌ নিজে স্নান করিল, অনন্তকে, তার মাকে স্নান করাইল। পরে অনন্তকে দিয়া বাজার হইতে আবির আনাইয়া বলিল, ‘চল দিদি উত্তরের আখড়ায় রাধামাধবেরে আবির দিতে যাই।’
রাধামাধব জ্যান্ত কেউ নয়। বিগ্রহ। তাকে আবির দিলে কি হইবে। সে তো আর পাল্টা আবির দিতে পারিবে না। চুপ করিয়া থাকিবে আর যত দেও তত আবির গ্রহণ করিবে। তবু এতে নূতনত্ব আছে। দশজন স্ত্রীলোকের মাঝে মিশিয়া একটু আনন্দ করা যাইবে। অনন্তর মা বলিল, ‘চল যাই।’
পাগলের উঠান দিয়া পথ। কোথা হইতে ছুটিয়া আসিয়া পথ আগলাইয়া দাঁড়াইল। আব্দার ধরিল, ‘আ গোপিনী, আমারে আবির দে।’
সুবলার বৌ বিরক্ত হইয়া বলিল, ‘ভারি আহ্লাদের পাগল। তারার পাগল তারা বাইন্ধা রাখতে পারে না। কয়, পরের পাগল হাততালি, আপনা পাগল বাইন্ধ রাখি। ছাইড়া দেয় কেনে? পাড়াপড়শীরে জাদ করার লাগি ’ সে কোনমতে পাশ কাটাইয়া বিপদ হইতে মুক্তি পাইল। অনন্তর মা তার পিছনে ছিল। আবেগে চঞ্চল হইয়া এক ঝাকা চুলদাড়ির উপর মুটামুঠ আবির মাখাইয়া দিল। চোখের কোণে রহস্য করিতে করিতে পাগল বলিল, ‘আমার আণবির কই হি হি হি? বলিয়া সে এক ধাক্কায় আবিরের থালা অনন্তর মার হাত হইতে মাটিতে ফেলিয়া দিয়া ঘরে গিয়া দরজা বন্ধ করিল।
সুবলার বৌ হতবুদ্ধি হইয়া বলিল, ‘একি করলা তুমি দিদি।‘
অনন্তর মা হাসিয়া বলিল, ‘আইজকার দিনে সকলে সকলেরে রাঙাইছে। পাগলেরে ত কেউ রাঙাইল না ভইন। আমি একটু রাঙাষ্টয়া দিলাম।‘
‘কেউ যদি দেখত?‘
‘ত হইলে কইতাম তারে, পাগলে আমারে পাগলিনী করছে।’
‘মস্করা রাখ দিদি। কোন দিন তোমারে ধইরা পাগলে না জানি কি কইরা বসে, আমি সেই চিন্তাই করি দিদি। কি কারণে পাগল হইছে সেই কথাখান ত তুমি জান না।’
‘জানি গো জানি, মনের মানুষ হারাইয়া পাগল হইছে।’