‘আমি কি মাথার কিরা দিয়া কই যে, বাসন্তীরে আমার পাগলের সাথে বিয়া দেও।’
‘কি যে তুমি কও দাদা। সেই কথা তুমি কি কইতে পার। তোমারে আমরা চিনি না?’
‘তবে এমন এড়াইয়া বেড়াইয়া চল কেনে ভাই।’
‘এড়াইয়া চলি, তোমার কষ্ট দেইখ্যা বুক কান্দে, তাই।’
‘আমার কষ্ট নিয়া আমি আছি। তার জন্যে তোমরা কেনে কান্দ?’
দীননাথের বুক বেদনায় টনটন করিয়া উঠে! একমাত্র ছেলে। পাগল হইয়া গিয়াছে। ঘর তুয়ার ভাঙ্গে। জিনিসপত্ৰ লণ্ডভণ্ড করে। গলা ফাটাইয়া কাঁদে। বুড়া তাকে নিয়া কি বিপদেই পড়িয়াছে। একে শেষ বয়স। তার উপর এই দাগ। এই কয়মাসে তাকে দ্বিগুণ বুড়া বানাইয়াছে। আর বুড়ি। তার দিকে আর চাওয়াই যায় না। অনেক কান্না জমাট বাঁধিয়া তাকে বোবা বানাইয়াছে। ইহাদিগকে সান্তনা দিবার চেষ্টা করা অপেক্ষ ইহাদিগকে এড়াইয়া চলা অনেক সহজ।
‘বাসন্তীর বিয়া কোনখানে ঠিক কর্লা?’
দীননাথ অপরাধীর মত বলে, ‘আমি ত চুপ কইরা আছিলাম। গোলমাল লাগাইয়াছে আমার পরিবার। কয়, সুবল খুব ভাল পাত্র। তারেই ডাক দিয়া বাসন্তীরে পার কর।‘
একদিন সুবলের সঙ্গে বাসন্তীর বিবাহ হইয়া গেল। সেই এক রাত। আকাশে চাঁদ আছে তারা আছে। দীননাথের উঠানে কলাগাছের তলায় বাসন্তীকে সুবল হাতে হাত দিয়া বউ করিতেছে। মেয়ের গীত গাহিতেছে হুলুধ্বনি দিতেছে। জোরে জোরে বাজনা বাজিতেছে। এত জোরে বাজিতেছে যেন রামকেশবের কানের পর্দা ছিঁড়িয়া যাইবে। একটা টিমটিমে আলোর সামনে রামকেশব তামাক টানিতেছে। হুকার শব্দে বাজনার শব্দ ঢাকিবার বৃথা চেষ্টা করিতেছে। তার পাশে বুড়ি বসিয়া বসিয়া ঝিমাইতেছে। গভীরভাবে কিছু বুঝিবার মত বোধশক্তি তার আর অবশিষ্ট নাই। আর বোধশক্তি নাই পাগলটার। সে অর্থহীন ভাবে একটা পুরোনো জাল টানিয়া ছিঁড়িতেছে।
অনেক রাত অবধি সে বাজনা চলিল। তারপর এক সময় উহাও নিস্তব্ধ হইয়া গেল। তখন বুঝি বিবাহবাড়ির সকলেই ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। কিন্তু বুড়াবুড়ির চোখে সে রাতে আর ঘুম আসিল না।
তারপর একটি দুইটি করিয়া পাঁচটি বছর গত হইল। এই পাঁচ বছরে অনেক কিছুই ঘটিয়াছে। যেমন তিলক মারা গিয়াছে। কিন্তু কে মনে রাখিয়াছে!
তবে একটি ঘটনা মালোপাড়ার অনেকেই মনে রাখিয়াছে। সে হইতেছে সুবলের মৃত্যু। বড় মর্মান্তিকভাবে মরিয়াছে সুবল। কালোবরণের বড় নৌকায় করিয়া জিয়লের ক্ষেপ দিতে গিয়াছিল। সুবল বলিয়াছিল আমাকে ভাগীদার হিসাবে নেও। তারা বলিয়াছিল নৌকা আমাদের পুজি আমাদের। ভাগীদার হিসাবে নিব কেন? মাসিক বেতনে নিব। শুনিয়া সুবলের বৌ বলিয়াছিল, তবে গিয়া কাম নাই। কিন্তু বিবাহ করিয়াছে, লোকজন খাওয়াইয়াছে। হাতের টাকাকড়ি খরচ হইয়া গিয়াছে। সামনে তুরন্ত আষাঢ় মাস। এই দুঃসময়ে সে নিজে কি খাইবে বৌকে কি খাওয়াইবে! কাজেই বেতনধারী হইয়া না গিয়াই বা সে কি করে!
এখন, লোক যদি হয় বেতনধারী, পুঁজিদার হয় তার মালিক, তাকে সেই মালিক তখন চাকরের মত জ্ঞান করে!
মেঘনা নদীর মাঝখান দিয়া কালোবরণ বেপারির নৌকা চলিতেছিল। এমন সময় আসিল তুফান। ঈশান কোণের বাতাস নৌকাটাকে ঝাটাইয়া তীরের দিকে নিয়া চলিল। সকলে প্রস্তুত হইল তীরে ধাক্কা লাগিবার আগেই তারা লাফাইয়া নামিয়া পড়িবে এবং একযোগে ঠেলিয়া নৌকার গতিবেগ কমাইয়া আসন্ন তুর্ঘটনা নিবারণ করিবে। আগে সুবলের উপর আদেশ হইল, শীঘ্র লগি হাতে লাফাইয়া তীরে গিয়া পড়, পড়িয়া, লগি ঠেকাইয়া নৌকাটাকে বাঁচা। তোর সঙ্গে আমরাও লাফ দিতেছি। বেতনধারী লোকের মনে মুনিবের প্রতি প্রবল একটা বাধ্যবাধকতাবোধ থাকে। তাই সুবল ফলাফল না ভাবিয়া মালিকের আদেশমত লাফাইয়া তীরে নামিল কিন্তু আর কেউ ভয়ে নামিল না। সুবল লগিটার গোড়াটা নৌকার তলার দিকে ছুড়িয়া, মাঝখানটাতে কাঁধ লাগাইতে গেল, তাহাতে নৌকার বেগ যদি একটু কমে। বেগ কমিল না। ঢালু তীর। সবেগে নৌকা তীরে উঠিয়া আসিল। সুবল নৌকার তলায় চাপ৷ পড়িল, আর উঠিল না।
বাসন্তীর হাতের শাখা ভাঙ্গিল, কপালের সিঁদুর মুছিল। কিন্তু জাগিয়া রহিল একটা অব্যক্ত ক্রোধ।
চারি পাঁচ বছরে সে অনেক কিছু ভুলিয়াছে। স্বামীর জন্য আর তার কষ্ট হয় না। স্বামী বড় নিদারুণ মৃত্যু মরিয়াছে। একথা মাঝে মাঝে মনে হয়। কল্পনা করিতে চেষ্টা করে একটা মনিবের অসঙ্গত আদেশ আর একটা নিরুপায় ভূত্যের তাহা পালনের জন্য মৃত্যুর মুখে বাপাইয় পড়ার দৃশ্যটা।
একটা পড়ার পুঁথির মত পাগলের মনের উপর দিয়া তার পাগলামির ইতিহাসখানা পাতার পর পাতা উল্টাইয়া গেল। পূর্বস্মৃতি হয়ত তাকে খানিকক্ষণের জন্য আত্মস্থ করিয়া দিল, সে নিজের দিকে, জগতের দিকে তাকাইবার সহজাত ক্ষমতা ফিরিয়া পাইল। না, হয়ত পাইল না। দুইটি নারী তার রান্নাঘরে পিঠা বানাইতেছে। দুইটির সহিতই তার জীবনের সম্পর্ক সুগভীর। ইহাদিগকে কাছে পাইয়া হয়ত ক্ষণকালের জন্য তার বুক ভরিয়া উঠিয়াছে। হয়ত ভরিয়া উঠে নাই। পাগলের মনের হদিস পাওয়া স্বাভাবিক মানুষের কাজ নয়। তবু মনে হয়, দুটি নারীর এতখানি কাছে অবস্থান তার মনে আলোড়ন জাগাইয়া থাকিবে, তাহা না হইলে, হাঁড়িখুড়ি না ভাঙ্গিয়া, জাল দড়ি না ছিঁড়িয়া ভাল মানুষের মত সে স্থির হইয়া বসিয়া কাঁদিবে কেন?